অনেক আকাশ

গানের সুরের মতো বিকেলের দিকের বাতাসে
পৃথিবীর পথ ছেড়ে – সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে
হৃদয় ভাসিয়া যায়,- সেখানে সে কারে ভালোবাসে !-
পাখির মতন কেঁপে – ডানা মেলে- হিম- চোখ বুজে
অধীর পাতার মতো পৃথিবীর মাঠের সবুজে
উড়ে উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে,-
নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে
ঘুমাতে চেয়েছে,- তবু- ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসে,-
তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে!

আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর
ক’মে যায়; -তাই নীল আকাশের স্বাদ- স্বচ্ছলতা-
পূর্ণ ক’রে দিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুদির গহ্বর;
মানুষের অন্তরের অবসাদ – মৃত্যুর জড়তা
সমুদ্র ভাঙিয়া যায়; – নক্ষত্রের সাথে কয় কথা
যখন নক্ষত্র তবু আকাশের অন্ধকার রাতে-
তখন হৃদয়ে জাগে নতুন যে এক অধীরতা ,
তাই ল’য়ে সেই উষ্ণ –আকাশের চাই যে জড়াতে
গোধূলির মেঘে মেঘ, নক্ষত্রের মতো র’বো নক্ষত্রের সাথে!

আমারে দিয়েছ তুমি হৃদয়ের যে এক ক্ষমতা
ওগো শক্তি ,- তার বেগে পৃথিবীর পিপাসার ভার
বাধা পায়, জেনে লয় নক্ষত্রের মতো স্বচ্ছতা!
আমারে করেছ তুমি অসহিস্নু- ব্যর্থ-চমৎকার !
জীবনের পারে থেকে যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার,
কবর খুলেছে মুখ বার-বার যার ইশারায়,
বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষার তার
তাহার আঘাত পেয়ে কেঁপে কেঁপে ছিঁড়ে শুধু যায়!
একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে- বৈকালের আলোয় – সন্ধ্যায় !

সে এসে পাখির মতো স্থির হয়ে বাধে নাই নীড়, –
তাহার পাখায় শুধু লেগে আছে তীর – অস্থিরতা !
অধীর অন্তর তারে করিয়াছে অস্থির অধীর !
তাহারি হৃদয় তারে দিয়েছে ব্যাধের মতো ব্যথা!
একবার তাই নীল আকাশের আলোর গাড়তা
তাহারে করেছে মুগ্ধ, – অন্ধকার নক্ষত্র আবার
তাহারে নিয়েছে ডেকে ,- জেনেছে সে এই চঞ্চলতা
জীবনের;- উড়ে উড়ে দেখেছে সে মরণের পার
এই উদ্বেলতা ল’য়ে নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার!

গোধূলির আলো ল’ য়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা,
স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা একা রেখেছে সে ঢাকি ;
আকাশে আঁধার কেটে গিয়েছে যখন ভোরবেলা
সবাই এসেছে পথে,- আসে নাই তবু সেই পাখি!-
নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী,
ছায়ার উপরে তার নিজের পাখার ছায়া ফেলে
সাজায়েছে স্বপনের’ পরে তার হৃদয়ের ফাঁকি !
সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে
সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তারে ফেলেছে সে মুছে অবহেলা !

কেউ তারে দেখে নাই ;- মানুষের পথ ছেড়ে দূরে
হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা ল’য়ে
যেইখানে পৃথিবীর মানুষের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে
কথা কয়,- আকাঙ্ক্ষার আলোড়নে চলিতেছে বয়ে
হেমন্তের নদী,- ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে
হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস,-
তাহাদের মতো হয়ে তাহাদের সাথে গেছি রয়ে :
দূরে পড়ে পৃথিবীর ধূলা – মাটি – নদী- মাঠ – ঘাস,-
পৃথিবীর সিন্ধু দূরে ,- আরো দূরে পৃথিবীর মেঘের আকাশ !

এখানে দেখেছি আমি জাগিয়াছ হে তুমি ক্ষমতা,
সুন্দর মুখের চেয়ে তুমি আরো ভীষণ –সুন্দর !
ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি – আরো ভীষণতা
আমারে দিয়েছে ভয়! এইখানে পাহাড়ের’ পর
তুমি এসে বসিয়াছ,- এইখানে অশান্ত সাগর
তোমারে এনেছে ডেকে ;- হে ক্ষমতা , তোমার বেদনা
পাহাড়ের বনে বনে তুলিতেছে উত্তরের ঝড়
আকাশের চোখে- মুখে তুলিতেছে বিদ্যুতের ফণা
তোমার স্ফুলিঙ্গ আমি, ওগো শক্তি,- উল্লাসের মতন যন্ত্রণা !

আমার সকল ইচ্ছা প্রার্থনার ভাষার মতন
প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে উঠে
তোমারে প্রাণের কাছে একদিন পেয়েছে কখন !
সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুকে ফুটে,
আঁধার রাতের মতো তারার আলোর দিকে ছুটে ,
সিন্ধুর ঢেউ এর মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে
সব আকাঙ্ক্ষার বাঁধ একবার গেছে তার টুটে !
বিদ্যুতের পিছে পিছে ছুটে গেছি বিদ্যুতের বেগে !
নক্ষত্রের মতো আমি আকাশের নক্ষত্রের বুকে গেছি লেগে !

যেই মুহূর্ত চ’লে গেছে ,- জীবনের যেই দিন গুলি
ফুরায়ে গিয়েছে সব,- একবার আসে তারা ফিরে;
তোমার পায়ের চাপে তাদের করেছো তুমি ধূলি !
তোমার আঘাত দিয়ে তাদের গিয়েছ তুমি ছিঁড়ে !
হে ক্ষমতা ,- মনের ব্যথার মতো তাদের শরীরে
নিমেষে নিমেষে তুমি কতবার উঠেছিলে জেগে !
তারা সব চ’লে গেছে;- ভূতুড়ে পাতার মতো ভিড়ে
উত্তর হাওয়ার মতো তুমি আজো রহিয়াছ লেগে!
যে সময় চ’লে গেছে তা- ও কাঁপে ক্ষমতার বিস্ময়ে – আবেগে !

তুমি কাজ ক’রে যাও, ওগো শক্তি , তোমার মতন !
আমারে তোমার হাতে একাকী দিয়েছি আমি ছেড়ে ;
বেদনা- উল্লাসে তাই সমুদ্রের মতো ভরে মন !-
তাই কৌতূহল – তাই ক্ষুধা এসে হৃদয়েরে ঘেরে ,-
জোনাকির পথ ধ’রে তাই আকাশের নক্ষত্রেরে
দেখিতে চেয়েছি আমি, – নিরাশার কোলে ব’সে একা
চেয়েছি আশারে আমি,- বাঁধনের হাতে হেরে, হেরে
চাহিয়াছি আকাশের মতো এক অগাধের দেখা ! –
ভোরের মেঘের ঢেউয়ে মুছে দিয়ে রাতের মেঘের কালো রেখা!

আমি প্রণয়িনী ,- তুম হে অধীর , আমার প্রণয়ী !
আমার সকল প্রেম উঠেছে চোখের জলে ভেসে !-
প্রতিধ্বনির মতো হে ধ্বনি, তোমার কথা কহি
কেঁপে উঠে – হৃদয়ের সে যে কত আবেগে আবেশে!
সব ছেড়ে দিয়ে আমি তোমারে একাকী ভালোবেসে
তোমার ছায়ার মতো ফিরিয়াছি তোমার পিছনে !
তবু ও হারায়ে গেছ ,- হঠাৎ কখন কাছে এসে
প্রেমিকের মতো তুমি মিশেছ আমার মনে মনে
বিদ্যুৎ জ্বালায়ে গেছ,-আগুন নিভায়ে গেছ হঠাৎ গোপনে !

0 Shares