কৃষ্ণকান্তের উইল

এই সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া, কালামুখী রোহিণী উঠিয়া দ্বার খুলিয়া আবার–“পতঙ্গবদ্বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ”–সেই গোবিন্দলালের কাছে চলিল। মনে মনে নিতান্ত দুঃখিনী, নিতান্ত দুঃখে পড়িয়াছি–আমায় রক্ষা কর–আমার হৃদয়ের এই অসহ্য প্রেমবহ্নি নিবাইয়া দাও–আর আমায় পোড়াইও না। আমি যাহাকে দেখিতে যাইতেছি–তাহাকে যত বার দেখিব, ততবার–আমার অসহ্য যন্ত্রণা–অনন্ত সুখ। আমি বিধবা–আমার ধর্ম গেল–সুখ গেল–প্রাণ গেল–রহিল কি প্রভু? রাখিব কি প্রভু?–হে দেবতা! হে দুর্গা–হে কালি–হে জগন্নাথ–আমায় সুমতি দাও–আমার প্রাণ স্থির কর–আমি এই যন্ত্রণা আর সহিতে পারি না |”

তবু সেই স্ফীত, হৃত, অপরিমিত প্রেমপরিপূর্ণ হৃদয়–থামিল না। কখনও ভাবিল, গরল খাই; কখনও ভাবিল, গোবিন্দলালের পদপ্রান্তে পড়িয়া, অন্তঃকরণ মুক্ত করিয়া সকল কথা বলি; কখনও ভাবিল, পলাইয়া যাই; কখনও ভাবিল, বারুণীতে ডুবে মরি; কখনও ভাবিল ধর্মে জলাঞ্জলি দিয়া গোবিন্দলালকে কাড়িয়া লইয়া দেশান্তরে পলাইয়া যাই। রোহিণী কাঁদিতে কাঁদিতে গোবিন্দলালের কাছে পুর্নবার উপস্থিত হইল।

গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন? কলিকাতায় যাওয়া স্থির হইল ত?”

রো। না।

গো। সে কি? এইমাত্র আমার কাছে স্বীকার করিয়াছিলে?

রো। যাইতে পারিব না।

গো। বলিতে পারি না। জোর করিবার আমার কোনই অধিকার নাই–কিন্তু গেলে ভাল হইত।

রো। কিসে ভাল হইত?

গোবিন্দলাল অধোবদন হইলেন। স্পষ্ট করিয়া কোন কথা বলিবার তিনি কে?”

রোহিণী চক্ষের জল লুকাইয়া মুছিতে মুছিতে গৃহে ফিরিয়া গেল। গোবিন্দলাল নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। তখন ভোমরা নাচিতে নাচিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “ভাব‍ছ কি?”

গো। বল দেখি।

ভ্র। আমার কালো রূপ।

গো। ইঃ-

ভোমরা ঘোরতর কোপাবিষ্ট হইয়া বলিল, “সে কি? আমায় ভাব্ছ না? আমি ছাড়া, পৃথিবীতে তোমার অন্য চিন্তা আছে?”

গো। আছে না ত কি? সর্বে সর্বময়ী আর কি! আমি অন্য মানুষ ভাব‍তেছি।

ভ্রমর তখন গোবিন্দলালের গলা জড়াইয়া ধরিয়া, মুখচুম্বন করিয়া, আদরে গলিয়া গিয়া, আধো আধো, মৃদু মৃদু হাসিমাখা স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্য মানুষ–কাকে ভাব্দ‍ছ বল না?”

গো। কি হবে তোমায় বলিয়া?

ভ্র। বল না!

গো। তুমি রাগ করিবে।

ভ্র। করি কর্ ‍বো–বল না।

গো। যাও, দেখ গিয়া সকলের খাওয়া হলো কি না।

ভ্র। দেখ্ক‍বো এখন–বল না কে মানুষ?

গো। সিয়াকুল কাঁটা! রোহিণীকে ভাব‍‍ছিলাম।

ভ্র। কেন রোহিণীকে ভাব‍‍ছিলে?

গো। তা কি জানি?

ভ্র। জান–বল না।

গো। মানুষ কি মানুষকে ভাবে না?

ভ্র। না। যে যাকে ভালবাসে, সে তাকেই ভাবে, আমি তোমাকে ভাবি–তুমি আমাকে ভাব।

গো। তবে আমি রোহিণীকে ভালবাসি।

ভ্র। মিছে কথা–তুমি আমাকে ভালবাস–আর কাকেও তোমার ভালবাস্ল‍তে নাই–কেন রোহিণীকে ভাব্ন‍ছিলে বল না?

গো। বিধবাকে মাছ খাইতে আছে?

ভ্র। না।

গো। বিধবাকে মাছ খাইতে নাই, তবু তারিণীর মা মাছ খায় কেন?

ভ্র। তার পোড়ার মুখ, যা করতে নাই, তাই করে।

গো। আমারও পোড়ার মুখ, যা করতে নাই, তাই করি। রোহিণীকে ভালবাসি।

ধা করিয়া গোবিন্দলালের গালে ভোমরা এক ঠোনা মারিল। বড় রাগ করিয়া বলিল, “আমি শ্রীমতী ভোমরা দাসী–আমার সাক্ষাতে মিছে কথা?”

গোবিন্দলাল হারি মানিল। ভ্রমরের স্কন্ধে হস্ত আরোপিত করিয়া, প্রফুল্লনীলোৎপলদলতুল্য মধুরিমাময় তাহার মুখমণ্ডল স্বকরপল্লবে গ্রহণ করিয়া, মৃদু মৃদু অথচ গম্ভীর, কাতর কণ্ঠে গোবিন্দলাল বলিল, “মিছে কথাই ভোমরা। আমি রোহিণীকে ভালবাসি না। রোহিণী আমায় ভালবাসে |”

তীব্র বেগে গোবিন্দলালের হাত হইতে মুখমণ্ডল মুক্ত করিয়া, ভোমরা দূরে গিয়া, দাঁড়াইল। হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিতে লাগিল, “-আবাগী–পোড়ারমুখী–বাঁদরী মরুক! মরুক! মরুক! মরুক! মরুক!”

গোবিন্দলাল হাসিয়া বলিলেন, “এখনই এত গালি কেন? তোমার সাত রাজার ধন এক মাণিক এখনও ত কেড়ে নেয় নি |”

ভোমরা একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “দূর তা কেন–তা কি পারে–তা মাগী তোমার সাক্ষাতে বলিল কেন?”

গো। ঠিক ভোমরা–বলা তাহার উচিত ছিল না–তাই ভাবিতেছিলাম। আমি তাহাকে বাস উঠাইয়া কলিকাতায় গিয়া বাস করিতে বলিয়াছিলাম–খরচ পর্যন্ত দিতে স্বীকার করিয়াছিলাম।

ভো। তার পর?

গো। তার পর, সে রাজি হইল না।

ভো।ভাল, আমি তাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি?

গো। পার, কিন্তু আমি পরামর্শটা শুনিব।

ভো। শোন।

এই বলিয়া ভোমরা “ক্ষীরি! ক্ষীরি!” করিয়া একজন চাকরাণীকে ডাকিল।

তখন ক্ষীরোদা–ওরফে ক্ষীরোদমণি–ওরফে ক্ষীরাব্ধিতনয়া—–ওরফে শুধু ক্ষীরি আসিয়া দাঁড়াইল–মোটাসোটা গাটা গোটা–মল পায়ে–গোট পরা–হাসি চাহনিতে ভরা ভরা। ভোমরা বলিল, “ক্ষীরি,-রোহিণী পোড়ারমুখীর কাছে এখনই একবার যাইতে পার‍বি?”

ক্ষীরি বলিল, “পারব না কেন? কি বল‍‍তে হবে?”

ভোমরা বলিল, “আমার নাম করিয়া বলিয়া আয় যে, তিনি বল‍‍লেন, তুমি মর|”

“এই? যাই |” বলিয়া ক্ষীরদা ওরফে ক্ষীরি–মল বাজাইয়া চলিল। গমনকালে ভোমরা বলিয়া দিল, “কি বলে, আমায় বলিয়া যাস |”

“আচ্ছা |” বলিয়া ক্ষীরোদা গেল। অল্পকালমধ্যেই ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “বলিয়া

আসিয়াছি |”

ভো। সে কি বলিল?

ক্ষীরি। সে বলিল, উপায় বলিয়া দিতে বলিও।

ভো। তবে আবার যা। বলিয়া আয় যে–বারুণী পুকুরে–সন্ধ্যেবেলা কলসী গলায় দিয়ে– বুঝেছিস?”

ক্ষীরি। আচ্ছা।

ক্ষীরি আবার গেল। আবার আসিল। ভোমরা জিজ্ঞাসা করিল, “বারুণী পুকুরের কথা বলেছিস?”

ক্ষীরি। বলিয়াছি।

ভো। সে কি বলিল?

ক্ষীরি। বলিল যে “আচ্ছা |”

গোবিন্দলাল বলিলেন, “ছি ভোমরা!”

ভোমরা বলিল, “ভাবিও না। সে মরিবে না। যে তোমায় দেখিয়া মজিয়াছে–সে কি মরিতে পারে?”

প্রথম খণ্ড
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

দৈনিক কার্য সমস্ত সমাপ্ত করিয়া, প্রাত্যহিক নিয়মানুসারে গোবিন্দলাল দিনান্তে বারুণীর তীরবর্তি পুষ্পোদ্যানে গিয়া বিচরণ করিতে লাগিলেন। গোবিন্দলালের পুষ্পোদ্যানভ্রমণ একটি প্রধান সুখ। সকল বৃক্ষের তলায় দুই চারি বার বেড়াইতেন। কিন্তু আমরা সকল বৃক্ষের কথা এখন বলিব না। বারুণীর কূলে, উদ্যানমধ্যে, এক উচ্চ প্রস্তরবেদিকা ছিল, বেদিকামধ্যে একটি শ্বেতপ্রস্তরখোদিত স্ত্রীপ্রতিমূতি–স্ত্রীমূতি অর্ধাবৃতা, বিনতলোচনা–একটি ঘট হইতে আপন চরণদ্বয়ে যেন জল ঢালিতেছে,-তাহার চারি পার্শ্বে বেদিকার উপরে উজ্জ্বলবর্ণরঞ্জিত মৃন্ময় আধারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সপুষ্প বৃক্ষ–জিরানিয়ম, ভর্বিনা, ইউফির্বিয়া চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ–নীচে, সেই বেদিকা বেষ্টন করিয়া, কামিনী, যূথিকা, মল্লিকা, গন্ধরাজ প্রভৃতি সুগন্ধি দেশী ফুলের সারি, গন্ধে গগন আমোদিত করিতেছে–তাহারই পরে বহুবিধ উজ্জ্বল নীল পীত রক্ত শ্বেত নানা বর্ণের দেশী বিলাতী নয়নরঞ্জনকারী পাতার গাছের শ্রেণী। সেইখানে গোবিন্দলাল বসিতে ভালবাসিতেন। জ্যোৎস্না রাত্রে কখনও কখনও ভ্রমরকে উদ্যানভ্রমণে আনিয়া সেইখানে বসাইতেন। ভ্রমর পাষাণময়ী স্ত্রীময়ী স্ত্রীমূতি অর্ধাবৃতা দেখিয়া তাহাকে কালামুখী বলিয়া গালি দিত–কখনও কখনও আপনি অঞ্চল দিয়া তাহার অঙ্গ আবৃত করিয়া দিত–কখনও কখনও তাহার হস্তস্থিত ঘট লইয়া টানাটানি বাধাইত।

0 Shares