আনন্দমঠ

স। নহিলে কি জন্য আমি মহেন্দ্র সিংহকে এ মহাব্রত গ্রহণ করাইবার জন্য এত আকিঞ্চন করিয়াছি?

ভ। মহেন্দ্র কি ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন?

স। ব্রত গ্রহণ করে নাই, করিবে। আজ রাত্রে তাহাকে দীক্ষিত করিব।

জী। কই, মহেন্দ্র সিংহকে ব্রত গ্রহণ করাইবার জন্য কি আকিঞ্চন হইয়াছে, তাহা আমরা দেখি নাই। তাহার স্ত্রী কন্যার কি অবস্থা হইয়াছে, কোথায় তাহাদিগকে রাখিল? আমি আজ একটি কন্যা নদীতীরে পাইয়া আমার ভগিনীর নিকট রাখিয়া আসিয়াছি। সেই কন্যার নিকট একটি সুন্দরী স্ত্রীলোক মরিয়া পড়িয়া ছিল। সে ত ক মহেন্দ্রের স্ত্রী-কন্যা নয়? আমার তাই বোধ হইয়াছিল।

শান্তি কিছুই উত্তর করিল না। চুপ করিয়া রহিল। নিমাই দেখিল, শান্তি মনের কথা কিছু বলিবে না। শান্তি মনের কথা বলিতে ভালবাসে না, তাহা নিমাই জানিত। সুতরাং নিমাই চেষ্টা করিয়া অন্য কথা পাড়িল–বলিল, “দেখ দেখি বউ, কেমন মেয়েটি |”

শান্তি বলিল, “মেয়ে কোথা পেলি – তোর মেয়ে হলো কবে লো?”

নি। মরণ আর কি – তুমি যমের বাড়ী যাও – এ যে দাদার মেয়ে।

নিমাই শান্তিকে জ্বালাইবার জন্য এ কথাটা বলে নাই। “দাদার মেয়ে” অর্থাৎ দাদার কাছে যে মেয়েটি পাইয়াছি। শান্তি তাহা বুঝিল না ; মনে করিল, নিমাই বুঝি সূচ ফুটাইবার চেষ্টা করিতেছে। অতএব শান্তি উত্তর করিল, “আমি মেয়ের বাপের কথা জিজ্ঞাসা করি নাই – মার কথাই জিজ্ঞাসা করিয়াছি |”

নিমাই উচিত শাস্তি পাইয়া অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “কার মেয়ে কি জানি ভাই, দাদা কোথা থেকে কুড়িয়ে মুড়িয়ে এনেছে, তা জিজ্ঞাসা করবার ত অবসর হলো না! তা এখন মন্বন্তরের দিন, কত লোক ছেলেপিলে পথেঘাটে ফেলিয়া দিয়া যাইতেছে ; আমাদের কাছেই কত মেয়ে-ছেলে বেচিতে আনিয়াছিল, তা পরের মেয়ে-ছেলে কে আবার নেয়?” (আবার সেই চক্ষে সেইরূপ জল আসিল – নিমি চক্ষের জল মুছিয়া আবার বলিতে লাগিল) “মেয়েটি দিব্য সুন্দর, নাদুসনুদুস চাঁদপানা দেখে দাদার কাছে চেয়ে নিয়েছি |”

তার পর শান্তি অনেক্ষণ ধরিয়া নিমাইয়ের সঙ্গে নানাবিধ কথোপকথন করিল। পরে নিমাইয়ের স্বামী বাড়ী ফিরিয়া আসিল দেখিয়া শান্তি উঠিয়া আপনার কুটীরে গেল। কুটীরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া উননের ভিতর হইতে কতকগুলি ছাই বাহির করিয়া তুলিয়া রাখিল। অবশিষ্ট ছাইয়ের উপর নিজের জন্য যে ভাত রান্না ছিল, তাহা ফেলিয়া দিল। তার পরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া অনেক্ষণ চিন্তা করিয়া আপনা আপনি বলিল, “এত দিন যাহা মনে করিয়াছিলাম, আজি তাহা করিব। যে আশায় এত দিন করি নাই, তাহা সফল হইয়াছে। সফল কি নিষ্ফল – নিষ্ফল! এ জীবনই নিষ্ফল! যাহা সঙ্কল্প করিয়াছি, তাহা করিব। একবারেও যে প্রায়শ্চিত্ত, শতবারেও তাই |”

এই ভাবিয়া শান্তি ভাতগুলি উননে ফেলিয়া দিল। বন হইতে গাছের ফল পাড়িয়া আনিল। অন্নের পরিবর্তে তাহাই ভোজন করিল। তার পর তাহার যে ঢাকাই শাড়ির উপর নিমাইমণির চোট, তাহা বাহির করিয়া তাহার পাড় ছিঁড়িয়া ফেলিল। বস্ত্রের যেটুকু অবশিষ্ট রহিল, গেরিমাটিতে তাহা বেশ করিয়া রঙ করিল। বস্ত্র রঙ করিতে, শুকাইতে সন্ধ্যা হইল। সন্ধ্যা হইলে দ্বার রুদ্ধ করিয়া অতি চমৎকার ব্যাপারে শান্তি ব্যাপৃত হইল। মাথার রুক্ষ আগুল‍্ফলম্বিত কেশদামের কিয়দংশ কাঁচি দিয়া কাটিয়া পৃথক করিয়া রাখিল। অবশিষ্ট যাহা মাথায় রহিল, তাহা বিনাইয়া জটা তৈয়ারি করিল। রুক্ষ কেশ অপূর্ববিন্যাসবিশিষ্ট জটাভারে পরিণত হইল। তার পর সেই গৈরিক বসনখানি অর্ধেক ছিঁড়িয়া ধড়া করিয়া চারু অঙ্গে শান্তি পরিধান করিল। অবশিষ্ট অর্ধেকে হৃদয় আচ্ছাদিত করিল। ঘরে একখানি ক্ষুদ্র দর্পণ ছিল, বহুকালের পর শান্তি সেখানি বাহির করিল ; বাহির করিয়া দর্পণে আপনার বেশ আপনি দেখিল। দেখিয়া বলিল, “হায়! কি করিয়া কি করি! তখন দর্পণ ফেলিয়া দিয়া, যে চুলগুলি কাটা পড়িয়া ছিল, তাহা লইয়া শ্মশ্রুগুম্ফ রচিত করিল। কিন্তু পরিতে পারিল না। ভাবিল, “ছি! ছি! ছি! তাও কি হয়! সে দিনকাল কি আছে! তবে বুড়ো বেটাকে জব্দ করিবার জন্য, এ তুলিয়া রাখা ভাল |” এই ভাবিয়া শান্তি সেগুলি কাপড়ে বাঁধিয়া রাখিল। তার পর ঘরের ভিতর হইতে এক বৃহৎ হরিণচর্ম বাহির করিয়া, কণ্ঠের উপর গ্রন্থি দিয়া, কণ্ঠ হইতে জানু পর্যন্ত শরীর আবৃত করিল। এইরূপে সজ্জিত হইয়া সেই নূতন সন্ন্যাসী গৃহমধ্যে ধীরে ধীরে চারি দিক নিরীক্ষণ করিল। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হইলে শান্তি সেই সন্ন্যাসীবেশে দ্বারোদ্ঘাটন পূর্বক অন্ধকারে একাকিনী গভীর বনমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বনদেবীগণ সেই নিশীথে কাননমধ্যে অপূর্ব গীতধ্বনি শ্রবণ করিল।

দ্বিতীয় খণ্ড
পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সত্যানন্দ কথাবার্তা সমাপনান্তে মহেন্দ্রের সহিত সেই মঠস্থ দেবলয়াভ্যন্তরে, যেখানে সেই অপূর্ব শোভাময় প্রকাণ্ডাকার চতুর্ভুজ মূর্তি বিরাজিত, তথায় প্রবেশ করিলেন। সেখানে তখন অপূর্ব শোভা। রজত, স্বর্ণ ও রত্নে রঞ্জিত বহুবিধ প্রদীপে মন্দির আলোকিত হইয়াছে। রাশি রাশি পুষ্প স্তূপাকারে শোভা করিয়া মন্দির আমোদিত করিতেছিল। মন্দিরে আর একজন উপবেশন করিয়া মৃদু মৃদু “হরে মুরারে” শব্দ করিতেছিল। সত্যানন্দ মন্দিরমধ্যে প্রবেশ করিবামাত্র সে গাত্রোত্থান করিয়া প্রণাম করিল। ব্রহ্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি দীক্ষিত হইবে?”

সে বলিল, “আমাকে দয়া করুন।”

তখন তাহাকে ও মহেন্দ্রকে সম্বোধন করিয়া সত্যানন্দ বলিলেন, “তোমরা যথাবিধি স্নাত, সংযত এবং অনশন আছ ত?”

উত্তর। আছি।

স। তোমরা এই ভগবৎসাক্ষাৎ প্রতিজ্ঞা কর। সন্তানধর্মের নিয়মসকল পালন

করিবে?

উভয়ে। করিব।

স। যত দিন না মাতার উদ্ধার হয়, তত দিন গৃহধর্ম পরিত্যাগ করিবে?

উভ। করিব।

স। মাতা পিতা ত্যাগ করিবে?

উভ। করিব।

স। ভ্রাতা, ভগিনী?

উভ। ত্যাগ করিব।

স। দারাসুত?

উভ। ত্যাগ করিব।

স। আত্মীয় স্বজন? দাস দাসী?

উভ। সকলই ত্যাগ করিলাম।

0 Shares