আনন্দমঠ

মহেন্দ্র ভক্তিভাবে জগদ্ধাত্রীরূপিণী মাতৃভূমিকে প্রণাম করিলে পর, ব্রহ্মচারী তাঁহাকে এক অন্ধকার সুরঙ্গ দেখাইয়া বলিলেন, “এই পথে আইস |” ব্রহ্মচারী স্বয়ং আগে আগে চলিলেন। মহেন্দ্র সভয়ে পাছু পাছু চলিলেন। ভূগর্ভস্থ এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কোথা হইতে সামান্য আলো আসিতেছিল। সেই ক্ষীণালোকে এক কালীমূর্তি দেখিতে পাইলেন।

ব্রহ্মচারী বলিলেন, “দেখ, মা যা হইয়াছেন |”

মহেন্দ্র সভয়ে বলিল, “কালী |”

ব্র। কালী – অন্ধকারসমাচ্ছন্না কালিমাময়ী। হৃতসর্বস্বা, এই জন্য নগ্নিকা। আজি দেশে সর্বত্রই শ্মশান – তাই মা কঙ্কালমালিনী। আপনার শিব আপনার পদতলে দলিতেছেন– হায় মা! ব্রহ্মচারীর চক্ষে দর দর ধারা পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাতে খেটক খর্পর কেন?”

ব্র। আমরা সন্তান, অস্ত্র মার হাতে এই দিয়াছি মাত্র – বল, বন্দে মাতরম্।

“বন্দে মাতরম্” বলিয়া মহেন্দ্র কালীকে প্রণাম করিলেন। তখন ব্রহ্মচারী বলিলেন, “এই পথে আইস |” এই বলিয়া তিনি দ্বিতীয় সুরঙ্গ আরোহণ করিতে লাগিলেন। সহসা তাঁহাদিগের চক্ষে প্রাত:সূর্যের রশ্মিরাশি প্রভাসিত হইল। চারি দিক হইতে মধুকণ্ঠ পক্ষিকুল গায়িয়া উঠিল। দেখিলেন, এক মর্মরপ্রস্তরনির্মিত প্রশস্ত মন্দিরের মধ্যে সুবর্ণনির্মিতা দশভুজা প্রতিমা নবারুণকিরণে জ্যোতির্ময়ী হইয়া হাসিতেছে। ব্রহ্মচারী প্রণাম করিয়া বলিলেন,-

“এই মা যা হইবেন। দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত — তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদাশ্রিত বীরকেশরী শত্রুনিপীড়নে নিযুক্ত। দিগ‍্ভুজা_” বলিতে বলিতে সত্যানন্দ গদ্গদকণ্ঠে কাঁদিতে লাগিলেন। “দিগ‍্ভুজা – নানাপ্রহরণধারিণী শত্রুবিমর্দিনী – বীরেন্দ্র – পৃষ্ঠবিহারিণী – দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী – বামে বাণী বিদ্যা-বিজ্ঞানদায়িনী–সঙ্গে বলরূপী কার্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরূপী গণেশ; এস, আমরা মাকে উভয়ে প্রণাম করি |” তখন দুই জনে যুক্তকরে ঊর্ধ্বমুখে এককণ্ঠে ডাকিতে লাগিল, –

“সর্বমঙ্গল-মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ–সাধিকে ।

শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তু তে ||”

উভয়ে ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া গাত্রোত্থান করিলে, মহেন্দ্র গদ্গদকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মার মূর্তি কবে দেখিতে পাইব?”

ব্রহ্মচারী বলিলেন, “যবে মার সকল সন্তান মাকে মা বলিয়া ডাকিবে, সেই দিন উনি প্রসন্ন হইবেন |”

মহেন্দ্র সহসা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার স্ত্রী-কন্যা কোথায়?”

ব্র। চল – দেখিবে চল।

ম। তাহাদের একবার মাত্র আমি দেখিয়া বিদায় দিব।

ব্র। কেন বিদায় দিবে?

ম। আমি এই মহামন্ত্র গ্রহণ করিব।

ব্র। কোথায় বিদায় দিবে?

মহেন্দ্র কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আমার গৃহে কেহ নাই, আমার আর স্থানও নাই। এই মহামারীর সময় আর কোথায় বা স্থান পাইব?”

ব্র। যে পথে এখানে আসিলে, সেই পথে মন্দিরের বাহিরে যাও। মন্দিরদ্বারে তোমার স্ত্রী-কন্যাকে দেখিতে পাইবে। কল্যাণী এ পর্যন্ত অভুক্তা। যেখানে তাহারা বসিয়া আছে, সেইখানে ভক্ষ্য সামগ্রী পাইবে। তাহাকে ভোজন করাইয়া তোমার যাহা অভিরুচি, তাহা করিও, এক্ষণে আমাদিগের আর কাহারও সাক্ষাৎ পাইবে না। তোমার মন যদি এইরূপ থাকে, তবে উপযুক্ত সময়ে, তোমাকে দেখা দিব।

তখন অকস্মাৎ কোন পথে ব্রহ্মচারী অন্তর্হিত হইলেন। পূর্বপ্রদৃষ্ট পথে নির্গমনপূর্বক দেখিলেন, নাটমন্দিরে কল্যাণী কন্যা লইয়া বসিয়া আছে।

এদিকে সত্যানন্দ অন্য সুরঙ্গ দিয়া অবতরণপূর্বক এক নিভৃত ভূগর্ভকক্ষায় নামিলেন। সেখানে জীবানন্দ ও ভবানন্দ বসিয়া টাকা গণিয়া থরে থরে সাজাইতেছে। সেই ঘরে স্তূপে স্তূপে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, হীরক, প্রবাল, মুক্তা সজ্জিত রহিয়াছে। গত রাত্রের লুঠের টাকা, ইহারা সাজাইয়া রাখিতেছে। সত্যানন্দ সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, “জীবানন্দ! মহেন্দ্র আসিবে। আসিলে সন্তানের বিশেষ উপকার আছে। কেন না, তাহা হইলে উহার পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত অর্থরাশি মার সেবায় অর্পিত হইবে। কিন্তু যত দিন সে কায়মনোবাক্যে মাতৃভক্ত না হয়, ততদিন তাহাকে গ্রহণ করিও না। তোমাদিগের হাতের কাজ সমাপ্ত হইলে তোমরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উহার অনুসরণ করিও, সময় দেখিলে উহাকে শ্রীবিষ্ণুমণ্ডপে উপস্থিত করিও। আর সময়ে হউক, অসময়ে হউক, উহাদিগের প্রাণরক্ষা করিও। কেন না, যেমন দুষ্টের শাসন সন্তানের ধর্ম, শিষ্টের রক্ষাও সেইরূপ ধর্ম |”

প্রথম খণ্ড
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

অনেক দু:খের পর মহেন্দ্র আর কল্যাণীতে সাক্ষাৎ হইল। কল্যাণী কাঁদিয়া লুটাইয়া পড়িল। মহেন্দ্র আরও কাঁদিল। কাঁদাকাটার পর চোখ মুছার ধুম পড়িয়া গেল। যত বার চোখ মুছা যায়, ততবার আবার জল পড়ে। জলপড়া বন্ধ করিবার জন্য কল্যাণী খবার কথা পাড়িল। ব্রহ্মচারীর অনুচর যে খাবার রাখিয়া গিয়াছে, কল্যাণী মহেন্দ্রকে তাহা খাইতে বলিল। দুর্ভিক্ষের দিন অন্ন-ব্যঞ্জন পাইবার কোন সম্ভাবনা নাই, কিন্তু দেশে যাহা আছে, সন্তানের কাছে তাহা সুলভ। সেই কানন সাধারণ মনুষ্যের অগম্য। যেখানে যে গাছে, যে ফল হয়, উপবাসী মনুষ্যগণ তাহা পাড়িয়া খায়। কিন্তু এই অগম্য অরণ্যের গাছের ফল আর কেহ পায় না। এই জন্য ব্রহ্মচারীর অনুচর বহুতর বন্য ফল ও কিছু দুগ্ধ আনিয়া রাখিয়া যাইতে পারিয়াছিল। সন্ন্যাসী ঠাকুরদের সম্পত্তির মধ্যে কতকগুলি গাই ছিল। কল্যাণীর অনুরোধে মহেন্দ্র প্রথমে কিছু ভোজন করিলেন। তাহার পর ভুক্তাবশেষ কল্যাণী বিরলে বসিয়া কিছু খাইল। দুগ্ধ কন্যাকে কিছু খাওয়াইল, কিছু সঞ্চিত করিয়া রাখিল আবার খাওয়াইবে। তার পর নিদ্রায় উভয়ে পীড়িত হইলে, উভয়ে শ্রম দূর করিলেন। পরে নিদ্রাভঙ্গের পর উভয়ে আলোচনা করিতে লাগিলেন, এখন কোথায় যাই। কল্যাণী বলিল, “বাড়ীতে বিপদ বিবেচনা করিয়া গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি, বাড়ীর অপেক্ষা বাহিরে বিপদ অধিক। তবে চল, বাড়ীতেই ফিরিয়া যাই |” মহেন্দ্ররও তাহা অভিপ্রেত। মহেন্দ্রর ইচ্ছা, কল্যাণীকে গৃহে রাখিয়া, কোন প্রকারে এক জন অভিভাবক নিযুক্ত করিয়া দিয়া, এই পরম রমণীয় অপার্থিব পবিত্রতাযুক্ত মাতৃসেবাব্রত গ্রহণ করেন। অতএব তিনি সহজেই সম্মত হইলেন। তখন দুই জন গতক্লম হইয়া, কন্যা কোলে তুলিয়া পদচিহ্নাভিমুখে যাত্রা করিলেন।

0 Shares