আনন্দমঠ

একটি বৃহৎ আম্রকাননমধ্যে একটি ছোট বাড়ী। চারি দিকে মাটির প্রাচীর, চারি দিকে চারিখানি ঘর। গৃহস্থের গোরু আছে, ছাগল আছে, একটা ময়ূর আছে, একটা ময়না আছে, একটা টিয়া আছে। একটা বাঁদর ছিল, কিন্তু সেটাকে আর খাইতে দিতে পারে না বলিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। একটা ঢেঁকি আছে, বাহিরে খামার আছে, উঠানে লেবুগাছ আছে, গোটাকতক মল্লিকা যুঁইয়ের গাছ আছে, কিন্তু এবার তাতে ফুল নাই। সব ঘরের দাওয়ায় একটা একটা চরকা আছে; কিন্তু বাড়ীতে বড় লোক নাই। জীবানন্দ মেয়ে কোলে করিয়া সেই বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিল।

বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়াই জীবানন্দ একটি ঘরের দাওয়ায় উঠিয়া একটা চরকা লইয়া ঘেনর ঘেনর আরম্ভ করিলেন। সে ছোট মেয়েটি কখন চরকার শব্দ শুনে নাই। বিশেষত: মা ছাড়া হইয়া অবধি কাঁদিতেছে, চরকার শব্দ শুনিয়া ভয় পাইয়া আরও উচ্চ সপ্তকে উঠিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল। তখন ঘরের ভিতর হইতে একটি সতের কি আঠার বৎসরের মেয়ে বাহির হইল। মেয়েটি বাহির হইয়াই দক্ষিণ গণ্ডে দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুলি সন্নিবিষ্ট করিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া দাঁড়াইল। “এ কি এ? দাদা চরকা কাটো কেন? মেয়ে কোথা পেলে? দাদা, তোমার মেয়ে হয়েছে না কি – আবার বিয়ে করেছ না কি?”

জীবানন্দ মেয়েটি আনিয়া সে যুবতীর কোলে দিয়া তাহকে কীল মারিতে উঠিলেন, বলিলেন, “বাঁদরি, আমার আবার মেয়ে, আমাকে কি হেজিপেঁজি পেলি না কি? ঘরে দুধ আছে?”

তখন সে যুবতী বলিল, “দুধ আছে বই কি, খাবে?”

জীবানন্দ বলিল, “হাঁ খাব |”

তখন সে যুবতী ব্যস্ত হইয়া দুধ জ্বাল দিতে গেল। জীবানন্দ ততক্ষণ চরকা ঘেনর ঘেনর করিতে লাগিলেন। মেয়েটি সেই যুবতীর কোলে গিয়া আর কাঁদে না। মেয়েটি কি ভাবিয়াছিল বলিতে পারি না – বোধ হয় সেই যুবতীকে ফুল্লকুসুমতুল্য সুন্দরী দেখিয়া মা মনে করিয়াছিল। বোধ হয় উননের তাপের আঁচ মেয়েটিকে একবার লাগিয়াছিল, তাই সে একবার কাঁদিল। কান্না শুনিবামাত্র জীবানন্দ বলিলেন, “ও নিমি! ও পোড়ারমুখি! ও হনুমানি! তোর এখনও দুধ জ্বাল হলো না?” নিমি বলিল, “হয়েছে |” এই বলিয়া সে পাথর বাটীতে দুধ ঢালিয়া জীবানন্দের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিল। জীবানন্দ কৃত্রিম কোপ প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “ইচ্ছে করে যে, এই তপ্ত দুধের বাটী তোর গায়ে ঢালিয়া দিই – তুই কি মনে করেছিস আমি খাব না কি?”

নিমি জিজ্ঞেস করিল, “তবে কে খাবে?”

জী। ঐ মেয়েটি খবে দেখছিস নে, ঐ মেয়েটিকে দুধ খাওয়া।

নিমি তখন আসনপিঁড়ি হইয়া বসিয়া মেয়েকে কোলে শোয়াইয়া ঝিনুক লইয়া তাহাকে দুধ খাওয়াইতে বসিল। সহসা তাহার চক্ষু হইতে ফোঁটাকতক জল পড়িল। তাহার একটি ছেলে হইয়া মরিয়া গিয়াছিল, তাহারই ঐ ঝিনুক ছিল। নিমি তখনই হাত দিয়া জল মুছিয়া হাসিতে হাসিতে জীবানন্দকে জিজ্ঞাসা করিল,-“হ্যাঁ দাদা, কার মেয়ে দাদা?”

জীবানন্দ বলিলেন, “তোর কি রে পোড়ারমুখি?”

নিমি বলিল, “আমায় মেয়েটি দেবে?”

জীবানন্দ বলিল, “তুই মেয়ে নিয়ে কি করবি?”

নি। আমি মেয়েটিকে দুধ খাওয়াব, কোলে করিব, মানুষ করিব – বলতে বলতে ছাই পোড়ার চক্ষের জল আবার আসে, আবার নিমি হাত দিয়া মুছে, আবার হাসে।

জীবানন্দ বলিল, “তুই নিয়ে কি করবি? তোর কত ছেলেমেয়ে হবে |”

নি। তা হয় হবে, এখন এ মেয়েটি দাও, এর পর না হয় নিয়ে যেও।

জী। তা নে, নিয়ে মরগে যা। আমি এসে মধ্যে মধ্যে দেখে যাব। উটি কায়েতের মেয়ে, আমি চললুম এখন–

নি। সে কি দাদা, খাবে না! বেলা হয়েছে যে। আমার মাথা খাও, দুটি খেয়ে যাও।

জী। তোর মাথাও খাব, আবার দুটি খাব? দুই ত পেরে উঠবো না দিদি। মাথা রেখে দুটি ভাত দে।

নিমি তখন মেয়ে কোলে করিয়া ভাত বাড়িতে ব্যতিব্যস্ত হইল।

নিমি পিঁড়ি পাতিয়া জলছড়া দিয়া জায়গা মুছিয়া মল্লিকাফুলের মত পরিষ্কার অন্ন, কাঁচা কলায়ের দাল, জঙ্গুলে ডুমুরের দাল‍না, পুকুরের রুইমাছের ঝোল, এবং দুগ্ধ আনিয়া জীবানন্দকে খাইতে দিল। খাইতে বসিয়া জীবানন্দ বলিলেন, “নিমাই দিদি, কে বলে মন্বন্তর? তোদের গাঁয়ে বুঝি মন্বন্তর আসে নি?”

নিমি বলিল, “মন্বন্তর আসবে না কেন, বড় মন্বন্তর, তা আমরা দুটি মানুষ, ঘরে যা আছে, লোককে দিই থুই ও আপনারা খাই। আমাদের গাঁয়ে বৃষ্টি হইয়াছিল, মনে নাই? – তুমি যে সেই বলিয়া গেলে, বনে বৃষ্টি হয়। তা আমাদের গাঁয়ে কিছু ধান হয়েছিল – আর সবাই সহরে বেচে এল – আমরা বেচি নাই |”

জীবানন্দ বলিল, “বোনাই কোথা?”

নিমি ঘাড় হেঁট করিয়া চুপি চুপি বলিল, “সের দুই তিন চাল লইয়া কোথায় বেরিয়েছেন। কে নাকি চাল চেয়েছে |”

এখন জীবানন্দর অদৃষ্টে এরূপ আহার অনেক কাল হয় নাই। জীবানন্দ আর বৃথা বাক্যব্যয়ে সময় নষ্ট না করিয়া গপ্ গপ্ টপ্ টপ্ সপ্ সপ্ প্রভৃতি নানাবিধ শব্দ করিয়া অল্পকালমধ্যে অন্নব্যঞ্জনাদি শেষ করিলেন। এখন শ্রীমতী নিমাইমণি শুধু আপনার ও স্বামীর জন্যা রাঁধিয়াছিলেন, আপনার ভাতগুলি দাদাকে দিয়াছিলেন, পাথর শূন্য দেখিয়া অপ্রতিভ হইয়া স্বামীর অন্নব্যঞ্জনগুলি আনিয়া ঢালিয়া দিলেন। জীবানন্দ ভ্রূক্ষেপ না করিয়া সে সকলই উদরনামক বৃহৎ গর্তে প্রেরণ করিলেন। তখন নিমাইমণি বলিল, “দাদা, আর কিছু খাবে?”

জীবানন্দ বলিল, “আর কি আছে?”

নিমাইমণি বলিল, “একটা পাকা কাঁটাল আছে |”

নিমাই সে পাকা কাঁটাল আনিয়া দিল – বিশেষ কোন আপত্তি না করিয়া জীবানন্দ গোস্বামী কাঁটালটিকেও সেই ধ্বংসপুরে পাঠাইলেন। তখন নিমাই হাসিয়া বলিল, “দাদা আর কিছু নাই |”

দাদা বলিলেন, “তবে যা। আর একদিন আসিয়া খাইব |”

অগত্যা নিমাই জীবানন্দকে আঁচাইবার জল দিল। জল দিতে দিতে নিমাই বলিল, “দাদা, আমার একটি কথা রাখিবে?”

জী। কি?

নি। আমার মাথা খাও।

জী। কি বল না, পোড়ারমুখি।

নি। কথা রাখবে?

জী। কি আগে বল না।

নি। আমার মাথা খাও – পায়ে পড়ি।

জী। তোর মাথাও খাই – তুই পায়েও পড়, কিন্তু কি বল?

জীবানন্দ বলিল, “আমি কত লোক মারিয়া ফেলিয়াছি, তা তুই জানিস?”

এইবার নিমি রাগ করিল, বলিল, “বড় কীর্তিই করেছ – স্ত্রী ত্যাগ করবে, লোক মারবে, আমি তোমায় ভয় করব! তুমিও যে বাপের সন্তান, আমিও সেই বাপের সন্তান – লোক মারা যদি বড়াইয়ের কথা হয়, আমায় মেরে বড়াই কর |”

0 Shares