কৃষ্ণকান্তের উইল

ভ্রমর দেখিল বড় বিপদ সম্মুখে। শাশুড়ী ত্যাগ করিয়া চলিলেন–আবার স্বামীও তাঁহাকে রাখিতে চলিলেন–তিনিও রাখিতে গিয়া বুঝি আর না আইসেন! ভ্রমর গোবিন্দলালের পায়ে ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল–বলিল, “কত দিনে আসিবে বলিয়া যাও |”

গোবিন্দলাল বলিলেন, “বলিতে পারি না। আসিতে বড় ইচ্ছা নাই |”

ভ্রমর পা ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া, মনে ভাবিল, “ভয় কি? বিষ খাইব |”

তার পরে স্থিরীকৃত যাত্রার দিবস আসিয়া উপস্থিত হইল। হরিদ্রাগ্রাম হইতে কিছু দূর শিবিকারোহণে গিয়া ট্রেন পাইতে হইবে। শুভ যাত্রিক লগ্ন উপস্থিত–সকল প্রস্তুত। ভারে ভারে সিন্দুক, তোরঙ্গ, বাক্স, বেগ, গাঁটরি বাহকেরা বহিতে আরম্ভ করিল। দাস দাসী সুবিমল ধৌতবস্ত্র পরিয়া, কেশ রঞ্জিত করিয়া, দরওয়াজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া পান চিবাইতে লাগিল–তাহারা সঙ্গে যাইবে। দ্বারবানেরা ছিটের জামার বন্ধক আঁটিয়া লাঠি হাতে করিয়া, বাহকদিগের সঙ্গে বকাবকি আরম্ভ করিল। পাড়ার মেয়ে-ছেলে দেখিবার জন্য ঝুঁকিল। গোবিন্দলালের মাতা গৃহদেবতাকে প্রণাম করিয়া, পৌরজন সকলকে যথাযোগ্য সম্ভাষণ করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে শিবিকারোহণ করিলেন; পৌরজন সকলেই কাঁদিতে লাগিল। তিনি শিবিকারোহণ করিয়া অগ্রসর হইলেন।

এদিকে গোবিন্দলাল অন্যান্য পৌরস্ত্রীগণকে যথোচিত সম্বোধন করিয়া শয়নগৃহে রোরুদ্যামানা ভ্রমরের কাছে বিদায় হইতে গেলেন। ভ্রমরকে রোদনবিবশা দেখিয়া তিনি যাহা বলিতে আসিয়াছিলেন, তাহা বলিতে না পারিয়া, কেবল বলিলেন, “ভ্রমর! আমি মাকে রাখিতে চলিলাম |”

ভ্রমর চক্ষের জল মুছিয়া বলিল, “মা সেখানে বাস করিবেন। তুমি আসিবে না কি?”

কথা যখন ভ্রমর জিজ্ঞাসা করিল, তখন তাহার চক্ষের জল শুকাইয়া গিয়াছিল; তাহার স্বরের স্থৈর্য, গাম্ভীর্য, তাহার অধরে স্থির প্রতিজ্ঞা দেখিয়া গোবিন্দলাল কিছু বিস্মিত হইলেন। হঠাৎ উত্তর করিতে পারিলেন না। ভ্রমর স্বামীকে নীরব দেখিয়া পুনরপি বলিল, “দেখ তুমিই আমাকে শিখাইয়াছ, সত্যই আমার ধর্ম, সত্যই একমাত্র সুখ। আজি আমাকে তুমি সত্য বলিও–আমি তোমার আশ্রিত বালিকা–আমায় আজি প্রবঞ্চনা করিও না–কবে আসিবে?”

গোবিন্দলাল বলিলেন, “তবে সত্যই শোন। ফিরিয়া আসিবার ইচ্ছা নাই |”

ভ্রমর। কেন ইচ্ছা নাই–তাহা বলিয়া যাইবে না কি?

গো। এখানে থাকিলে তোমার অন্নদাস হইয়া থাকিতে হইবে।

ভ্রমর। তাহাতেই বা ক্ষতি কি? আমি ত তোমার দাসানুদাসী।

গো। আমার দাসানুদাসী ভ্রমর, আমার প্রবাস হইতে আসার প্রতীক্ষায় জানেলায় বসিয়া থাকিবে। তেমন সময়ে সে পিত্রালয়ে গিয়া বসিয়া থাকে না।

ভ্রমর। তাহার জন্য কত পায়ে ধরিয়াছি–এক অপরাধ কি মার্জনা হয় না!

গো। এখন সেরূপ শত অপরাধ হইবে। তুমি এখন বিষয়ের অধিকারিণী।

ভ্রমর। তা নয়। আমি এবার বাপের বাড়ী গিয়া, বাপের সাহায্যে যাহা করিয়াছি, তাহা দেখ।

এই বলিয়া ভ্রমর একখানা কাগজ দেখাইলেন। গোবিন্দলালের হাতে তাহা দিয়া বলিলেন, “পড় |”

গোবিন্দলাল পড়িয়া দেখিলেন–দানপত্র। ভ্রমর, উচিত মূল্যের ষ্ট্যাম্পে, আপনার সমুদয় সম্পত্তি স্বামীকে দান করিতেছেন–তাহা রেজিষ্টারী হইয়াছে। গোবিন্দলাল পড়িয়া বলিলেন, “তোমার যোগ্য কাজ তুমি করিয়াছ। কিন্তু তোমায় আমায় কি সম্বন্ধ? আমি তোমায় অলঙ্কার দিব, তুমি পরিবে। তুমি বিষয় দান করিবে, আমি ভোগ করিব–এ সম্বন্ধ নহে |” এই বলিয়া গোবিন্দলাল বহুমূল্য দানপত্রখানি খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন।

ভ্রমর বলিলেন, “পিতা বলিয়া দিয়াছেন, ইহা ছিঁড়িয়া ফেলা বৃথা। সরকারীতে ইহার নকল আছে |”

গো। থাকে থাক। আমি চলিলাম।

ভ্র। কবে আসিবে?

গো। আসিব না।

ভ্র। কেন? আমি তোমার স্ত্রী, শিষ্যা, আশ্রিতা, প্রতিপালিতা–তোমার দাসানুদাসী–তোমার কথার ভিখারী–আসিবে না কেন?

গো। ইচ্ছা নাই।

ভ্র। ধর্ম নাই কি?

গো। বুঝি আমার তাও নাই।

বড় কষ্টে ভ্রমর চক্ষের জল রোধ করিল। হুকুমে চক্ষের জল ফিরিল–ভ্রমর জোড়হাত করিয়া অবিকম্পিত কণ্ঠে বলিতে লাগিল, “তবে যাও–পার, আসিও না। বিনাপরাধে আমাকে ত্যাগ করিতে চাও, কর।–কিন্তু মনে রাখিও, উপরে দেবতা আছেন। মনে রাখিও–এক দিন আমার জন্য তোমাকে কাঁদিতে হইবে। মনে রাখিও–এক দিন তুমি খুঁজিবে, এ পৃথিবীতে অকৃত্রিম আন্তরিক স্নেহ কোথায় যায়?–দেবতা সাক্ষী! যদি আমি সতী হই, কায়মনোবাক্যে তোমার পায়ে আমার ভক্তি থাকে, তবে তোমায় আমায় আবার সাক্ষাৎ হইবে।অমি সেই আশায় প্রান রাখিব। এখন যাও, বলিতে ইচ্ছা হয়, বল যে আর আসিব না। কিন্তু আমি বলিতেছি–আবার আসিবে–আবার ভ্রমর বলিয়া ডাকিবে–আবার আমার জন্য কাঁদিবে। যদি এ কথা নিষ্ফল হয়, তবে জানিও–দেবতা মিথ্যা, ধর্ম মিথ্যা, ভ্রমর অসতী! তুমি যাও, আমার দুঃখ নাই! তুমি আমারই–রোহিণীর নও |”

এই বলিয়া ভ্রমর, ভক্তিভাবে স্বামীর চরণে প্রণাম করিয়া গজেন্দ্রগমনে কক্ষান্তরে গমন করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল।

প্রথম খণ্ড
একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

এই আখ্যায়িকা আরম্ভের কিছুপর্বে ভ্রমরের একটি পুত্র হইয়া সূতিকাগারেই নষ্ট হয়। ভ্রমর আজি কক্ষান্তরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া, সেই সাত দিনের ছেলের জন্য কাঁদিতে বসিল। মেঝের উপর পড়িয়া, ধূলায় লুটাইয়া অশমিত নিশ্বাসে পুত্রের জন্য কাঁদিতে লাগিল। “আমার ননীর পুত্তলী, আমার কাঙ্গালের সোণা, আজ তুমি কোথায়? আজি তুই থাকিলে আমায় কার সাধ্য ত্যাগ করে? আমার মায়া কাটাইলেন, তোর মায়া কে কাটাইত? আমি কুরূপা কুৎসিতা, তোকে কে কুৎসিত বলিত? তোর চেয়ে কে সুন্দর? একবার দেখা দে বাপ–এই বিপদের সময় একবার কি দেখা দিতে পারিস না–মরিলে কি আর দেখা দেয় না?__”

ভ্রমর তখন যুক্তকরে, মনে মনে উর্ধ্বমুখে, অথচ অস্ফুট বাক্যে দেবতাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “কেহ আমাকে বলিয়া দাও–আমার কি দোষে, এই সতের বৎসর মাত্র বয়সে এমন অসম্ভব দুর্দশা ঘটিল; আমার পুত্র মরিয়াছে–আমার স্বামী ত্যাগ করিল–আমার সতের বৎসর মাত্র বয়স, আমি এই বয়সে স্বামীর ভালবাসা বিনা আর কিছু ভালবাসি নাই–আমার ইহলোকে আর কিছু কামনা নাই–আর কিছু কামনা করিতে শিখি নাই–আমি আজি এই সতের বৎসর বয়সে তাহাতে নিরাশ হইলাম কেন?”

0 Shares