কৃষ্ণকান্তের উইল

তখন মাধবীনাথ কতক সুস্থির হইয়া অন্তঃপুরে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। কন্যার কাছে গিয়া বলিলেন, “মা, তুমি ব্রত নিয়ম করিবার কথা বলিতেছিলে, আমি সেই কথাই ভাবিতেছিলাম। এখন তোমার শরীর বড় রুগ্ন; ব্রত নিয়ম করিতে গেলে অনেক উপবাস করিতে হয়; এখন তুমি উপবাস সহ্য করিতে পারিবে না। একটু শরীর সারুক___”

ভ্র। এ শরীর কি আর সারিবে?

মা। সারিবে মা–কি হইয়াছে? তোমার একটু এখানে চিকিৎসা হইতেছে না–কেমন করিয়াই বা হইবে? শ্বশুর নাই, শাশুড়ী নাই, কেহ কাছে নাই–কে চিকিৎসা করাইবে? তুমি এখন আমার সঙ্গে চল। আমি তোমাকে বাড়ী রাখিয়া চিকিৎসা করাইব। আমি এখন দুই দিন এখানে থাকিব–তাহার পরে তোমাকে সঙ্গে লইয়া রাজগ্রামে যাইব।

রাজগ্রামে ভ্রমরের পিত্রালয়।

কন্যার নিকট হইতে বিদায় লইয়া মাধবীনাথ কন্যার কার্য কারকবর্গের নিকট গেলেন। দেওয়ানজীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, বাবুর কোন পত্রাদি আসিয়া থাকে?” দেওয়ানজী উত্তর করিল, “কিছু না |”

মা। তিনি এখন কোথায় আছেন?

দে। তাঁহার কোন সংবাদই আমরা কেহ বলিতে পারি না। তিনি কোন সংবাদই পাঠান না।

মা। কাহার কাছে এ সংবাদ পাইতে পারিব?

দে। তাহা জানিলে ত আমরা সংবাদ লইতাম। কাশীতে মা ঠাকুরাণীর কাছে সংবাদ জানিতে লোক পাঠাইয়াছিলাম–কিন্তু সেখানেও কোন সংবাদ আইসে না। বাবুর এক্ষণে অজ্ঞাতবাস।

দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় পরিচ্ছেদ

মাধবীনাথ কন্যার দুর্দশা দেখিয়া স্থির প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ইহার প্রতীকার করিবেন। গোবিন্দলাল ও রোহিণী এই অনিষ্টের মূল। অতএব প্রথমেই সন্ধান কর্তব্য, সেই পামর পামরী কোথায় আছে। নচেৎ দুষ্টের দণ্ড হইবে না–ভ্রমরও মরিবে।

তাহারা একেবারে লুকাইয়াছে। যে সকল সূত্রে তাহাদের ধরিবার সম্ভাবনা, সকলই অবচ্ছিন্ন করিয়াছে; পদচিহ্নমাত্র মুছিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু মাধবীনাথ বলিলেন যে, যদি আমি তাহাদের সন্ধান করিতে না পারি, তবে বৃথায় আমার পৌরুষের শ্লাঘা করি।

এইরূপ স্থির সংকল্প করিয়া মাধবীনাথ একাকী রায়দিগের বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। হরিদ্রাগ্রমের একটি পোষ্ট আপিস ছিল; মাধবীনাথ বেত্রহস্তে, হেলিতে দুলিতে, পান চিবাইতে চিবাইতে, ধীরে ধীরে, নিরীহ ভালমানুষের মত, সেইখানে গিয়া দর্শন দিলেন।

ডাকঘরে, অন্ধকার চালাঘরের মধ্যে মাসিক পনর টাকা বেতনভাগী একটি ডিপুটি পোষ্ট মাষ্টার বিরাজ করিতেছিলেন। একটি আম্রকাষ্ঠের ভগ্ন টেবিলের উপরে কতকগুলি চিঠি, চিঠির ফাইল, চিঠির খাম, একখানি খুরিতে কতকটা জিউলির আটা, একটি নিক্তি, ডাকঘরের মোহর ইত্যাদি লইয়া, পোষ্ট মাষ্টার ওরফে পোষ্টবাবু গম্ভীরভাবে, পিয়ন মহাশয়ের নিকট আপন প্রভুত্ব বিস্তার করিতেছেন। ডিপুটি পোষ্টমাষ্টার বাবু পান পনর টাকা, পিয়ন পায় সাত টাকা। সুতরাং পিয়ন মনে করে, সাত আনা আর পনর আনায় যে তফাৎ, বাবুর সঙ্গে আমার সঙ্গে তাহার অধিক তফাৎ নহে। কিন্তু বাবু মনে মনে জানেন যে, আমি একটা ডিপুটি–ও বেটা পিয়াদা–আমি উহার হর্তা কর্তা বিধাতা পুরুষ–উহাতে আমাতে জমীন আশমান ফারাক। সেই কথা সপ্রমাণ করিবার জন্য, পোষ্ট মাষ্টার বাবু সর্বদা সে গরীবকে তর্জন গর্জন করিয়া থাকেন–সেও সাত আনার ওজনে ভর্ৎসনা করিতেছিলেন, এমত সময়ে প্রশান্তমূতি সহাস্যবদন মাধবীনাথ বাবু সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভদ্রলোক দেখিয়া, পোষ্টমাষ্টার বাবু, আপাততঃ পিয়াদার সঙ্গে কচকচি বন্ধ করিয়া, হাঁ করিয়া, চাহিয়া রহিলেন। ভদ্রলোককে সমাদর করিতে হয়, এমন কতকটা তাঁহার মনে উদয় হইল–কিন্তু সমাদর কি প্রকারে করিতে হয়, তাহা তাঁহার শিক্ষার মধ্যে নহে–সুতরাং তাহা ঘটিয়া উঠিল না।

মাধবীনাথ দেখিলেন, একটা বানর। সহাস্যবদনে বলিলেন, “ব্রাহ্মণ?”

পোষ্টমাষ্টার বলিলেন, “হাঁ–তু–তুমি–আপনি?”

মাধবীনাথ ঈষৎ হাস্য সংবরণ করিয়া অবনতশিরে যুক্তকরে ললাট স্পর্শ করিয়া বলিলেন, “প্রাতঃপ্রণাম!”

তখন পোষ্ট মাষ্টার বাবু বলিলেন, “বসুন |”

মাধবীনাথ কিছু বিপদে পড়িলেন;-পোষ্টবাবু ত বলিলেন, “বসুন”, কিন্তু তিনি বসেন কোথা–বাবু খোদ এক অতি প্রাচীন ত্রিপাদমাত্রবশিষ্ট চৌকিতে বসিয়া আছেন–তাহা ভিন্ন আর আসন কোথাও নাই। তখন সেই পোষ্টমাষ্টার বাবুর সাত আনা, হরিদাস পিয়াদা–একটা ভাঙ্গা টুলের উপর হইতে রাশিখানি ছেঁড়া বহি নামাইয়া রাখিয়া মাধবীনাথকে বসিতে দিল। মাধবীনাথ বসিয়া তাহার প্রতি দৃষ্টি করিয়া বলিলেন, “কি হে বাপু, কেমন আছ? তোমাকে দেখিয়াছি না?”

পিয়াদা। আজ্ঞা, আমি চিঠি বিলি করিয়া থাকি।

মাধবী। তাই চিনিতেছি। এক ছিলিম তামুক সাজ দেখি–

মাধবীনাথ গ্রামান্তরের লোক, তিনি কখনই হরিদাস বৈরাগী পিয়াদাকে দেখেন নাই এবং বৈরাগী বাবাজিও কখনও তাহাকে দেখেন নাই। বাবাজি মনে করিলেন–বাবুটা রকমসই বটে চাহিলে কোন না চারি গণ্ডা বখশিশ দিবে। এই ভাবিয়া হুঁকোর তল্লাসে ধাবিত হইলেন।

মাধবীনাথ আদৌ তামাকু খান না–কেবল হরিদাস বাবাজিকে বিদায় করিবার জন্য তামাকুর ফরমায়েশ করিলেন।

পিয়াদা মহাশয় স্থানান্তরে গমন করিলে, মাধবীনাথ পোষ্টমাষ্টার বাবুকে বলিলেন, “আপনার কাছে একটা জিজ্ঞাসা করার জন্য আসা হইয়াছে |”

পোষ্টমাষ্টার বাবু মনে মনে একটু হাসিলেন। তিনি বঙ্গদেশীয়–নিবাস বিক্রমপুরে। অন্য দিকে যেমন নির্বোধ হউন না কেন–আপনার কাজ বুঝিতে সূচ্যগ্রবুদ্ধি। বুঝিলেন যে, বাবুটি কোন বিষয়ের সন্ধানে আসিয়াছেন। বলিলেন, “কি কথা মহাশয়?”

মা। ব্রহ্মানন্দকে আপনি চিনেন?

পো। চিনি না–চিনি–ভাল চিনি না।

মাধবীনাথ বুঝিলেন, অবতার নিজমূর্তি ধারণ করিবার উপক্রম করিতেছে। বলিলেন, “আপনার ডাকঘরে ব্রহ্মানন্দ ঘোষের নামে কোন পত্রাদি আসিয়া থাকে?”

পো। আপনার সঙ্গে ব্রহ্মানন্দ ঘোষের আলাপ নাই?

মা। থাক বা না থাক, কথাটা জিজ্ঞাসা করিতে আপনার কাছে আসিয়াছি।

0 Shares