আনন্দমঠ

শান্তি বলিল, “তুমি ফিরিয়া আসিবে ত?” জীবানন্দ কিছু উত্তর না করিয়া, কোন দিক না চাহিয়া, সেই পথিপার্শ্বস্থ নারিকেলকুঞ্জের ছায়ায় শান্তির অধরে অধর দিয়া সুধাপান করিলাম মনে করিয়া, প্রস্থান করিলেন।

মাকে বুঝাইয়া, জীবানন্দ মার কাছে বিদায় লইয়া আসিলেন। ভৈরবীপুরে সম্প্রতি তাঁহার ভগিনী নিমাইয়ের বিবাহ হইয়াছিল। ভগিনীপতির সঙ্গে জীবানন্দের একটু সম্প্রীতি জন্মিয়াছিল। জীবানন্দ শান্তিকে লইয়া সেইখানে গেলেন। ভগিনীপতি একটু ভূমি দিল। জীবানন্দ তাহার উপর এক কুটীর নির্মাণ করিলেন। তিনি শান্তিকে লইয়া সেইখানে সুখে বাস করিতে লাগিলেন। স্বামিসহবাসে শান্তির চরিত্রের পৌরুষ দিন দিন বিলীন বা প্রচ্ছন্ন হইয়া আসিল। রমণীয় রমণীচরিত্রের নিত্য নবোন্মেষ হইতে লাগিল। সুখস্বপ্নের মত তাঁহাদের জীবন নির্বাহিত হইত ; কিন্তু সহসা সে সুখস্বপ্ন ভঙ্গ হইল। জীবানন্দ সত্যানন্দের হাতে পড়িয়া, সন্তানধর্ম গ্রহণপূর্বক, শান্তিকে পরিত্যাগ করিয়া গেলেন। পরিত্যাগের পর তাঁহাদের প্রথম সাক্ষাৎ নিমাইয়ের কৌশলে ঘটিল। তাহাই আমি পূর্বপরিচ্ছেদে বর্ণিত করিয়াছি।
দ্বিতীয় খণ্ড
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

জীবানন্দ চলিয়া গেলে পর শান্তি নিমাইয়ের দাওয়ার উপর গিয়া বসিল। নিমাই মেয়ে কোলে করিয়া তাহার নিকট আসিয়া বসিল। শান্তির চোখে আর জল নাই ; শান্তি চোখ মুছিয়াছে, মুখ প্রফুল্ল করিয়াছে, একটু একটু হাসিতেছে। কিছু গম্ভীর, কিছু চিন্তাযুক্ত, অন্যমনা। নিমাই বুঝিয়া বলিল, “তবু ত দেখা হলো |”

গীত2

“দড় বড়ি ঘোড়া চড়ি কোথা তুমি যাও রে |”

“সমরে চলিনু আমি হামে না ফিরাও রে।

হরি হরি হরি হরি বলি রণরঙ্গে,

ঝাঁপ দিব প্রাণ আজি সমর তরঙ্গে,

তুমি কার কে তোমার, কেন এসো সঙ্গে,

রমণীতে নাহি সাধ, রণজয় গাও রে |”

“পায়ে ধরি প্রাণনাথ আমা ছেড়ে যেও না |”

“ওই শুন বাজে ঘন রণজয় বাজনা।

নাচিছে তুরঙ্গ মোর রণ করে কামনা,

উড়িল আমার মন, ঘরে আর রব না,

রমণীতে নাহি সাধ রণজয় গাও রে |”

দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পরদিন আনন্দমঠের ভিতর নিভৃত কক্ষে বসিয়া ভগ্নোৎসাহ সন্তাননায়ক তিন জন কথোপকথন করিতেছিলেন। জীবানন্দ সত্যানন্দকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! দেবতা আমাদিগের প্রতি এমন অপ্রসন্ন কেন? কি দোষে আমরা মুসলমানের নিকট পরাভূত হইলাম?”

সত্যানন্দ বলিলেন, “দেবতা অপ্রসন্ন নহেন। যুদ্ধে জয় পরাজয় উভয়ই আছে। সে দিন আমরা জয়ী হইয়াছিলাম, আজ পরাভূত হইয়াছি, শেষ জয়ই জয়। আমার নিশ্চিত ভরসা আছে যে, যিনি এত দিন আমাদিগকে দয়া করিয়াছেন, সেই শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বনমালী পুনর্বার দয়া করিবেন। তাঁহার পাদস্পর্শ করিয়া যে মহাব্রতে আমরা ব্রতী হইয়াছি, অবশ্য সে ব্রত আমাদিগকে সাধন করিতে হইবে। বিমুখ হইলে আমরা অনন্ত নরক ভোগ করিব। আমাদের ভাবী মঙ্গলের বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই। কিন্তু যেমন দৈবানুগ্রহ ভিন্ন কোন কার্য সিদ্ধ হইতে পারে না, তেমনি পুরুষকারও চাই। আমরা যে পরাভূত হইলাম, তাহার কারণ এই যে, আমরা নিরস্ত্র। গোলা গুলি বন্দুক কামানের কাছে লাঠিসোটা বল্লমে কি হইবে? অতএব আমাদিগের পুরুষকারের লাঘব ছিল বলিয়াই এই পরাভব হইয়াছে। এক্ষণে আমাদের কর্তব্য, আমাদিগেরও ঐরূপ অস্ত্রের অপ্রতুল না হয় |”

জী। সে অতি কঠিন ব্যাপার।

স। কঠিন ব্যাপার জীবানন্দ? সন্তান হইয়া তুমি এমন কথা মুখে আনিলে? সন্তানের পক্ষে কঠিন কাজ আছে কি?

সত্য। সেই মহেন্দ্রের স্ত্রী-কন্যা।

ভবানন্দ চমকিয়া উঠিলেন। তখন তিনি বুঝিলেন যে, যে স্ত্রীলোককে তিনি ঔষধবলে পুনর্জীবিত করিয়াছিলেন, সেই মহেন্দ্রের স্ত্রী কল্যাণী। কিন্তু এক্ষণে কোন কথা প্রকাশ করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন না।

জীবানন্দ বলিলেন, “মহেন্দ্রের স্ত্রী মরিল কিসে?”

স। বিষ পান করিয়া।

জী। কেন বিষ খাইল?

স। ভগবান তাহাকে প্রাণত্যাগ করিতে স্বপ্নাদেশ করিয়াছিলেন।

ভ। সে স্বপ্নাদেশ কি সন্তানের কার্যোদ্ধারের জন্যই হইয়াছিল?

স। মহেন্দ্রের কাছে সেইরূপই শুনিলাম। এক্ষণে সায়াহ্নকাল উপস্থিত, আমি সায়ংকৃত্যাদি সমাপনে চলিলাম। তৎপরে নূতন সন্তানদিগকে দীক্ষিত করিতে প্রবৃত্ত হইব।

ভ। সন্তানদিগকে? কেন, মহেন্দ্র ব্যতীত আর কেহ আপনার নিজ শিষ্য হইবার স্পর্ধা রাখে কি?

স। হাঁ, আর একটি নূতন লোক। পূর্বে আমি তাহাকে কখন দেখি নাই। আজি নূতন আমার কাছে আসিয়াছে। সে অতি তরুণবয়স্ক যুবা পুরুষ। আমি তাহার আকারেঙ্গিতে ও কথাবার্তায় অতিশয় প্রীত হইয়াছি। খাঁটি সোণা বলিয়া তাহাকে বোধ হইয়াছে। তাহাকে সন্তানের কার্য শিক্ষা করাইবার ভার জীবানন্দের প্রতি রহিল। কেন না, জীবানন্দ লোকের চিত্তাকর্ষণে বড় সুদক্ষ। আমি চলিলাম, তোমাদের প্রতি আমার একটি উপদেশ বাকি আছে। অতিশয় মন:সংযোগপূর্বক তাহা শ্রবণ কর।

তখন উভয়ে যুক্তকর হইয়া নিবেদন করিলেন, “আজ্ঞা করুন |”

সত্যানন্দ বলিলেন, “তোমরা দুই জনে যদি কোন অপরাধ করিয়া থাক, অথবা আমি ফিরিয়া আসিবার পূর্বে কর, তবে তাহার প্রায়শ্চিত্ত আমি না আসিলে করিও না। আমি আসিলে, প্রায়শ্চিত্ত অবশ্য কর্তব্য হইবে |”

এই বলিয়া সত্যানন্দ স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। ভবানন্দ এবং জীবানন্দ উভয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করিলেন।

ভবানন্দ বলিলেন, “তোমার উপর না কি?”

জী। বোধ হয়। ভগিনীর বাড়ীতে মহেন্দ্রের কন্যা রাখিতে গিয়াছিলাম।

ভ। তাতে দোষ কি, সেটা ত নিষিদ্ধ নহে, ব্রাহ্মণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া আসিয়াছ কি?

জী। বোধ হয় গুরুদেব তাই মনে করেন।

দ্বিতীয় খণ্ড
চতুর্থ পরিচ্ছেদ

সায়াহ্নকৃত্য সমাপনান্তে মহেন্দ্রকে ডাকিয়া সত্যানন্দ আদেশ করিলেন, “তোমার কন্যা জীবিত আছে |”

0 Shares