কপালকুণ্ডলা

বেগম সহচরীর অভিপ্রায় বুঝিলেন। হাসিয়া কহিলেন, “তুমি আগ্রার যে ওমরাহের গৃহিণী হইতে চাও, সেই তোমার পাণিগ্রহণ করিবে। তোমার স্বামী পঞ্চ হাজারি মন্সবদার হইবেন।”

লুৎফ-উন্নিসা সন্তুষ্ট হইলেন। ইহাই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। যদি রাজপুরীমধ্যে সামান্যা পুরস্ত্রী হইয়া থাকিতে হইল, তবে প্রতিপুষ্পবিহারিণী মধুকরীর পক্ষচ্ছেদন করিয়া কি সুখ হইল? যদি স্বাধীনতা ত্যাগ করিতে হইল, তবে বাল্যসখী মেহের-উন্নিসার দাসীত্বে কী সুখ? তাহার অপেক্ষা কোন প্রধান রাজপুরুষের সর্ব্বময়ী ঘরণী হওয়া গৌরবের বিষয়।

শুধু এই লোভে লুৎফ-উন্নিসা এ কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলেন না। সেলিম যে তাঁহাকে উপেক্ষা করিয়া মেহের-উন্নিসার জন্য এত ব্যস্ত, ইহার প্রতিশোধও তাঁহার উদ্দেশ্য।

খাঁ আজিম প্রভৃতি আগ্রা-দিল্লীর ওমরাহেরা লুৎফ-উন্নিসার বিলক্ষণ বাধ্য ছিলেন। খাঁ আজিম যে জামাতার ইষ্টসাধনে উদ্যুক্ত হইবেন, ইহা বিচিত্র নহে। তিনি এবং আর আর ওমরাহগণ সম্মত হইলেন। খাঁ আজিম লুৎফ-উন্নিসাকে কহিলেন, “মনে কর, যদি কোন অসুযোগে আমরা কৃতকার্য্য না হই, তবে তোমার আমার রক্ষা নাই। অতএব প্রাণ বাঁচাইবার একটা পথ রাখা ভাল।”

লুৎফ-উন্নিসা কহিলেন, “আপনার কি পরামর্শ?” খাঁ আজিম কহিলেন, “উড়িষ্যা ভিন্ন অন্য আশ্রয় নাই। কেবল সেই স্থানে মোগলের শাসন তত প্রখর নহে। উড়িষ্যার সৈন্য আমাদিগের হস্তগত থাকা আবশ্যক। তোমার ভ্রাতা উড়িষ্যার মন্সবদার আছেন; আমি কল্য প্রচার করিব, তিনি যুদ্ধে আহত হইয়াছেন। তুমি তাঁহাকে দেখিবার ছলে কল্যই উড়িষ্যায় যাত্রা কর। তথায় যৎকর্ত্তব্য, তাহা সাধন করিয়া শীঘ্র প্রত্যাগমন কর।”

লুৎফ-উন্নিসা এ পরামর্শে সম্মত হইলেন। তিনি উড়িষ্যায় আসিয়া যখন প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, তখন তাঁহার সহিত পাঠক মহাশয়ের সাক্ষাৎ হইয়াছে।

তৃতীয় খণ্ড
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : পথান্তরে

“যে মাটিতে পড়ে লোক উঠে তাই ধরে।

বারেক নিরাশ হয়ে কে কোথায় মরে।।

তুফানে পতিত কিন্তু ছাড়িব না হাল।

আজিকে বিফল হলো, হতে পারে কাল।।”

নবীন তপস্বিনী

যে দিন নবকুমারকে বিদায় করিয়া মতিবিবি বা লুৎফ-উন্নিসা বর্দ্ধমানাভিমুখে যাত্রা করিলেন, সে দিন তিনি বর্দ্ধমান পর্য্যন্ত যাইতে পারিলেন না। অন্য চটিতে রহিলেন। সন্ধ্যার সময়ে পেষমনের সহিত একত্র বসিয়া কথোপকথন হইতেছিল, এমত কাসে মতি সহসা পেষমন্‌কে জিজ্ঞাসা করিলেন,

“পেষমন্‌! আমার স্বামীকে কেমন দেখিলে?”

পেষমন্‌ কিছু বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেমন আর দেখিব?” মতি কহিলেন, “সুন্দর পুরুষ বটে কি না?”

নবকুমারের প্রতি পেষমনের বিশেষ বিরাগ জন্মিয়াছিল। যে অলঙ্কারগুলি মতি কপালকুণ্ডলাকে দিয়াছিলেন, তৎপ্রতি পেষমনের বিশেষ লোভ ছিল; মনে মনে ভরসা ছিল, এক দিন চাহিয়া লইবেন। সেই আশা নির্ম্মূল হইয়াছিল, সুতরাং কপালকুণ্ডলা ও তাঁহার স্বামী উভয়ের প্রতি তাঁহার দারুণ বিরক্তি। অতএব স্বামিনীর প্রশ্নে উত্তর করিলেন,

“দরিদ্র ব্রাহ্মণ আবার সুন্দর কুৎসিত কি?”

সহচরীর মনের ভাব বুঝিয়া মতি হাস্য করিয়া কহিলেন, “দরিদ্র ব্রাহ্মণ যদি ওমরাহ হয়, তবে সুন্দর পুরুষ হইবে কি না?”

পে । সে আবার কি?

মতি । কেন, তুমি জান না যে, বেগম স্বীকার করিয়াছেন যে, খস্রু বাদশাহ হইলে আমার স্বামী ওমরাহ হইবে?

পে । তা ত জানি। কিন্তু তোমার পূর্ব্বস্বামী ওমরাহ হইবেন কেন?

মতি । তবে আমার আবার কোন্‌ স্বামী আছে?

পে । যিনি নূতন হইবেন।

মতি ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমার ন্যায় সতীর দুই স্বামী, বড় অন্যায় কথা – ও কে যাইতেছে?”

যাহাকে দেখিয়া মতি কহিলেন, “ও কে যাইতেছে?” পেষমন্‌ তাহাকে চিনিল; সে আগ্রানিবাসী, খাঁ আজিমের আশ্রিত ব্যক্তি। উভয়ে ব্যস্ত হইলেন। পেষমন্‌ তাহাকে ডাকিলেন। সে ব্যক্তি আসিয়া লুৎফ-উন্নিসাকে অভিবাদনপূর্ব্বক একখানি পত্র দান করিল; কহিল, “পত্র লইয়া উড়িষ্যায় যাইতেছিলাম। পত্র জরুরি।”

পত্র পড়িয়া মতিবিবির আশা ভরসা সকল অন্তর্হিত হইল। পত্রের মর্ম্ম এই,

“আমাদিগের যত্ন বিফল হইয়াছে। মৃত্যুকালেও আকবর শাহ আপন বুদ্ধিবলে আমাদিগকে পরাভূত করিয়াছেন। তাঁহার পরলোকে গতি হইয়াছে। তাঁহার আজ্ঞাবলে, কুমার সেলিম এক্ষণে জাহাঁগীর শাহ হইয়াছেন। তুমি খস্রুর জন্য ব্যস্ত হইবে না। এই উপলক্ষে কেহ তোমার শত্রুতা সাধিতে না পারে, এমত চেষ্টার জন্য তুমি শীঘ্র আগ্রায় ফিরিয়া আসিবে।”

আকবরশাহ যে প্রকারে এ ষড়যন্ত্র নিষ্ফল করেন, তাহা ইতিহাসে বর্ণিত আছে; এ স্থলে সে বিবরণের আবশ্যকতা নাই।

পুরস্কারপূর্ব্বক দূতকে বিদায় করিয়া, মতি পেষমন্‌কে পত্র শুনাইলেন। পেশমন্‌ কহিল,

“এক্ষণে উপায়?”

মতি । এখন আর উপায় নাই।

পে । (ক্ষণেক চিন্তা করিয়া) ভাল, ক্ষতিই বা কি? যেমন ছিলে, তেমনই থাকিবে, মোগল বাদশাহের পুরস্ত্রীমাত্রই অন্য রাজ্যের পাটরাণী অপেক্ষাও বড়।

0 Shares