আনন্দমঠ

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে।”

শেষে কল্যাণীর মাথার উপর বনস্থলী প্রতিধ্বনিত করিয়া গীত বাজিল, –

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে।”

কল্যাণী তখন নয়োনোন্মীলন করিলেন। সেই অর্দ্ধস্ফুট বনান্ধকারমিশ্রিত চন্দ্ররশ্মিতে দেখিলেন, সম্মুখে সেই শুভ্রশরীর, শুভ্রকেশ, শুভ্রশ্মশ্রু, শুভ্রবসন ঋষিমূর্ত্তি! অন্যমনে তথাভূতচেতনে কল্যাণী মনে করিলেন, প্রণাম করিব, কিন্তু প্রণাম করিতে পারিলেন না, মাথা নোয়াইতে একেবারে চেতনাশূন্য হইয়া ভূতলশায়িনী হইলেন।

প্রথম খণ্ড
পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সেই বনমধ্যে এক প্রকাণ্ড ভূমিখণ্ডে ভগ্নশিলাখণ্ডসকলে পরিবেষ্টিত হইয়া একটি বড় মঠ আছে। পুরাণতত্ত্ববিদেরা দেখিলে বলিতে পারিতেন, ইহা পূর্ব্বকালে বৌদ্ধদিগের বিহার ছিল – তার পরে হিন্দুর মঠ হইয়াছে। অট্টালিকাশ্রেণী দ্বিতল – মধ্যে বহুবিধ দেবমন্দির এবং সম্মুখে নাটমন্দির। সকলই প্রায় প্রাচীরে বেষ্টিত আর বহিঃস্থিত বন্য বৃক্ষশ্রেণী দ্বারা এরূপ আচ্ছন্ন যে, দিনমানে অনতিদূর হইতেও কেহ বুঝিতে পারে না যে, এখানে কোঠা আছে। অট্টালিকাসকল অনেক স্থানেই ভগ্ন, কিন্তু দিনমানে দেখা যায় যে, সকল স্থান সম্প্রতি মেরামত হইয়াছে। দেখিলেই জানা যায় যে, এই গভীর দুর্ভেদ্য অরণ্যমধ্যে মনুষ্য বাস করে। এই মঠের একটি কুঠারীমধ্যে একটা বড় কুঁদো জ্বলিতেছিল, তাহার ভিতর কল্যাণীর প্রথম চৈতন্য হইলে আবার দেখিলেন, সম্মুখে সেই শুভ্রশরীর, শুভ্রবসন, মহাপুরুষ। কল্যাণী বিস্মিতলোচনে আবার চাহিতে লাগিলেন, এখনও স্মৃতি পুনরাগমন করিতেছিল না। তখন মহাপুরুষ বলিলেন, “মা, এ দেবতার ঠাঁই, শঙ্কা করিও না। একটু দুধ আছে – তুমি খাও, তার পর তোমার সহিত কথা কহিব।”

কল্যাণী প্রথমে কিছুই বুঝিতে পারিলেন না, তার পর ক্রমে ক্রমে মনের কিছু স্থৈর্য্য হইলে, গলায় আঁচল দিয়া সেই মহাত্মাকে একটি প্রণাম করিলেন। তিনি সুমঙ্গল আশীর্ব্বাদ করিয়া, গৃহান্তর হইতে একটি সুগন্ধ মৃৎপাত্র বাহির করিয়া, সেই জ্বলন্ত অগ্নিতে দুগ্ধ উত্তপ্ত করিলেন। দুগ্ধ তপ্ত হইলে কল্যাণীকে তাহা দিয়া বলিলেন, “মা, কন্যাকে কিছু খাওয়াও, আপনি কিছু খাও, তাহার পর কথা কহিবে।” কল্যাণী হৃষ্টচিত্তে কন্যাকে দুগ্ধপান করাইতে আরম্ভ করিলেন। তখন সেই পুরুষ “আমি যতক্ষণ না আসি, কোন চিন্তা করিও না” বলিয়া মন্দির হইতে বাহির হইয়া গেলেন। বাহির হইতে কিয়ৎকাল পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন যে, কল্যাণী কন্যাকে দুগ্ধ খাওয়ান সমাপন করিয়াছেন বটে, কিন্তু আপনি কিছু খান নাই, দুগ্ধ যেমন ছিল, প্রায় তেমনই আছে, অতি অল্পই ব্যয় হইয়াছে। সেই পুরুষ তখন বলিলেন, “মা তুমি দুধ খাও নাই, আমি আবার যাইতেছি, তুমি দুধ না খাইলে ফিরিব না।”

সেই ঋষিতুল্য পুরুষ এই বলিয়া বাহিরে যাইতেছিলেন, কল্যাণী আবার তাঁহাকে প্রণাম করিয়া জোড়হাত করিলেন –

বনবাসী বলিলেন, “কি বলিবে?”

তখন কল্যাণী বলিলেন, “আমাকে দুধ খাইতে আজ্ঞা করিবেন না – কোন বাধা আছে। আমি খাইব না।”

তখন বনবাসী অতি করণস্বরে বলিলেন, “কি বাধা আছে আমাকে বল – আমি বনবাসী ব্রহ্মচারী, তুমি আমার কন্যা, তোমার এমন কি কথা আছে যে, আমাকে বলিবে না? আমি যখন বন হইতে তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় তুলিয়া আনি, তৎকালে তোমাকে অত্যন্ত ক্ষুৎপিপাসাপীড়িতা বোধ হইয়াছিল, তুমি না খাইলে বাঁচিবে কি প্রকারে?”

কল্যাণী তখন গলদশ্রুলোচনে বলিলেন, “আপনি দেবতা, আপনাকে বলিব – আমার স্বামী এ পর্য্যন্ত অভুক্ত আছেন, তাঁহার সাক্ষাৎ না পাইলে, কিম্বা তাঁহার ভোজনসংবাদ না শুনিলে, আমি কি প্রকারে খাইব?”

ব্রহ্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার স্বামী কোথায়?”

কল্যাণী বলিলেন, “তাহা আমি জানি না – তিনি দুধের সন্ধানে বাহির হইলে পর দস্যুরা আমাকে চুরি করিয়া লইয়া আসিয়াছে।” তখন ব্রহ্মচারী একটি একটি করিয়া প্রশ্ন করিয়া, কল্যাণী এবং তাঁহার স্বামীর বৃত্তান্ত সমুদয় অবগত হইলেন। কল্যাণী স্বামীর নাম বলিলেন না, বলিতে পারেন না, কিন্তু আর আর পরিচয়ের পর ব্রহ্মচারী বুঝিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমিই মহেন্দ্রের পত্নী?” কল্যাণী নিরুত্তর হইয়া যে অগ্নিতে দুগ্ধ তপ্ত হইয়াছিল, অবনতমুখে তাহাতে কাষ্ঠপ্রদান করিলেন। তখন ব্রহ্মচারী বলিলেন, “তুমি আমার বাক্য পালন কর, দুগ্ধ পান কর, আমি তোমার স্বামীর সংবাদ আনিতেছি। তুমি দুধ না খাইলে আমি যাইব না।” কল্যাণী বলিলেন, “এখানে জল আছে কি?” ব্রহ্মচারী জলকলস দেখাইয়া দিলেন। কল্যাণী অঞ্জলি পাতিলেন, ব্রহ্মচারী অঞ্জলি পুরিয়া জল ঢালিয়া দিলেন। কল্যাণী সেই জলাঞ্জলি ব্রহ্মচারীর পদমূলে লইয়া গিয়া বলিলেন, “আপনি ইহাতে পদরেণু দিন।” ব্রহ্মচারী অঙ্গুষ্ঠের দ্বারা জল স্পর্শ করিলে কল্যাণী সেই জলাঞ্জলি পান করিলেন এবং বলিলেন, “আমি অমৃত পান করিয়াছি – আর কিছু খাইতে বলিবেন না – স্বামীর সংবাদ না পাইলে আর কিছু খাইব না।” ব্রহ্মচারী তখন বলিলেন, “তুমি নির্ভয়ে এই দেউলমধ্যে অবস্থান কর, আমি তোমার স্বামীর সন্ধানে চলিলাম।”

প্রথম খণ্ড
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

রাত্রি অনেক। চাঁদ মাথার উপর। পূর্ণচন্দ্র নহে, আলো তত প্রখর নহে। এক অতি বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপর সেই অন্ধকারের ছায়াবিশিষ্ট অস্পষ্ট আলো পড়িয়াছে। সে আলোতে মাঠের এপার ওপার দেখা যাইতেছে না। মাঠে কি আছে, কে আছে, দেখা যাইতেছে না। মাঠ যেন অনন্ত, জনশূন্য, ভয়ের আবাসস্থান বলিয়া বোধ হইতেছে। সেই মাঠ দিয়া মুরশিদাবাদ ও কলিকাতা যাইবার রাস্তা। রাস্তার ধারে একটি ক্ষুদ্র পাহাড়। পাহাড়ের উপর অনেক আম্রাদি বৃক্ষ। গাছের মাথাসকল চাঁদের আলোতে উজ্জ্বল হইয়া সর সর করিয়া কাঁপিতেছে। তাহার ছায়া কালো পাথরের উপর কালো হইয়া তর তর করিয়া কাঁপিতেছে। ব্রহ্মচারী সেই পাহাড়ের উপর উঠিয়া শিখরে দাঁড়াইয়া স্তব্ধ হইয়া শুনিতে লাগিলেন – কি শুনিতে লাগিলেন, বলিতে পারি না। সেই অনন্ততুল্য প্রান্তরেও কোন শব্দ নাই – কেবল বৃক্ষাদির মর্ম্মর শব্দ। এক স্থানে পাহাড়ের নিকট বড় জঙ্গল। উপরে পাহাড়, নীচে রাজপথ, মধ্যে সেই জঙ্গল। সেখানে কি শব্দ হইল বলিতে পারি না – ব্রহ্মচারী সেই দিকে গেলেন। নিবিড় জঙ্গলমধ্যে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, সেই বনমধ্যে বৃক্ষরাজির অন্ধকার তলদেশে সারি সারি গাছের নীচে মানুষ বসিয়া আছে। মানুষসকল দীর্ঘাকার, কৃষ্ণকায় সশস্ত্র, বিটপবিচ্ছেদে নিপতিত জ্যোৎস্নায় তাহাদের মার্জ্জিত আয়ুধসকল জ্বলিতেছে। এমন দুই শত লোক বসিয়া আছে – একটি কথাও কহিতেছে না। ব্রহ্মচারী ধীরে ধীরে তাহাদিগের মধ্যে গিয়া কি একটা ইঙ্গিত করিলেন – কেহ উঠিল না, কেহ কথা কহিল না, কেহ কোন শব্দ করিল না। তিনি সকলের সম্মুখ দিয়া সকলকে দেখিতে দেখিতে গেলেন, অন্ধকারে মুখপানে চাহিয়া নিরীক্ষণ করিতে করিতে গেলেন; যেন কাহাকে খুঁজিতেছেন, পাইতেছেন না। খুঁজিয়া খুঁজিয়া এক জনকে চিনিয়া তাহার অঙ্গ স্পর্শ করিয়া ইঙ্গিত করিলেন। ইঙ্গিত করিতেই সে উঠিল। ব্রহ্মচারী তাহাকে লইয়া দূরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। এই ব্যক্তি যুবা পুরুষ – ঘনকৃষ্ণ গুম্ফশ্মশ্রুতে তাহার চন্দ্রবদন আবৃত – সে বলিষ্ঠকায়, অতি সুন্দর পুরুষ। সে গৈরিক বসন পরিধান করিয়াছে – সর্ব্বাঙ্গে চন্দনশোভা। ব্রহ্মচারী তাহাকে বলিলেন, “ভবানন্দ, মহেন্দ্র সিংহের কোন সংবাদ রাখ?”

0 Shares