আনন্দমঠ

অবলা কেন মা এত বলে |”

মহে। কিন্তু দেখিতেছি তুমি একা।

ভ। কেন, এখনি ত দুশ লোক দেখিয়াছ।

ম। তাহারা কি সকলে সন্তান?

ভ। সকলেই সন্তান।

ম। আর কত আছে?

ভ। এমন হাজার হাজার, ক্রমে আরও হবে।

ম। না হয় দশ বিশ হাজার হল, তাতে কি মুসলমানকে রাজ্যচ্যুত করিতে পারিবে?

ভ। পলাশীতে ইংরেজের কজন ফৌজ ছিল?

ম। ইংরেজ আর বাঙালিতে?

ভ। নয় কিসে? গায়ের জোরে কত হয় – গায়ে জিয়াদা জোর থাকিলে গোলা কি জিয়াদা ছোটে?

ম। তবে ইংরেজ মুসলমানে এত তফাৎ কেন?

ভ। ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলেও পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায় – শরবৎ খুঁজিয়া বেড়ায় – ধর, তার পর, ইংরেজদের জিদ আছে–যা ধরে, তা করে, মুসলমানের এলাকাড়ি। টাকার জন্য প্রাণ দেওয়া, তাও সিপাহীরা মাহিয়ানা পায় না। তার পর শেষ কথা সাহস – কামানের গোলা এক জায়গায় বই দশ জায়গায় পড়বে না – সুতরাং একটা গোলা দেখে দুই শ জন পলাইবার দরকার নাই। কিন্তু একটা গোলা দেখিলে মুসলমানের গোষ্ঠীশুদ্ধ পলায় – আর গোষ্ঠীশুদ্ধ গোলা দেখিলে ত একটা ইংরেজ পলায় না।

ম। তোমাদের এসব গুণ আছে?

ভ। না। কিন্তু গুণ গাছ থেকে পড়ে না। অভ্যাস করিতে হয়।

ম। তোমরা কি অভ্যাস কর?

ভ। দেখিতেছ না আমরা সন্ন্যাসী? আমাদের সন্ন্যাস এই অভ্যাসের জন্য। কার্য উদ্ধার হইলে – অভ্যাস সম্পূর্ণ হইলে – আমরা আবার গৃহী হইব। আমাদেরও স্ত্রী কন্যা আছে।

ম। তোমরা সে সকল ত্যাগ করিয়াছ – মায়া কাটাইতে পারিয়াছ?

ভ। সন্তানকে মিথ্যা কথা কহিতে নাই – তোমার কাছে মিথ্যা বড়াই করিব না। মায়া কাটাইতে পারে কে? যে বলে, আমি মায়া কাটাইয়াছি, হয় তার মায়া কখন ছিল না বা সে মিছা বড়াই করে। আমরা মায়া কাটাই না – আমরা ব্রত রক্ষা করি। তুমি সন্তান হইবে?

ম। আমার স্ত্রী-কন্যার সংবাদ না পাইলে আমি কিছু বলিতে পারি না।

ভ। চল, তবে তোমার স্ত্রীকন্যাকে দেখিবে চল।

এই বলিয়া দুই জনে চলিল; ভবানন্দ আবার “বন্দে মাতরম্” গায়িতে লাগিল। মহেন্দ্রের গলা ভাল ছিল, সঙ্গীতে একটু বিদ্যা ও অনুরাগ ছিল – সুতরাং সঙ্গে গায়িল – দেখিল যে, গায়িতে গায়িতে চক্ষে জল আইসে। তখন মহেন্দ্র বলিল, “যদি স্ত্রী-কন্যা ত্যাগ না করিতে হয়, তবে এ ব্রত আমাকে গ্রহণ করাও”।

ভ। এ ব্রত যে গ্রহণ করে, সে স্ত্রী-কন্যা পরিত্যাগ করে। তুমি যদি এ ব্রত গ্রহণ কর, তবে স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হইবে না। তাহাদিগের রক্ষা হেতু উপযুক্ত বন্দোবস্ত করা যাইবে, কিন্তু ব্রতের সফলতা পর্যন্ত তাহাদিগের মুখদর্শন নিষেধ।

ম। আমি এ ব্রত গ্রহণ করিব না।

প্রথম খণ্ড
একাদশ পরিচ্ছেদ

রাত্রি প্রভাত হইয়াছে। সেই জনহীন কানন, – এতক্ষণ অন্ধকার, শব্দহীন ছিল – এখন আলোকময় – পক্ষিকুজনশব্দিত হইয়া আনন্দময় হইল। সেই আনন্দময় প্রভাতে আনন্দময় কাননে, “আনন্দমঠে”, সত্যানন্দ ঠাকুর হরিণচর্মে বসিয়া সন্ধ্যাহ্নিক করিতেছেন। কাছে বসিয়া জীবানন্দ। এমন সময়ে ভবানন্দ মহেন্দ্র সিংহকে সঙ্গে লইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। ব্রহ্মচারী বিনাবাক্যব্যয়ে সন্ধ্যাহ্নিক করিতে লাগিলেন, কেহ কোন কথা কহিতে সাহস করিল না। পরে সন্ধ্যাহ্নিক সমাপন হইলে, ভবানন্দ, জীবানন্দ উভয়ে তাঁহাকে প্রণাম করিলেন এবং পদধূলি গ্রহণপূর্বক বিনীতভাবে উপবেশন করিলেন। তখন সত্যানন্দ ভবানন্দকে ইঙ্গিত করিয়া বাহিরে লইয়া গেলেন। কি কথোপকথন হইল, তাহা আমরা জানি না। তাহার পর উভয়ে মন্দিরে প্রত্যাবর্তন করিলে ; ব্রহ্মচারী সকরুণ সহাস্য বদনে মহেন্দ্রকে বলিলেন, “বাবা, তোমার দু:খে আমি অত্যন্ত কাতর হইয়াছি, কেবল সেই দীনবন্ধুর কৃপায় তোমার স্ত্রী-কন্যাকে কাল রাত্রিতে আমি রক্ষা করিতে পারিয়াছিলাম।” এই বলিয়া ব্রহ্মচারী কল্যাণীর রক্ষাবৃত্তান্ত বর্ণিত করিলেন। তার পর বলিলেন যে, “চল, তাহারা যেখানে আছে, তোমাকে সেখানে লইয়া যাই |” এই বলিয়া ব্রহ্মচারী অগ্রে অগ্রে, মহেন্দ্র পশ্চাৎ পশ্চাৎ দেবালয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া মহেন্দ্র দেখিল, অতি বিস্তৃত, অতি উচ্চ প্রকোষ্ঠ। এই নবারুণপ্রফুল্ল প্রাত:কালে, যখন নিকটস্থ কানন সূর্যালোকে হীরকখচিতবৎ জ্বলিতেছে, তখনও সেই বিশাল কক্ষায় প্রায় অন্ধকার। ঘরের ভিতর কি আছে, মহেন্দ্র প্রথমে তাহা দেখিতে পাইল না – দেখিতে দেখিতে, দেখিতে দেখিতে, ক্রমে দেখিতে পাইল, এক প্রকাণ্ড চতুর্ভুজ মূর্তি, শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, কৌস্তুভশোভিতহৃদয়, সম্মুখে সুদর্শনচক্র ঘূর্ণ্যমানপ্রায় স্থাপিত। মধুকৈটভস্বরূপ দুইটি প্রকাণ্ড ছিন্নমস্ত মূর্তি রুধিরপ্লাবিতবৎ চিত্রিত হইয়া সম্মুখে রহিয়াছে। বামে লক্ষ্মী আলুলায়িতকুন্তলা শতদলমালামণ্ডিতা ভয়ত্রস্তার ন্যায় দাঁড়াইয়া আছেন। দক্ষিণে সরস্বতী, পুস্তক, বাদ্যযন্ত্র, মূর্তিমান রাগরাগিণী প্রভৃতি পরিবেষ্টিত হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। বিষ্ণুর অঙ্কোপরি এক মোহিনী মূর্তি–লক্ষ্মী সরস্বতীর অধিক সুন্দরী, লক্ষ্মী সরস্বতীর অধিক ঐশ্বর্যান্বিতা। গন্ধর্ব, কিন্নর, দেব, যক্ষ, রক্ষ তাঁহাকে পূজা করিতেছে। ব্রহ্মচারী অতি গম্ভীর, অতি ভীত স্বরে মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সকল দেখিতে পাইতেছ?” মহেন্দ্র বলিল, “পাইতেছি |”

ব্র। বিষ্ণুর কোলে কি আছে দেখিয়াছ?

ম। দেখিয়াছি। কে উনি?

ব্র। মা।

ম। মা কে?

ব্রহ্মচারী বলিলেন, “আমরা যাঁর সন্তান |”

ম। কে তিনি?

ব্র। সময়ে চিনিবে। বল–বন্দে মাতরম্। এখন চল, দেখিবে চল।

তখন ব্রহ্মচারী মহেন্দ্রকে কক্ষান্তরে লইয়া গেলেন। সেখানে মহেন্দ্র দেখিলেন, এক অপরূপ সর্বাঙ্গসম্পন্না সর্বাভরণভূষিতা জগদ্ধাত্রী মূর্তি। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে?”

ব্র। মা – যা ছিলেন।

ম। সে কি?

ব্র। ইনি কুঞ্জর কেশরী প্রভৃতি বন্য পশুসকল পদতলে দলিত করিয়া, বন্য পশুর আবাসস্থানে আপনার পদ্মাসন স্থাপিত করিয়াছিলেন। ইনি সর্বালঙ্কারপরিভূষিতা হাস্যময়ী সুন্দরী ছিলেন। ইনি বালার্কবর্ণাভা, সকল ঐশ্বর্যশালিনী। ইঁহাকে প্রণাম কর।

0 Shares