কৃষ্ণকান্তের উইল

পোষ্টমাষ্টার বাবু তখন আপনার উচ্চ পদ এবং ডিপুটি অভিধান স্মরণপূর্বক অতিশয় গম্ভীর হইয়া বসিলেন, এবং অল্প রুষ্টভাবে বলিলেন, “ডাকঘরের খবর আমাদের বলিতে বারণ আছে|” ইহা বলিয়া পোষ্ট মাষ্টার নীরবে চিঠি ওজন করিতে লাগিলেন।

মাধবীনাথ মনে মনে হাসিতে লাগিলেন; প্রকাশ্যে বলিলেন, “ওহে বাপু, তুমি অমনি কথা কবে না, তা জানি। সে জন্য কিছু সঙ্গেও আনিয়াছি–কিছু দিয়া যাইব–এখন যা যা জিজ্ঞাসা করি, ঠিক ঠিক বল দেখি___”

তখন, পোষ্ট বাবু হর্ষোৎফুল্ল বদনে বলিলেন, “কি কন?”

মা। কই এই, ব্রহ্মানন্দের নামে কোন চিঠিপত্র ডাকঘরে আসিয়া থাকে?

পো। আসে।

মা। কত দিন অন্তর?

পো। যে কথাটি বলিয়া দিলাম, তাহার এখনও টাকা পাই নাই। আগে তার টাকা বাহির করুন; তবে নূতন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন।

মাধবীনাথের ইচ্ছা ছিল, পোষ্টমাষ্টারকে কিছু দিয়া যান। কিন্তু তাহার চরিত্রে বড় বিরক্ত হইয়া উঠিলেন–বলিলেন, “বাপু, তুমি ত বিদেশী মানুষ দেখ‍ছি–আমায় চেন কি?”

পোষ্ট মাষ্টার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না। তা আপনি যেই হউন না কেন–আমরা কি পোষ্ট আপিসের খবর যাকে তাকে বলি? কে তুমি?”

মা। আমার নাম মাধবীনাথ সরকার–বাড়ী রাজগ্রাম। আমার পাল্লায় কত লাঠিয়াল আছে খবর রাখ?

পোষ্ট বাবুর ভয় হইল–মাধবী বাবুর নাম ও দোর্দণ্ড প্রতাপ শুনিয়াছিলেন। পোষ্টবাবু একটু চুপ করিলেন।

মাধবীনাথ বলিতে লাগিলেন, “আমি যাহা তোমায় জিজ্ঞাসা করি–সত্য সত্য জবাব দাও। কিছু তঞ্চক করিও না। করিলে তোমায় কিছু দিব না–এক পয়সাও নহে। কিন্তু যদি না বল, মিছা বল, তবে তোমার ঘরে আগুন দিব, তোমার ডাকঘর লুঠ করিব; আদালতে প্রমাণ করাইব যে, তুমি নিজে লোক দিয়া সরকারী টাকা অপহরণ করিয়াছ–কেমন, এখন বলিবে?”

পোষ্টবাবু থরথরি কাঁপিতে লাগিলেন–বলিলেন, “আপনি রাগ করেন কেন? আমি ত আপনাকে চিনিতাম না, বাজে লোক মনে করিয়াই ওরূপ বলিয়াছিলাম–আপনি যখন আসিয়াছেন, তখন যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহা বলিব |”

মা। কত দিন অন্তর ব্রহ্মানন্দের চিঠি আসে?

পো। প্রায় মাসে মাসে–ঠিক ঠাওর নাই।

মা। তবে রেজিষ্টরি হইয়াই চিঠি আসে?

পো। হাঁ–প্রায় অনেক চিঠিই রেজিষ্টরি করা।

মা। কোন্ আপিস হইতে রেজিষ্টরি হইয়া আইসে?

পো। মনে নাই।

মা। তোমার আপিসে একখানা করিয়া রসিদ থাকে না?

পোষ্টমাষ্টার রসিদ খুঁজিয়া বাহির করিলেন। একখানা পড়িয়া বলিলেন, “প্রসাদপুর |”

“প্রসাদপুর কোন্ জেলা? তোমাদের লিষ্টি দেখ|” পোষ্টমাষ্টার কাঁপিতে কাঁপিতে ছাপান লিষ্টি দেখিয়া বলিল, “যশোর |”

মা। দেখ, তবে আর কোথা হইতে রেজিষ্টরি চিঠি উহার নামে আসিয়াছে। সব রসিদ দেখ।

পোষ্ট বাবু দেখিলেন, ইদানীন্তন যত পত্র আসিয়াছে, সকলই প্রসাদপুর হইতে। মাধবীনাথ পোষ্ট মাষ্টার বাবুর কম্পমান হস্তে একখানি দশ টাকার নোট দিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। তখনও হরিদাস বাবাজির হুঁকা জুটিয়া উঠে নাই। মাধবীনাথ হরিদাসের জন্যও একটি টাকা রাখিয়া গেলেন। বলা বাহুল্য যে, পোষ্টবাবু তাহা আত্মসাৎ করিলেন।

দ্বিতীয় খণ্ড
চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মাধবীনাথ হাসিতে হাসিতে ফিরিয়া আসিলেন। মাধবীনাথ, গোবিন্দলাল ও রোহিনীর অধ:পতনকাহিনী সকলই লোকপরম্পরায় শুনিয়াছিলেন। তিনি মনে মনে স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, রোহিণী গোবিন্দলাল এক স্থানেই গোপনে বাস করিতেছে। ব্রহ্মানন্দের অবস্থাও তিনি সবিশেষ অবগত ছিলেন–জানিতেন যে,রোহিনী ভিন্ন তাঁহার আর কেহই নাই। অতএব যখন পোষ্ট আপিসে জানিলেন যে ব্রহ্মানন্দের নামে মাসে মাসে রেজিষ্টরি হইয়া চিঠি আসিতেছে–তখন বুঝিলেন যে, হয় রোহিণী, নয় গোবিন্দলাল তাঁহাকে মাসে মাসে খরচ পাঠায়। প্রসাদপুর হইতে চিঠি আসে, অতএব উভয়েই প্রসাদপুরে কিম্বা তাহার নিকটবর্তী কোন স্থানে অবশ্য বাস করিতেছে, কিন্তু নিশ্চয়কে নিশ্চয়তর করিবার জন্য তিনি কন্যালয়ে প্রত্যাগমন করিয়াই ফাঁড়িতে একটি লোক পাঠাইলেন। সাব্ ইন্স্পে ক্টরকে লিখিয়া পাঠাইলেন, একটি কনস্টেড়বল পাঠাইবেন, বোধ হয় কতকগুলি চোরা মাল ধরাইয়া দিতে পারিব।

সাব ইনস্পেক্টর মাধবীনাথকে বিলক্ষণ জানিতেন–ভয়ও করিতেন–পত্রপ্রাপ্তি মাত্র নিদ্রাসিংহ কনস্টেনবলকে পাঠাইয়া দিলেন।

মাধবীনাথ নিদ্রাসিংহের হস্তে দুইটি টাকা দিয়া বলিলেন, “বাপু হে–হিন্দি মিন্দি কইও না–যা বলি, তাই কর। ঐ গাছতলায় গিয়া, লুকাইয়া থাক। কিন্তু এমন ভাবে গাছতলায় দাঁড়াইবে, যেন এখান হইতে তোমাকে দেখা যায়। আর কিছু করিতে হইবে না |” নিদ্রাসিংহ স্বীকৃত হইয়া বিদায় লইল। মাধবীনাথ তখন ব্রহ্মানন্দকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ব্রহ্মানন্দ আসিয়া নিকটে বসিল। তখন আর কেহ সেখানে ছিল না।

পরস্পরে স্বাগত জিজ্ঞাসার পর মাধবীনাথ বলিলেন, “মহাশয় আমার স্বর্গীয় বৈবাহিক মহাশয়ের বড় আত্মীয় ছিলেন। এখন তাঁহারা ত কেহ নাই–আমার জামাতাও বিদেশস্থ। আপনার কোন বিপদ আপদ পড়িলেই আমাদিগকেই দেখিতে হয়–তাই আপনাকে ডাকাইয়াছি|”

ব্রহ্মানন্দের মুখ শুকাইল। বলিল, “বিপদ কি মহাশয়?” মাধবীনাথ গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি কিছু বিপদগ্র্স্ত বটে |”

ব্র। “কি বিপদ্ মহাশয়?”

মা। বিপদ্ সমূহ। পুলিসে কি প্রকারে নিশ্চয় জানিয়াছে যে, আপনার কাছে একখানা চোরা নোট আছে।

ব্রহ্মানন্দ আকাশ হইতে পড়িল। “সে কি! আমার কাছে চোরা নোট!”

মা। তোমার জানা, চোরা না হইতে পারে। অন্যে তোমাকে চোরা নোট দিয়াছে, তুমি না জানিয়া তুলিয়া রাখিয়াছ!

ব্র। সে কি মহাশয়! আমাকে নোট কে দিবে?

মাধবীনাথ তখন আওয়াজ ছোট করিয়া বলিলেন, “আমি সকলই জানিয়াছি–পুলিসেও জানিয়াছে। বাস্তবিক পুলিসের কাছেই এ কথা শুনিয়াছি। চোরা নোট প্রসাদপুর হইতে আসিয়াছে। ঐ দেখ একজন পুলিসের কনস্টেেবল আসিয়া তোমার জন্য দাঁড়াইয়া আছে–আমি তাহাকে কিছু দিয়া আপাততঃ স্থগিত রাখিয়াছি |”

0 Shares