শ্যামাসুন্দরী আবার কহিলেন, “ভাল, আমার সাধটি পুরাও। একবার আমাদের গৃহস্থের মেয়ের মত সাজ। কতদিন যোগিনী থাকিবে?”
মৃ । যখন এই ব্রাহ্মণসন্তানের সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই, তখন ত আমি যোগিনীই ছিলাম।
শ্যা । এখন থাকিতে পারিবে না।
মৃ । কেন থাকিব না।
শ্যা । কেন? দেখিবি? যোগ ভাঙ্গিব। পরশপাতর কাহাকে বলে জান?
মৃন্ময়ী কহিলেন, “না”।
শ্যা । পরশপাতরের স্পর্শে রাঙ্গও সোনা হয়।
মৃ । তাতে কি?
শ্যা । মেয়েমানুষেরও পরশপাতর আছে।
মৃ । সে কি?
শ্যা । পুরুষ। পুরুষের বাতাসে যোগিনীও গৃহিণী হইয়া যায়। তুই সেই পাতর ছুঁয়েছিস্। দেখিবি,
“বাঁধাব চুলের রাশ, পরাব চিকন বাস
খোঁপায় দোলাব তোর ফুল!
কপালে সীঁথির ধার, কাঁকালেতে চন্দ্রহার,
কানে তোর দিব জোড়া দুল॥
কুঙ্কুম চন্দন চুয়া, বাটা ভরে পান গুয়া,
রাঙ্গামুখ রাঙ্গা হবে রাগে।
সোণার পুত্তলি ছেলে, কোলে তোর দিব ফেলে,
দেখি ভাল লাগে কি না লাগে॥”
মৃন্ময়ী কহিলেন, “ভাল বুঝিলাম। পরশপাতর যেন ছুঁয়েছি, সোণা হলেম, চুল বাঁধিলাম; ভাল কাপড় পরিলাম; খোঁপায় ফুল দিলাম, কাঁকালে চন্দ্রহার পরিলাম; কানে দুল দুলিল; চন্দন, কুঙ্কুম, চুয়া, পান, গুয়া, সোণার পুত্তলি পর্য্যন্ত হইল। মনে কর সকলই। তাহা হইলেই বা কি সুখ?”
শ্যা । বল দেখি ফুল ফুটিলে কি সুখ?
মৃ । লোকের দেখে সুখ, ফুলের কি?
শ্যামাসুন্দরীর মুখকান্তি গম্ভীর হইল; প্রভাতবাতাবহ নীলোৎপলবৎ বিস্ফারিত চক্ষু ঈষৎ দুলিল; বলিলেন, “ফুলের কি? তাহা ত বলিতে পারি না। কখনও ফুল হইয়া ফুটি নাই। কিন্তু যদি তোমার মত কলি হইতাম, তবে ফুটিয়া সুখ হইত।”
শ্যামাসুন্দরী তাঁহাকে নীরব দেখিয়া কহিলেন; – “আচ্ছা – তাই যদি না হইল; – তবে শুনি দেখি, তোমার সুখ কি?”
মৃন্ময়ী কিয়ৎক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন, “বলিতে পারি না। বোধ করি, সমুদ্রতীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারিলে আমার সুখ জন্মে।”
শ্যামাসুন্দরী কিছু বিস্মিতা হইলেন। তাঁহাদিগের যত্নে যে মৃন্ময়ী উপকৃতা হয়েন নাই, ইহাতে কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধা হইলেন, কিছু রুষ্টা হইলেন। কহিলেন, “এখন ফিরিয়া যাইবার উপায়?”
মৃ । উপায় নাই।
শ্যা । তবে করিবে কি?
মৃ । অধিকারী কহিতেন, “যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি।”
শ্যামাসুন্দরী মুখে কাপড় দিয়া হাসিয়া বলিলেন, “যে আজ্ঞা, ভট্টাচার্য্য মহাশয়! কি হইল?”
মৃন্ময়ী নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “যাহা বিধাতা করাইবেন, তাহাই করিব। যাহা কপালে আছে, তাহাই ঘটিবে।”
শ্যা । কেন, কপালে কি আছে? কপালে সুখ আছে। তুমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেল কেন?
মৃন্ময়ী কহিলেন, “শুন। যে দিন স্বামীর সহিত যাত্রা করি, যাত্রাকালে আমি ভবানীর পায়ে ত্রিপত্র দিতে গেলাম। আমি মার পাদপদ্মে ত্রিপত্র না দিয়া কোন কর্ম্ম করিতাম না। যদি কর্ম্মে শুভ হইবার হইত, তবে মা ত্রিপত্র ধারণ করিতেন; যদি অমঙ্গল ঘটিবার সম্ভাবনা থাকিত, তবে ত্রিপত্র পড়িয়া যাইত। অপরিচিত ব্যক্তির সহিত অজ্ঞাত দেশে আসিতে শঙ্কা হইতে লাগিল, ভাল মন্দ জানিতে মার কাছে গেলাম। ত্রিপত্র মা ধারণ করিলেন না – অতএব কপালে কি আছে জানি না।”
মৃন্ময়ী নীরব হইলেন। শ্যামাসুন্দরী শিহরিয়া উঠিলেন।