আনন্দমঠ

শান্তি তখন গৃহান্তরে গেল। জিজ্ঞাসা করিল, “এটা কার ঘর?”

গোবর্ধন বলিল, “জীবানন্দ ঠাকুরের |”

শা। সে আবার কে? কৈ কেউ ত এখানে নেই।

গো। কোথায় গিয়াছেন, এখনি আসিবেন।

শা। এই ঘরটি সকলের ভাল।

গো। তা এ ঘরটা ত হবে না।

শা। কেন?

গো। জীবানন্দ ঠাকুর এখানে থাকেন।

শা। তিনি না হয় আর একটা ঘর খুঁজে নিন।

গো। তা কি হয়? যিনি এ ঘরে আছেন, তিনি কর্তা বললেই হয়, যা করেন তাই হয়।

শা। আচ্ছা তুমি যাও, আমি স্থান না পাই, গাছতলায় থাকিব।

এই বলিয়া গোবর্ধনকে বিদায় দিয়া শান্তি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। প্রবেশ করিয়া জীবানন্দের অধিকৃত কৃষ্ণাজিন বিস্তারণপূর্বক, প্রদীপটি উজ্জ্বল করিয়া লইয়া, জীবানন্দের একখানি পুথি লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলেন।

কিছুক্ষণ পরে জীবানন্দ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শান্তির পুরুষবেশ, তথাপি দেখিবামাত্র জীবানন্দ তাঁহাকে চিনিতে পারিলেন। বলিলেন, “এ কি এ? শান্তি?”

শান্তি ধীরে ধীরে পুথিখানি রাখিয়া, জীবানন্দের মুখপানে চাহিয়া বলিল, “শান্তি কে মহাশয়?”

জীবানন্দ অবাক – শেষ বলিলেন, “শান্তি কে মহাশয়? কেন, তুমি শান্তি নও?”

শান্তি ঘৃণার সহিত বলিল, “আমি নবীনানন্দ গোস্বামী |” এই কথা বলিয়া সে আবার পুথি পড়িতে মন দিল।

জীবানন্দ উচ্চহাস্য করিলেন, বলিলেন, “এ নূতন রঙ্গ বটে। তার পর নবীনানন্দ, এখানে কি মনে করে এসেছ?”

শান্তি বলিল, “ভদ্রলোকের মধ্যে এই রীতি প্রচলিত আছে যে, প্রথম আলাপে ‘আপনি’ ‘মহাশয়’ ইত্যাদি সম্বোধন করিতে হয়। আমিও আপনাকে অসম্মান করিয়া কথা কহিতেছি না,- তবে আপনি কেন আমাকে তুমি তুমি করিতেছেন?”

“যে আজ্ঞে” বলিয়া জীবানন্দ গলায় কাপড় দিয়া জোড়হাত করিয়া বলিল, “এক্ষণে বিনীতভাবে ভৃত্যের নিবেদন, কি জন্য ভরুইপুর হইতে, এ দীনভবনে মহাশয়ের শুভাগমন হইয়াছে, আজ্ঞা করুন |”

শান্তি অতি গম্ভীরভাবে বলিল, “ব্যঙ্গেরও প্রয়োজন দেখিতেছি না। ভরুইপুর আমি চিনি না। আমি সন্তানধর্ম গ্রহণ করিতে আসিয়া, আজ দীক্ষিত হইয়াছি |”

জী। আ সর্বনাশ! সত্য না কি?

শা। সর্বনাশ কেন? আপনিও দীক্ষিত।

জী। তুমি যে স্ত্রীলোক!

শা। সে কি? এমন কথা কোথা পাইলেন?

জী। আমার বিশ্বাস ছিল, আমার ব্রাহ্মণী স্ত্রীজাতীয়।

শা। ব্রাহ্মণী? আছে না কি?

জী। ছিল ত জানি।

শা। আপনার বিশ্বাস যে, আমি আপনার ব্রাহ্মণী?

জীবানন্দ আবার জোড়হাত করিয়া গলায় কাপড় দিয়া অতি বিনীতভাবে বলিল, “আজ্ঞে হাঁ মহাশয়!”

শা। যদি এমন হাসির কথা আপনার মনে উদয় হইয়া থাকে, তবে আপনার কর্তব্য কি বলুন দেখি?

জী। আপনার গাত্রাবরণখানি বলপূর্বক গ্রহণান্তর অধরসুধা পান।

শা। এ আপনার দুষ্টবুদ্ধি অথবা গঞ্জিকার প্রতি অসাধরণ ভক্তির পরিচয় মাত্র। আপনি দীক্ষাকালে শপথ করিয়াছেন যে, স্ত্রীলোকের সঙ্গে একাসনে উপবেশন করিবেন না। যদি আমাকে স্ত্রীলোক বলিয়া আপনার বিশ্বাস হইয়া থাকে – এমন সর্পে রজ্জু ভ্রম অনেকেরই হয় – তবে আপনার উচিত যে, পৃথক আসনে উপবেশন করেন। আমার সঙ্গে আপনার আলাপও অকর্তব্য।

0 Shares