চাকরাণী একটু নরম হইল। বলিল, “আচ্ছা জিজ্ঞাসা করিয়া আসি ।” এই বলিয়া সে শৈবলিনীকে জিজ্ঞাসা করিতে গেল যে, তিনি আলতা পরিবেন কিনা। যে কারণেই হউক, শৈবলিনী অন্যমনা হইবার উপায় চিন্তা করিতেছিলেন, বলিলেন, “আলতা পরিব ।” তখন রক্ষকদিগের অনুমতি লইয়া, দাসী নাপিতানীকে নৌকার ভিতর পাঠাইয়া দিল। সে স্বয়ং পূর্বমত পাকশালার নিকট নিযুক্ত রহিল।
নাপিতানী শৈবলিনীকে দেখিয়া আর একটু ঘোমটা টানিয়া দিল। এবং তাঁহার একটি চরণ লইয়া আলতা পরাইতে লাগিল। শৈবলিনী কিয়ৎকাল নাপিতানীকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। দেখিয়া দেখিয়া বলিলেন, “নাপিতানী, তোমার বাড়ী কোথা?”
নাপিতানী কথা কহিল না। শৈবলিনী আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “নাপিতানী, তোমার নাম কি?”
তথাপি উত্তর পাইলেন না।
“নাপিতানী, তুমি কাঁদচ?”
নাপিতানী মৃদু স্বরে বলিল, “না ।”
“হাঁ কাঁদচ ।” বলিয়া শৈবলিনী নাপিতানীর অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া দিলেন। নাপিতানী বাস্তবিক কাঁদিতেছিল। অবগুণ্ঠন মুক্ত হইলে নাপিতানী একটু হাসিল।
শৈবলিনী বলিলেন, “আমি আসতে মাত্র চিনেছি। আমরে কাছে ঘোমটা। মরণ আর কি? তা এখানে এলি কোথা হতে?”
নাপিতানী আর কেহ নহে—সুন্দরী ঠাকুরঝি। সুন্দরী চক্ষের জল মুছিয়া কহিল, “শীঘ্র যাও! আমার এই সাড়ী পর, ছাড়িয়া দিতেছি। এই আলতারর চুপড়ী নাও। ঘোমটা দিয়া নৌকা হইতে চলিয়া যাও ।”
শৈবলিনী বিমনা হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এলে কেমন করে?”
সু। কোথা হইতে আসিলাম—কেমন করিয়া আসিলাম—সে পরিচয়, দিন পাই ত এর পর দিব। তোমার সন্ধানে এখানে আসিয়াছি। লোকে বলিল, পাল্কী গঙ্গার পথে গিয়াছে। আমিও প্রাতে উঠিয়া কাহাকে কিছু না বলিয়া, হাঁটিয়া গঙ্গাতীরে আসিলাম।লোকে বলিল,বজরা উত্তরমুখে গিয়াছে। অনেক দূর, পা ব্যথা হইয়া গেল। তখন নৌকা ভাড়া করিয়া তোমার পাছে পাছে আসিয়াছি। তোমার বড় নৌকা—চলে না, আমার ছোট নৌকা, তাই শীঘ্র আসিয়া ধরিয়াছি।
শৈ। একলা এলি কেমন করে?
সুন্দরীর মুখে আসিল, “তুই কালামুখী সাহবের পাল্কী চড়ে এলি কেমন করে?” কিন্তু অসময় বুঝিয়া সে কথা বলিল না। বলিল, “একলা আসি নাই। আমার স্বামী আমার সঙ্গে আছেন। আমাদের ডিঙ্গী একটু দূরে রাখিয়া, আমি নাপিতানী সাজিয়া আসিয়াছি ।”
শৈ। তার পর?
সু। তার পর তুমি আমার এই সাড়ী পর, এই আলতাসর চুপড়ী নাও, ঘোম্টা দিয়া নৌকা হইতে নামিয়া চলিয়া যাও, কেহ চিনিতে পারিবে না। তীরে তীরে যাইবে। ডিঙ্গিতে আমার স্বামীকে দেখিবে। নন্দাই বলিয়া লজ্জা করিও না—ডিঙ্গীতে উঠিয়া বসিও। তুমি গেলেই তিনি ডিঙ্গী খুলিয়া দিয়া তোমায় বাড়ী লইয়া যাইবেন।
শৈবলিনী অনেক্ষণ চিন্তা করিলেন, পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তার পর তোমার দশা?”
সু। আমার জন্য ভাবিও না। বাঙালায় এমন ইংরেজ আসে নাই যে, সুন্দরী বামনীকে নৌকায় পুরিয়া রাখিতে পারে। আমরা ব্রাহ্মণের কন্যা, ব্রাহ্মণের স্ত্রী; আমরা মনে দৃঢ় থাকিলে পৃথিবীতে আমাদের বিপদ নাই। তুমি যাও, যে প্রকারে হয়, আমি রাত্রিমধ্যে বাড়ী যাইব। বিপত্তিভঞ্জন মধুসূদন আমার ভরসা। তুমি আর বিলম্ব করিও না—তোমার নন্দাইয়ের এখনও আহার হয় নাই। আজ হবে কিনা, তাও বলিতে পারি না।
শৈ। ভাল, আমি যেন গেলেম। গেলে, সেখানে আমায় ঘরে নেবেন কি?
সু। ইল—লো! কেন নেবেন না? না নেওয়াটা পড়ে রয়েছে আর কি?
শৈ। দেখ—ইংরেজে আমায় কেড়ে এনেছে—আর কি আমার জাতি আছে?
সুন্দরী বিস্মিতা হইয়া শৈবলিনীর মুখপানে চাহিয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। শৈবলিনীর প্রতি মর্মভেদী তীব্রদৃষ্টি করিতে লাগিল—ওষধিস্পৃষ্ট বিষধরের ন্যায় গর্বিতা শৈবলিনী মুখ নত করিল। সুন্দরী কিঞ্চিৎ পুরুষভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “সত্য কথা বলবি?”
শৈ। বলিব।
সু। এই গঙ্গার উপর?
শৈ। বলিব। তোমার জিজ্ঞাসার প্রয়োজন নাই, অমনি বলিতেছি। সাহেবের সঙ্গে আমার এ পর্যন্ত সাক্ষাৎ হয় নাই। আমাকে গ্রহণ করিলে আমার স্বামী ধর্মে পতিত হইবেন না।