আনন্দমঠ

জী। বল “হরে মুরারে |”

কানন প্রান্তর সহস্র সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হইল, “হরে মুরারে!

জী। টিলার ওপিঠে শত্রু। আজ এই স্তূপশিখরে, এই নীলাম্বরী যামিনী সাক্ষাৎকার, সন্তানেরা রণ করিবে। দ্রুত আইস, যে আগে শিখরে উঠিবে, সেই জিতিবে। বল, “বন্দে মাতরম্ |”

তখন কানন প্রান্তর ধ্বনিত করিয়া গীতধ্বনি উঠিল, “বন্দে মাতরম্”। ধীরে ধীরে সন্তানসেনা পর্বতশিখর আরোহণ করিতে লাগিল, কিন্তু তাহারা সহসা সভয়ে দেখিল, মহেন্দ্র সিংহ অতি দ্রুতবেগে স্তূপ হইতে অবতরণ করিতে করিতে তূর্যনিনাদ করিতেছেন। দেখিতে দেখিতে শিখরদেশে নীলাকাশপটে কামানশ্রেণী সহিত, ইংরেজের গোলন্দাজ সেনা শোভিত হইয়াছে। উচ্চৈ:স্বরে বৈষ্ণবী সেনা গায়িল,-

“তুমি বিদ্যা তুমি ভক্তি,

তুমি মা বাহুতে শক্তি

ত্বং হি প্রাণা: শরীরে |”

কিন্তু ইংরেজের কামানের গুড়ুম্ গুড়ুম্ গুম্ শব্দে সে মহাগীতিশব্দ ভাসিয়া গেল। শত শত সন্তান হত আহত হইয়া, অশ্ব অস্ত্র সহিত, টিলার উপর শুইল। আবার গুড়ুম্ গুম্, দধীচির অস্থিকে ব্যঙ্গ করিয়া, সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গকে তুচ্ছ করিয়া, ইংরেজের বজ্র গড়াইতে লাগিল। চাষার কর্তনীসম্মুখে সুপক্ক ধান্যের ন্যায় সন্তানসেনা খণ্ডবিখণ্ড হইয়া ধরাশায়ী হইতে লাগিল। বৃথায় জীবানন্দ, বৃথায় মহেন্দ্র যত্ন করিতে লাগিলেন। পতনশীল শিলারাশির ন্যায় সন্তানসেনা টিলা হইতে ফিরিতে লাগিল। কে কোথায় পলায় ঠিকানা নাই। তখন একেবারে সকলের বিনাশসাধনের জন্য “হুররে ! হুররে!” শব্দ করিতে করিতে গোরার পল্টন টিলা হইতে নামিল। সঙ্গীন উঁচু করিয়া অতি দ্রুতবেগে, পর্বতবিমুক্ত বিশালতটিনীপ্রপাতবৎ দুর্দমনীয় অলঙ্ঘ্য অজেয় ব্রিটিশসেনা, পলায়নপর সন্তানসেনার পশ্চাৎ ধাবিত হইল। জীবানন্দ একবার মাত্র মহেন্দ্রের সাক্ষাৎ পাইয়া বলিলেন, “আজ শেষ। এস এইখানে মরি |”

মহেন্দ্র বলিলেন, “মরিলে যদি রণজয় হইত, তবে মরিতাম। বৃথা মৃত্যু বীরের ধর্ম নহে |”

জী। “আমি বৃথাই মরিব। তবু যুদ্ধে মরিব। তখন পাছু ফিরিয়া উচ্চৈ:স্বরে জীবানন্দ ডাকিলেন, “কে হরিনাম করিতে করিতে মরিতে চাও, আমার সঙ্গে আইস |”

অনেকে অগ্রসর হইল। জীবানন্দ বলিলেন, “অমন নহে। হরিসাক্ষাৎ শপথ কর, জীবন্তে ফিরিবে না |” যাহারা আগু হইয়াছিল, তাহারা পিছাইল। জীবানন্দ বলিলেন, “কেহ আসিবে না? তবে আমি একা চলিলাম |”

জীবানন্দ অশ্বপৃষ্ঠে উঁচু হইয়া বহুদূর পশ্চাৎস্থিত মহেন্দ্রকে বলিলেন, “ভাই! নবীনান্দকে বলিও, আমি চলিলাম। লোকান্তরে সাক্ষাৎ হইবে |”

এই বলিয়া সেই বীরপুরুষ লৌহবৃষ্টিমধ্যে বেগে অশ্বচালন করিলেন। বাম হস্তে বল্লম, দক্ষিনে বন্দুক, মুখে “হরে মুরারে! হরে মুরারে! হরে মুরারে!” যুদ্ধের সম্ভাবনা নাই, এ সাহসে কোন ফল নাই – তথাপি “হরে মুরারে! হরে মুরারে!” গায়িতে গায়িতে জীবানন্দ শত্রুব্যুহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।

পলায়নপর সন্তানদিগকে মহেন্দ্র ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ, একবার তোমরা ফিরিয়া জীবানন্দ গোঁসাইকে দেখ। দেখিলে মরিবে না |”

ফিরিয়া কতকগুলি সন্তান জীবানন্দের অমানুষী কীর্তি দেখিল। প্রথমে বিস্মিত হইল, তার পর বলিল, “জীবানন্দ মরিতে জানে, আমরা জানি না? চল, জীবানন্দের সঙ্গে আমরাও বৈকুণ্ঠে যাই |”

এই কথা শুনিয়া, কতকগুলি সন্তান ফিরিল। তাহাদের দেখাদেখি আর কতকগুলি ফিরিল, তাহাদের দেখাদেখি, আরও কতকগুলি ফিরিল। বড় একটা গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। জীবানন্দ শত্রুব্যুহে প্রবেশ করিয়াছিলেন ; সন্তানেরা আর কেহই তাঁহাকে দেখিতে পাইল না।

এদিকে সমস্ত রণক্ষেত্র হইতে সন্তানগণ দেখিতে পাইল যে, কতক সন্তানেরা আবার ফিরিতেছে। সকলেই মনে করিল, সন্তানের জয় হইয়াছে ; সন্তান শত্রুকে তাড়াইয়া যাইতেছে। তখন সমস্ত সন্তানসৈন্য “মার মার” শব্দে ফিরিয়া ইংরেজসৈন্যের উপর ধাবিত হইল।

এদিকে ইংরেজসেনার মধ্যে একটা ভারি হুলস্থূল পড়িয়া গেল। সিপাহীরা যুদ্ধে আর যত্ন না করিয়া দুই পাশ দিয়া পলাইতেছে ; গোরারাও ফিরিয়া সঙ্গীন খাড়া করিয়া শিবিরাভিমুখে ধাবমান হইতেছে। ইতস্তত: নিরীক্ষণ করিয়া মহেন্দ্র দেখিলেন, টিলার শিখরে অসংখ্য সন্তানসেনা দেখা যাইতেছে। তাহারা বীরদর্পে অবতরণ করিয়া ইংরেজসেনা আক্রমণ করিতেছে। তখন ডাকিয়া সন্তানগণকে বলিলেন, “সন্তানগণ! ঐ দেখ, শিখরে প্রভু সত্যানন্দ গোস্বামীর ধ্বজা দেখা যাইতেছে। আজ স্বয়ং মুরারি মধুকৈটভনিসূদন কংশকেশি-বিনাশন রণে অবতীর্ণ, লক্ষ সন্তান স্তূপপৃষ্ঠে। বল হরে মুরারে! হরে মুরারে! উঠ! মুসলমানের বুকে পিঠে চাপিয়া মার! লক্ষ সন্তান টিলার পিঠে |”

তখন হরে মুরারের ভীষণ ধ্বনিতে কানন প্রান্তর মথিত হইতে লাগিল। সকল সন্তান মাভৈ: মাভৈ: রবে ললিততালধ্বনিসম্বলিত অস্ত্রের ঝঞ্ঝনায় সর্বজীব বিমোহিত করিল। তেজে মহেন্দ্রের বাহিনী উপরে আরোহণ করিতে লাগিল। শিলাপ্রতিঘাতপ্রতিপ্রেরিত নির্ঝরিণীবৎ রাজসেনা বিলোড়িত, স্তম্ভিত, ভীত হইল, সেই সময়ে পঞ্চবিংশতি সহস্র সন্তানসেনা লইয়া সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী শিখর হইতে, সমুদ্রপ্রপাতবৎ তাহাদের উপর বিক্ষিপ্ত হইলেন। তুমুল যুদ্ধ হইল।

যেমন দুই খণ্ড প্রকাণ্ড প্রস্তরের সঙ্ঘর্ষে ক্ষুদ্র মক্ষিকা নিষ্পেষিত হইয়া যায়, তেমনি দুই সন্তানসেনা সঙ্ঘর্ষে সেই বিশাল রাজসৈন্য নিষ্পেষিত হইল।

ওয়ারেন হেষ্টিংসের কাছে সংবাদ লইয়া যায়, এমন লোক রহিল না।

চতুর্থ খণ্ড
সপ্তম পরিচ্ছেদ

পূর্ণিমার রাত্রি! –সেই ভীষণ রণক্ষেত্র এখন স্থির। সেই ঘোড়ার দড়বড়ি, বন্দুকের কড়কড়ি, কামানের গুম্ গুম্ – সর্বব্যাপী ধূম, আর কিছুই নাই। কেহ হুর্‌রে বলিতেছে না – কেহ হরিধ্বনি করিতেছে না। শব্দ করিতেছে – কেবল শৃগাল, কুক্কুর, গৃধিনী। সর্বোপরি আহত ব্যক্তির ক্ষণিক আর্তনাদ। কেহ ছিন্নহস্ত, কেহ ভগ্নমস্তক, কাহারও পা ভাঙ্গিয়াছে, কাহারও পঞ্জর বিদ্ধ হইয়াছে, কেহ ঘোড়ার নীচে পড়িয়াছে। কেহ ডাকিতেছে “মা!” কেহ ডাকিতেছে “বাপ!” কেহ চায় জল, কাহারও কামনা মৃত্যু। বাঙ্গালী, হিন্দুস্থানী, ইংরেজ, মুসলমান, একত্র জড়াজড়ি ; জীবন্তে-মৃতে, মনুষ্যে-অশ্বে, মিশামিশি ঠেসাঠেসি হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। সেই মাঘ মাসের পূর্ণিমার রাত্রে, দারুণ শীতে, উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে রণভূমি অতি ভয়ঙ্কর দেখাইতেছিল। সেখানে আসিতে কাহারও সাহস হয় না।

0 Shares