নবাব শৈবলিনীকে নিরুত্তর দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি তাঁহাকে দেখিয়াছ?”
শৈ। দেখিয়াছি।
ন। কোথায় দেখিলে?
শৈ। যেখানে আমরা কাল রাত্রে ছিলাম।
ন। সে কোথায়? প্রতাপ রায়ের বাসায়?
শৈ। আজ্ঞা হাঁ।
ন। বেগম সেখান হইতে কোথায় গিয়াছেন, জান?
শৈ। দুইজন ইংরেজ তাঁহাদিগকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
ন। কি বলিলে?
শৈবলিনী পূর্বপ্রদত্ত উত্তর পুনরুক্ত করিলেন। নবাব মৌনী হইয়া রহিলেন। অধর দংশন করিয়া, শ্মশ্রু উৎপাটন করিলেন। গুর্গতণ খাঁকে ডাকিতে আদেশ করিলেন। শৈবলিনীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন ইংরেজ বেগমকে ধরিয়া লইয়া গেল, জান?”
শৈ। না।
ন। প্রতাপ তখন কোথায় ছিল?
শৈ। তাঁহাকেও উহারা সেই সঙ্গে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
ন। তাহার বাসায় আর কোন লোক ছিল?
শৈ। একজন চাকর ছিল, তাঁহাকেও ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
নবাব আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, তাঁহাদের ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, জান?”
শৈবলিনী এতক্ষণ সত্য বলিতেছিল, এখন মিথ্যা আরম্ভ করিল। বলিল, “না ।”
ন। প্রতাপ কে? তাহার বাড়ী কোথায়?
শৈবলিনী প্রতাপের সত্য পরিচয় দিল।
ন। এখানে কি করিতে আসিয়াছিল?
শৈ। সরকারে চাকরি করিবেন বলিয়া।
ন। তোমার কে হয়?
শৈ। আমার স্বামী।
ন। তোমার নাম কি?
শৈ। রূপসী।
অনায়াসে শৈবলিনী এই উত্তর দিল। পাপিষ্ঠা এই কথা বলিবার জন্যই আসিয়াছিল।
নবাব বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি এখন গৃহে যাও ।”
শৈবলিনী বলিল, “আমার গৃহ কোথা—কোথা যাইব?”
নবাব নিস্তব্ধ হইলেন। পরক্ষণে বলিলেন, “তবে তুমি কোথায় যাইবে?”
শৈ। আমার স্বামীর কাছে। আমার স্বামীর কাছে পাঠাইয়া দিন। আপনি রাজা, আপনার কাছে নালিশ করিতেছি;—আমার স্বামীকে ইংরেজ ধরিয়া লইয়া গিয়াছে; হয়, আমার স্বামীকে মুক্ত করিয়া দিন, নচেৎ আমাকে তাঁহার কাছে পাঠাইয়া দিন। যদি আপনি অবজ্ঞা করিয়া, ইহার উপায় না করেন, তবে এইখানে আপনার সম্মুখে আমি মরিব। সেই জন্য এখানে আসিয়াছি।
সংবাদ আসিল, গুর্গবণ খাঁ হাজির। নবাব, শৈবলিনীকে বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি এইখানে অপেক্ষা কর। আমি আসিতেছি ।”
তৃতীয় খণ্ড
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : নূতন সখ
নবাব গুর্গকণ খাঁকে, অন্যান্য সংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া কহিলেন, “ইংরেজদিগের সঙ্গে বিবাদ করাই শ্রেয়ঃ হইতেছে। আমার বিবেচনায় বিবাদের পূর্বে আমিয়টকে অবরুদ্ধ করা কর্তব্য; কেন না, আমিয়ট আমার পরম শত্রু। কি বল?”
গুরগারণ খাঁ কহিলেন, “যুদ্ধে আমি সকল সময়েই প্রস্তুত। কিন্তু দূত অস্পর্শনীয়। দূতের পীড়ন করিলে, বিশ্বাসঘাতক বলিয়া আমাদের নিন্দা হইবে।–আর—”
ন। আমিয়ট কাল রাত্রে এই সহর মধ্যে এক ব্যক্তির গৃহ আক্রমণ করিয়া তাহাদিগকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। যে আমার অধিকারে থাকিয়া অপরাধ করে, সে দূত হইলেও আমি কেন তাহার দণ্ডবিধান না করিব?
গুর্। যদি সে এরূপ করিয়া থাকে, তবে সে দণ্ডযোগ্য। কিন্তু তাহাকে কি প্রকারে ধৃত করিব?
ন। এখনই তাহার বাসস্থানে সিপাহী ও কামান পাঠাইয়া দাও। তাহাকে সদলে ধরিয়া লইয়া আসুক।
গুর্। তাহারা এ সহরে নাই। অদ্য দুই প্রহরে চলিয়া গিয়াছে।
ন। সে কি! বিনা এত্তেলায়?
গুর্। এত্তেলা দিবার জন্য হে নামক এক জনকে রাখিয়া গিয়াছে।
ন। এরূপ হঠাৎ, বিনা অনুমতিতে পলায়নের কারণ কি? ইহাতে আমার সহিত অসৌজন্য হইল, তাহা জানিয়াই করিয়াছে।
গুর্। তাহাদের হাতিয়ারের নৌকার চড়ন্দার ইংরেজকে কে কাল রাত্রে খুন করিয়াছে। আমিয়ট বলে, আমাদের লোকে খুন করিয়াছে। সেই জন্য রাগ করিয়াছে। বলে, এখানে থাকিলে জীবন অনিশ্চিত।
ন। কে খুন করিয়াছে শুনিয়াছ?
গুর্। প্রতাপ রায় নামক এক ব্যক্তি।
ন। আচ্ছা করিয়াছ। তাহার দেখা পাইলে খেলোয়াৎ দিব। প্রতাপ রায় কোথায়?
গুর্। তাহাদিগের সকলকে বাঁধিয়া সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছে। সঙ্গে লইয়া গিয়াছে কি আজিমাবাদ পাঠাইয়াছে, ঠিক শুনি নাই।
ন। এতক্ষণ আমাকে এ সকল সম্বাদ দাও নাই কেন?
গুর্। আমি এই মাত্র শুনিলাম।
এ কথাটি মিথ্যা। গুর্গদণ খাঁ আদ্যোপান্ত সকল জানিতেন, তাঁহার অনভিমতে আমিয়ট কদাপি মুঙ্গের ত্যাগ করিতে পারিতেন না। কিন্তু গুর্গ ণ খাঁর দুইটি উদ্দেশ্য ছিল—প্রথম, দলনী মুঙ্গেরের বাহির হইলেই ভাল; দ্বিতীয়, আমিয়ট একটু হস্তগত থাকা ভাল, ভবিষ্যতে তাহার দ্বারা উপকার ঘটিতে পারিবে।
নবাব, গুর্গনণ খাঁকে বিদায় দিলেন। গুর্গাণ খাঁ যখন যান, তাঁহার প্রতি বক্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। সে দৃষ্টির অর্থ এই, “যত দিন না যুদ্ধ সমাপ্ত হয়, ততদিন তোমায় কিছু বলিব না—যুদ্ধকালে তুমি আমার প্রধান অস্ত্র। তার পর দলনী বেগমের ঋণ তোমার শোণিতে পরিশোধ করিব ।”
নবাব তাহার পর মীরমুন্সীকে ডাকিয়া আদেশ প্রচার করিলেন যে, মুরশিদাবাদে মহম্মদ তকি খাঁর নামে পরওয়ানা পাঠাও যে, যখন আমিয়টের নৌকা মুরশিদাবাদে উপনীত হইবে, তখন তাহাকে ধরিয়া আবদ্ধ করে, এবং তাহার সঙ্গের বন্দিগণকে মুক্ত করিয়া, হুজুরে প্রেরণ করে। স্পষ্ট না যুদ্ধ করিয়া কলেকৌশল ধরিতে হইবে, ইহাও লিখিয়া দিও। পরওয়ানা তটপথে বাহকের হাতে যাউক—অগ্রে পঁহুছিবে।
নবাব অন্তঃপুরে প্রত্যাগমন করিয়া আবার শৈবলিনীকে ডাকাইলেন। বলিলেন, “এক্ষণে তোমার স্বামীকে মুক্ত করা হইল না। ইংরেজেরা তাহাদিগকে লইয়া কলিকাতায় যাত্রা করিয়াছে। মুরশিদাবাদে হুকুম পাঠাইলাম যে, সেখানে তাহাদিগকে ধরিবে। তুমি এখন—”
শৈবলিনী হাত যোড় করিয়া কহিল, “বাচাল স্ত্রীলোককে মার্জনা করুন—এখন লোক পাঠাইলে ধরা যায় না কি?”
ন। ইংরেজদিগকে ধরা অল্প লোকের কর্ম নহে। অধিক লোক সশস্ত্রে পাঠাইতে হইলে, বড় নৌকা চাই। ধরিতে ধরিতে তাহারা মুরশিদাবাদ পৌঁছিবে। বিশেষ যুদ্ধের উদ্যোগ দেখিয়া, কি জানি যদি ইংরাজেরা আগে বন্দীদিগকে মারিয়া ফেলে। মুরশিদাবাদে সুচতুর কর্মচারীসকল আছে, তাহারা কলেকৌশলে ধরিবে।