কৃষ্ণকান্তের উইল

কুমতি বলিল, “ভ্রমরের প্রথম এইটি অপরাধ, এই অবিশ্বাস |”

সুমতি উত্তর করিল, “যে অবিশ্বাসের যোগ্য, তাহাকে অবিশ্বাস না করিবে কেন? তুমি রোহিণীর সঙ্গে এই আনন্দ উপভোগ করিতেছ, ভ্রমর সেটা সন্দেহ করিয়াছিল বলিয়াই তার এত দোষ?”

কু। এখন যেন আমি অবিশ্বাসী হইয়াছি, কিন্তু ভ্রমর অবিশ্বাস করিয়াছিল, তখন আমি নির্দোষী।

সু। দুদিন আগে পাছেতে বড় আসিয়া যায় না–দোষ ত করিয়াছ। যে দোষ করিতে সক্ষম, তাহাকে দোষী মনে করা কি এত গুরুতর অপরাধ?

কু। ভ্রমর আমাকে দোষী মনে করিয়াছে বলিয়াই আমি দোষী হইয়াছি। সাধুকে চোর বলিতে চোর হয়।

সু। দোষটা যে চোর বলে তার! যে চুরি করে তার কিছু নয়!

কু। তোর সঙ্গে ঝগড়ায় আমি পারবোো না। দেখ্ না, ভ্রমর আমার কেমন অপমানটা করিল? আমি বিদেশ থেকে আসছিব শুনে বাপের বাড়ী চলিয়া গেল।

সু। যদি সে যাহা ভাবিয়াছিল, তাহাতে তাহার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়া থাকে, তবে সে সঙ্গত কাজই করিয়াছে। স্বামী পরদারনিরত হইলে নারীদেহ ধারণ করিয়া কে রাগ না করিবে?

কু। সেই বিশ্বাসই তাহার ভ্রম–আর দোষ কি?

সু। এ কথা কি তাহাকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়াছ?

কু। না।

সু। তুমি না জিজ্ঞাসা করিয়া রাগ করিতেছ, আর ভ্রমর নিতান্ত বালিকা, না জিজ্ঞাসা করিয়া রাগ করিয়াছিল বলিয়া এত হাঙ্গাম? সে সব কাজের কথা নহে–আসল রাগের কারণ কি বলিব?

কু। কি বল না?

সু। আসল কথা রোহিণী। রোহিণীতে প্রাণ পড়িয়াছে–তাই আর কালো ভোমরা ভাল লাগে না।

কু। এতকাল ভোমরা ভাল লাগিল কিসে?

সু। এতকাল রোহিণী জোটে নাই। এক দিনে কোন কিছু ঘটে না। সময়ে সকল উপস্থিত হয়। আজ রৌদ্রে ফাটিতেছে বলিয়া কাল দুর্দিন হইবে না কেন? শুধু কি তাই– আরও আছে!

কুমতি। আর কি?

সু। কৃষ্ণকান্তের উইল। বুড়া মনে মনে জানিত, ভ্রমরকে বিষয় দিয়া গেলে–বিষয় তোমারই রহিল। ইহাও জানিত যে, ভ্রমর এক মাসের মধ্যে তোমাকে উহা লিখিয়া দিবে। কিন্তু আপাততঃ তোমাকে একটু কুপথগামী দেখিয়া তোমার চরিত্রশোধন জন্য তোমাকে ভ্রমরের আঁচলে বাঁধিয়া দিয়া গেল। তুমি অতটা না বুঝিয়া ভ্রমরের উপর রাগিয়া উঠিয়াছ।

কু। তা সত্যই। আমি কি স্ত্রীর মাসহরা খাইব না কি?

সু। তোমার বিষয়, তুমি কেন ভ্রমরের কাছে লিখিয়া লও না?

কু। স্ত্রীর দানে দিনপাত করিব?

সু। আরে বাপ রে! কি পুরুষসিংহ! তবে ভ্রমরের সঙ্গে মোকদ্দমা করিয়া ডিক্রী করিয়া লও না–তোমার পৈতৃক বিষয় বটে।

কু। স্ত্রীর সঙ্গে মোকদ্দমা করিব?

সু। তবে আর কি করিবে? গোল্লায় যাও।

কু। সেই চেষ্টায় আছি।

সু। রোহিণী–সঙ্গে যাবে কি?

তখন কুমতিতে সুমতিতে ভারি চুলোচুলি ঘুষোঘুষি আরম্ভ হইল।

প্রথম খণ্ড
ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

আমার এমন বিশ্বাস আছে যে, গোবিন্দলালের মাতা যদি পাকা গৃহিণী হইতেন, তবে ফুৎকার মাত্রে এ কালো মেঘ উড়িয়া যাইত। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, বধূর সঙ্গে তাঁহার পুত্রের আন্তরিক বিচ্ছেদ হইয়াছে। স্ত্রীলোক ইহা সহজেই বুঝিতে পারে। যদি তিনি এই সময়ে সদুপদেশে, স্নেহবাক্যে এবং স্ত্রীবুদ্ধিসুলভ অন্যান্য সদুপায়ে তাহার প্রতীকার করিতে যত্ন করিতেন, তাহা হইলে বুঝি সফল ফলাইতে পারিতেন। কিন্তু গোবিন্দলালের মাতা বড় পাকা গৃহিণী নহেন, বিশেষ পুত্রবধূ বিষয়ের অধিকারিণী হইয়াছে বলিয়া ভ্রমরের উপরে একটু বিদ্বেষাপন্নাও হইয়াছিলেন। যে স্নেহের বলে তিনি ভ্রমরের ইষ্টকামনা করিবেন, ভ্রমরের উপর তাঁহার সে স্নেহ ছিল না। পুত্র থাকিতে পুত্রবধূর বিষয় হইল, ইহা তাঁহার অসহ্য হইল। তিনি একবারও অনুভব করিতে পারিলেন না যে, ভ্রমর গোবিন্দলাল অভিন্নসম্পত্তি জানিয়া, গোবিন্দলালের চরিত্রদোষসম্ভাবনা দেখিয়া, কৃষ্ণকান্ত রায় গোবিন্দলালের শাসন জন্য ভ্রমরকে বিষয় দিয়া গিয়াছিলেন। একবারও তিনি মনে ভাবিলেন না যে, কৃষ্ণকান্ত মুমূর্ষু অবস্থায় কতকটা লুপ্তবুদ্ধি হইয়া, কতকটা ভ্রান্তচিত্ত হইয়াই এ অবিধেয় কার্য করিয়াছিলেন। তিনি ভাবিলেন যে, পুত্রবধূর সংসারে তাঁহাকে কেবল গ্রাসাচ্ছদনের অধিকারিণী, এবং অন্নদাস পৌরবর্গের মধ্যে গণ্যা হইয়া ইহজীবন নির্বাহ করিতে হইবে। অতএব সংসার ত্যাগ করাই ভাল, স্থির করিলেন। একে পতিহীনা, কিছু আত্মপরায়ণা, তিনি স্বামিবিয়োগকাল হইতেই কাশীযাত্রা কামনা করিতেন, কেবল স্ত্রীস্বভাবসুলভ পুত্রস্নেহবশতঃ এতদিন যাইতে পারেন নাই। এক্ষণে যে বাসনা আরও প্রবল হইল।

তিনি গোবিন্দলালকে বলিলেন, “কর্তারা একে একে স্বর্গারোহণ করিলেন, এখন আমার সময় নিকট হইয়া আসিল। তুমি পুত্রের কাজ কর; এই সময় আমাকে কাশী পাঠাইয়া দাও|”

গোবিন্দলাল হঠাৎ এ প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। বলিলেন, “চল, আমি তোমাকে আপনি কাশী রাখিয়া আসিব |” দুর্ভাগ্যবশতঃ এই সময়ে ভ্রমর একবার ইচ্ছা করিয়া পিত্রালয়ে গিয়াছিলেন। কেহই তাঁহাকে নিষেধ করে নাই। অতএব ভ্রমরের অজ্ঞাতে গোবিন্দলাল কাশীযাত্রার সকল উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।নিজ নামে কিছু সম্পত্তি ছিল—তাহা গোপনে বিক্রয় করিয়া অর্থসঞ্চয় করিলেন। কাঞ্চন হীরকাদি মূল্যবান বস্তু যাহা নিজের সম্পত্তি ছিল–তাহা বিক্রয় করিলেন। এইরূপে প্রায় লক্ষ টাকা সংগ্রহ হইল। গোবিন্দলাল ইহা দ্বারা ভবিষ্যতে দিনপাত করিবেন স্থির করিলেন।

তখন মাতৃসঙ্গে কাশীযাত্রার দিন স্থির করিয়া ভ্রমরকে আনিতে পাঠাইলেন। শাশুড়ী কাশীযাত্রা করিবেন শুনিয়া ভ্রমর তাড়াতাড়ি আসিল। আসিয়া শাশুড়ীর চরণ ধরিয়া অনেক বিনয় করিল; শাশুড়ীর পদপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল, “মা, আমি বালিকা–আমায় একা রাখিয়া যাইও না–আমি সংসারধর্মের কি বুঝি? মা–সংসার সমুদ্র, আমাকে এ সমুদ্রে একা ভাসাইয়া যাইও না |” শাশুড়ী বলিলেন, “তোমার বড় ননদ রহিল। সেই তোমাকে আমার মত যত্ন করিবে–আর তুমিও গৃহিণী হইয়াছ |” ভ্রমর কিছুই বুঝিল না–কেবল কাঁদিতে লাগিল।

0 Shares