আনন্দমঠ

এবার মহেন্দ্র বড় অপ্রতিভ হইলেন। বলিলেন, “কই, কিসে অবিশ্বাস করিলাম?”

ন। নহিলে আমার পিছু পিছু অন্ত:পুরে আসিয়া উপস্থিত কেন?

ম। কল্যাণীর সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল; তাই আসিয়াছি।

ন। তবে এখন যান। কল্যাণীর সঙ্গে আমারও কিছু কথা আছে। আপনি সরিয়া যান, আমি আগে কথা কই। আপনার ঘর-বাড়ী, আপনি সর্বদা আসিতে পারেন, আমি কষ্টে একবার আসিয়াছি।

মহেন্দ্র বোকা হইয়া রহিলেন। কিছুই বুঝিতে পারিতেছেন না। এ সকল কথা ত অপরাধীর কথাবার্তার মত নহে। কল্যাণীরও ভাব বিচিত্র। সেও ত অবিশ্বাসিনীর মত পলাইল না, ভীতা হইল না, লজ্জিতা নহে – কিছুই না, বরং মৃদু মৃদু হাসিতেছে। আর কল্যাণী – যে সেই বৃক্ষতলে অনায়াসে বিষ ভোজন করিয়াছিল – সে কি অপরাধিনী হইতে পারে? মহেন্দ্র এই সকল ভাবিতেছেন, এমত সময়ে অভাগিনী শান্তি, মহেন্দ্রের দুরবস্থা দেখিয়া ঈষৎ হাসিয়া কল্যাণীর প্রতি এক বিলোল কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল। সহসা তখন অন্ধকার ঘুচিল – মহেন্দ্র দেখিলেন, এ যে রমণীকটাক্ষ। সাহসে ভর করিয়া, নবীনানন্দের দাড়ি ধরিয়া মহেন্দ্র এক টান দিলেন – কৃত্রিম দাড়ি – গোঁপ খসিয়া আসিল। সেই সময়ে অবসর পাইয়া কল্যাণী বাঘছালের গ্রন্থি খুলিয়া ফেলিল – বাঘছালও খসিয়া পড়িল। ধরা পড়িয়া শান্তি অবনতমুখী হইয়া রহিল।

বেলা এক প্রহর হইল। সেখানে শান্তি জীবানন্দ আসিয়া দেখা দিলেন। কল্যাণী শান্তিকে বলিল, “আমরা আপনার কাছে বিনামূল্যে বিক্রীত। আমাদের কন্যাটির সন্ধান বলিয়া দিয়া এ উপকার সম্পূর্ণ করুন |”

শান্তি জীবানন্দের মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল, “আমি ঘুমাইব |” অষ্টপ্রহরের মধ্যে বসি নাই – দুই রাত্রি ঘুমাই নাই – আমি যাই পুরুষ!”

কল্যাণী ঈষৎ হাসিল। জীবানন্দ মহেন্দ্রের মুখপানে চাহিয়া বলিলেন, “সে ভার আমার উপর রহিল। আপনারা পদচিহ্নে গমন করুন – সেইখানে কন্যাকে পাইবেন |”

জীবানন্দ ভরুইপুরে নিমাইয়ের নিকট হইতে মেয়ে আনিতে গেলেন – কাজটা বড় সহজ বোধ হইল না।

তখন নিমাই প্রথমে ঢোক গিলিল, একবার এদিক ওদিক চাহিল। তার পর একবার তার ঠোঁট নাক ফুলিল। তার পর সে কাঁদিয়া ফেলিল। তার পর বলিল, “আমি মেয়ে দিব না |”

নিমাই, গোল হাতখানির উল্টাপিঠ চোখে দিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া চক্ষু মুছিলে পর জীবানন্দ বলিলেন, “তা দিদি কাঁদ কেন, এমন দূরও ত নয় – তাদের বাড়ী তুমি না হয় গেলে, মধ্যে মধ্যে দেখে এলে |”

নিমাই ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল, “তা তোমাদের মেয়ে তোমরা নিয়ে যাও না কেন? আমার কি?” নিমাই এই বলিয়া সুকুমারীকে আনিয়া রাগ করিয়া দুম করিয়া জীবানন্দের কাছে ফেলিয়া দিয়া পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসিল। সুতরাং জীবানন্দ তখন আর কিছু না বলিয়া এদিক ওদিক বাজে কথা কহিতে লাগিলেন। কিন্তু নিমাইয়ের রাগ পড়িল না। নিমাই উঠিয়া গিয়া সুকুমারীর কাপড়ের বোচকা, অলঙ্কারের বাক্স, চুলের দড়ি, খেলার পুতুল ঝুপঝাপ করিয়া আনিয়া জীবানন্দের সম্মুখে ফেলিয়া দিতে লাগিল। সুকুমারী সে সকল আপনি গুছাইতে লাগিল। সে নিমাইকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “হাঁ মা – কোথায় যাব মা?” নিমাইয়ের আর সহ্য হইল না। নিমাই তখন সুকুকে কোলে লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে চলিয়া গেল।

চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম পরিচ্ছেদ

তখন দুই জনে কাণে কাণে কি পরামর্শ করিলেন। পরামর্শ করিয়া জীবানন্দ এক বনে লুকাইলেন। শান্তি আর এক বনে প্রবেশ করিয়া এক অদ্ভুত রহস্যে প্রবৃত্ত হইল।

শান্তি মরিতে যাইতেছিল, কিন্তু মৃত্যুকালে স্ত্রীবেশ ধরিবে, ইহা স্থির করিয়াছিল। তাহার এ পুরুষবেশ জুয়াচুরি, মহেন্দ্র বলিয়াছে। জুয়াচুরি করিতে করিতে মরা হইবে না। সুতরাং ঝাঁপি টেপারিটি সঙ্গে আনিয়াছিলেন। তাহাতে তাহার সজ্জাসকল থাকিত। এখন নবীনানন্দ ঝাঁপি টেপারি খুলিয়া বেশপরিবর্তনে প্রবৃত্ত হইল।

চিকণ রকম রসকলির উপর খয়েরের টিপ কাটিয়া তৎকালপ্রচলিত ফুরফুরে কোঁকড়া কোঁকড়া কতকগুলি ঝাপটার গোছায় চাঁদমুখখানি ঢাকিয়া, শান্তি একটি সারঙ্গ হস্তে বৈষ্ণবীবেশে ইংরেজ – শিবিরে দর্শন দিল। দেখিয়া ভ্রমরকৃষ্ণশ্মশ্রুযুক্ত সিপাহীরা বড় মাতিয়া গেল। কেহ টপ্পা, কেহ গজল, কেহ শ্যামাবিষয়, কেহ ফরমাস করিয়া শুনিল। কেহ চাল দিল, কেহ ডাল দিল, কেহ মিষ্টি দিল, কেহ পয়সা দিল, কেহ সিকি দিল। বৈষ্ণবী তখন শিবিরের অবস্থা স্বচক্ষে সবিশেষ দেখিয়া চলিয়া যায় ; সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করিল, “আবার কবে আসিবে?” বৈষ্ণবী বলিল, “তা জানি না, আমার বাড়ী ঢের দূর।” সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করিল, “কত দূর?” বৈষ্ণবী বলিল, “আমার বাড়ী পদচিহ্নে।” এখন সেই দিন মেজর সাহেব পদচিহ্নের কিছু খবর লইতেছিলেন। একজন সিপাহী তাহা জানিত। বৈষ্ণবীকে ডাকিয়া কাপ্তেন সাহেবের কাছে লইয়া গেল। কাপ্তেন সাহেব তাহাকে মেজর সাহেবের কাছে লইয়া গেল। মেজর সাহেবের কাছে গিয়া বৈষ্ণবী মধুর হাসি হাসিয়া, মর্মভেদী কটাক্ষে সাহেবের মাথা ঘুরাইয়া দিয়া, খঞ্জনীতে আঘাত করিয়া গান ধরিল –

“ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালম্ |”

সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাড় বাড়ী কোঠা বিবি?”

বৈষ্ণবী বলিল, “আমি বিবি নাই, বৈষ্ণবী। বাড়ী পদচিহ্নে |”

সাহেব। Well that is Padsin – Padsin is it? হুঁয়া একটো গর হ্যায়?

বৈষ্ণবী বলিল, “ঘর? – কত ঘর আছে |”

সা। গর নেই,-গর নেই,- গর, – গর-

শা। সাহেব, তোমার মনের কথা বুঝেছি। গড়?

সা। ইয়েস ইয়েস, গর! গর! – হ্যায়?

শা। গড় আছে। ভারি কেল্লা।

সা। কেট্টে আডমি?

শা। গড়ে কত লোক থাকে? বিশ পঞ্চাশ হাজার।

সা। নন্সেন্স। একটো কেল্লেমে ডো চার হাজার রহে শক্তা। হুঁয়া পর আবি হ্যায়? ইয়া নিকেল গিয়া?

শা। আবার নেকলাবে কোথা?

সা। মেলামে – টোম কব আয়া হ্যায় হুঁয়াসে?

শা। কাল এসেছি সায়েব।

সা। ও লোক আজ নিকেল গিয়া হোগা।

শান্তি মনে মনে ভাবিতেছিল যে, “তোমার বাপের শ্রাদ্ধের চাল যদি আমি না চড়াই, তবে আমার রসকলি কাটাই বৃথা। কতক্ষণে শিয়ালে তোমার মুণ্ড খাবে আমি দেখব।” প্রকাশ্যে বলিল, “তা সাহেব, হতে পারে, আজ বেরিয়ে গেলে যেতে পারে। অত খবর আমি জানি না, বৈষ্ণবী মানুষ, গান গেয়ে ভিক্ষা শিক্ষা করে খাই, অত খবর রাখি নে। বকে বকে গলা শুকিয়ে উঠ‍ল, পয়সাটা সিকেটা দাও – উঠে চলে যাই। আর ভাল করে বখশিশ দাও ত না হয় পরশু এসে বলে যাব |”

0 Shares