দেবী চৌধুরাণী

তৃতীয় খণ্ড
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

যার লাঠির ভয়ে এত সিপাহীর সমাগম, তার কাছে একখানি লাঠিও ছিল না। নিকটে একটা লাঠিয়ালও ছিল না। দেবী সেই ঘাটে–যে ঘাটে বজরা বাঁধিয়া ব্রজেশ্বরকে বন্দী করিয়া আনিয়াছিল, সেই ঘাটে। সবে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে মাত্র। সেই বজরা তেমনই সাজান–সব ঠিক সে রকম নয়। সে ছিপখানি সেখানে নাই–তাহাতে যে পঞ্চাশ জন লাঠিয়াল ছিল, তাহারা নাই। তার পর বজরার উপরেও একটি পুরুষমানুষ নাই–মাঝি-মল্লা, রঙ্গরাজ প্রভৃতি কেহ নাই। কিন্তু বজরার মাস্তুল উঠান–চারিখানা পাল তোলা আছে–বাতাসের অভাবে পাল মাস্তুলে জড়ান পড়িয়া আছে। বজরার নোঙ্গরও ফেলা নহে, কেবল দুগাছা কাছিতে তীরে খোঁটায় বাঁধা আছে।

তৃতীয়, দেবী নিজে তেমন রত্নাভরণভূষিতা মহার্ঘবস্ত্রপরিহিতা নয়, কিন্তু আর এক প্রকারে শোভা আছে। ললাট, গণ্ড, বাহু, হৃদয়, সর্বাঙ্গ সুগন্ধি চন্দনে চর্চিত; চন্দনচর্চিত ললাট বেষ্টন করিয়া সুগন্ধি পুষ্পের মালা শিরোদেশের বিশেষ শোভা বৃদ্ধি করিয়াছে। হাতে ফুলের বালা। অন্য অলঙ্কার একখানিও নাই। পরণে সেই মোটা সাড়ি।

আর, আজ দেবী একা ছাদের উপর বসিয়া নহে, কাছে আর দুই জন স্ত্রীলোক বসিয়া। একজন নিশি, অপর দিবা। এই তিন জনে যে কথাটা হইতেছিল, তাহার মাঝখান হইতে বলিলেও ক্ষতি নাই।

দিবা বলিতেছিল–দিবা অশিক্ষিতা, ইহা পাঠকের স্মরণ রাখা উচিত–বলিতেছিল, “হাঁঃ, পরমেশ্বরকে না কি আবার প্রত্যক্ষ দেখা যায়?”

প্রফুল্ল বলিল, “না, প্রত্যক্ষ দেখা যায় না। কিন্তু আমি প্রত্যক্ষ দেখার কথা বলিতেছিলাম না–আমি প্রত্যক্ষ করার কথা বলিতেছিলাম। প্রত্যক্ষ ছয় রকম। তুমি যে প্রত্যক্ষ দেখার কথা কহিতেছিলে, সে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ–চক্ষের প্রত্যক্ষ। আমার গলার আওয়াজ তুমি শুনিতে পাইতেছ–আমার গলার আওয়াজ তোমার শ্রবণ প্রত্যক্ষ, অর্থাৎ কাণের প্রত্যক্ষের বিষয় হইতেছে। আমার হাতের ফুলের গন্ধ তোমার নাকে যাইতেছে কি?”

দি। যাইতেছে।

দেবী। ওটা তোমার ঘ্রাণজ প্রত্যক্ষ হইতেছে। আর আমি যদি তোমার গালে এক চড় মারি, তাহা হইলে তুমি আমার হাতকে প্রত্যক্ষ করিবে–সেটা ত্বাচ প্রত্যক্ষ। আর এখনি নিশি যদি তোমার মাথা খায়, তাহা হইলে তোমার মগজটা তার রাসন প্রত্যক্ষ হইবে।

দি। মন্দ প্রত্যক্ষ হইবে না। কিন্তু পরমেশ্বরকে দেখাও যায় না, শোনাও যায় না, শোঁকাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না, খাওয়াও যায় না। তাঁকে প্রত্যক্ষ করিব কি প্রকারে?

নি। এ ত গেল পাঁচ রকম প্রত্যক্ষ। ছয় রকম প্রত্যক্ষের কথা বলিয়াছি; কেন না, চক্ষু কর্ণ, নাসিকা, রসনা ও ত্বক ছাড়া আর একটা জ্ঞানেন্দ্রিয় আছে, জান না?

দি। কি, দাঁত?

নি। দূর হ, পোড়ারমুখী! ইচ্ছা করে, কিল মেরে তোর সে ইন্দ্রিয়ের পাটিকে পাটি ভেঙ্গে দিই।

দেবী। (হাসিতে হাসিতে) চক্ষুরাদি পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; হস্তপদাদি পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়, আর ইন্দ্রিয়াধিপতি মন উভয়েন্দ্রিয় অর্থাৎ মন জ্ঞানেন্দ্রিয় বটে, কর্মেন্দ্রিয়ও বটে। মনঃ জ্ঞানেন্দ্রিয় বলিয়া মনের দ্বারাও প্রত্যক্ষ আছে। ইহাকে মানস প্রত্যক্ষ বলে। ঈশ্বর মানস প্রত্যক্ষের বিষয়।

নি। “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ–প্রমাণাভাবাৎ।”

যিনি সাংখ্যপ্রবচনসূত্র ও ভাষ্য পড়িয়াছেন, তিনি নিশির এই ব্যঙ্গোক্তির মর্ম বুঝিবেন। নিশি প্রফুল্লের এক প্রকার সহাধ্যায়িনী ছিল।

প্রফুল্ল উত্তর করিল, “সুত্রকারস্যোভয়েন্দ্রিয়শূন্যত্বাৎ–ন তু প্রমাণাভবাৎ”।

দি। রেখে দাও তোমার হাবাৎ মাবাৎ–আমি ত পরমেশ্বরকে কখন মনের ভিতর দেখিতে পাই নাই।

প্র। আবার দেখা? চাক্ষুষ প্রত্যক্ষই দেখা–অন্য কোন প্রত্যক্ষ দেখা নয়,–মানস প্রত্যক্ষও দেখা নয়। চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের বিষয়–রূপ, বহির্বিষয়; মানস প্রত্যক্ষের বিষয়–অন্তর্বিষয়। মনের দ্বারা ঈশ্বর প্রত্যক্ষ হইতে পারেন। ঈশ্বরকে দেখা যায় না।

দি। কই? আমি ত ঈশ্বরকে কখনও মনের ভিতর কোন রকম প্রত্যক্ষ করি নাই?

প্র। মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যক্ষশক্তি অল্প–সাহায্য বা অবলম্বন ব্যতীত সকল বস্তু প্রত্যক্ষ করিতে পারে না।

দি। প্রত্যক্ষের জন্য আবার সাহায্য কি রকম? দেখ, এই নদী, জল, গাছ, পালা, নক্ষত্র, সকলই আমি বিনা সাহায্যে দেখিতে পাইতেছি।

‍ “সকলই নয়। ইহার একটি উদাহরণ দিব?” বলিয়া প্রফুল্ল হাসিল।

হাসির রকমটা দেখিয়া নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “কি?”

প্রফুল্ল বলিতে লাগিল, “ইংরেজের সিপাহী আমাকে আজ ধরিতে আসিতেছে জান?”

দিবা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, “তা ত জানি।”

প্র। সিপাহী প্রত্যক্ষ করিয়াছ?

দি। না। কিন্তু আসিলে প্রত্যক্ষ করিব।

প্র। আমি বলিতেছি, আসিয়াছে, কিন্তু বিনা সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছি না। এই সাহায্য গ্রহণ কর। এই বলিয়া প্রফুল্ল দিবার হাতে দূরবীক্ষণ দিল। ঠিক যে দিকে দেখিতে হইবে, দেখাইয়া দিল। দিবা দেখিল। দেবী জিজ্ঞাসা করিল, “কি দেখিলে?”

দি। একখানা ছিপ। উহাতে অনেক মানুষ দেখিতেছি বটে।

দেবী। উহাতে সিপাহী আছে। আর একখানা দেখ।

এরূপে দেবী দিবাকে পাঁচখানা ছিপ নানা স্থানে দেখাইল। নিশিও দেখিল। নিশি জিজ্ঞাসা করিল, “ছিপগুলি চরে লাগাইয়া আছে দেখিতেছি। আমাদের ধরিতে আসিয়াছে, কিন্তু আমাদের কাছে না আসিয়া ছিপ তীরে লাগাইয়া আছে কেন?”

দেবী। বোধ হয়, ডাঙ্গা-পথে যে সকল সিপাহী আসিবে, তাহারা আসিয়া পৌঁছে নাই। ছিপের সিপাহী তাহাদের অপেক্ষায় আছে। ডাঙ্গার সিপাহী আসিবার আগে, ছিপের সিপাহী আগু হইলে, আমি ডাঙ্গা-পথে পলাইতে পারি, এই শঙ্কায় উহারা আগু হইতেছে না।

দি। কিন্তু আমরা ত উহাদের দেখিতে পাইতেছি; মনে করিলেই ত পলাইতে পারি।

দেবী। ওরা ত জানে না। ওরা জানে না যে, আমরা দূরবীন রাখি।

নি। ভগিনি! প্রাণে বাঁচিলে এক দিন না এক দিন স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবেক। আজ ডাঙ্গায় উঠিয়া প্রাণরক্ষা করিবে চল। এখনও যদি ডাঙ্গায় সিপাহী আসে নাই, তবে ডাঙ্গা- পথে এখন প্রাণরক্ষার উপায় আছে।

দেবী। যদি প্রাণের জন্য আমি এত কাতর হইব, তবে আমি সকল সংবাদ জানিয়া শুনিয়া এখানে আসিলাম কেন? আসিলাম যদি, তবে লোকজন সবাইকে বিদায় দিলাম কেন? আমার হাজার বরকন্দাজ আছে–তাহাদের সকলকে অন্য স্থানে পাঠাইলাম কেন?

দি। আমরা আগে যদি জানিতাম, তাহা হইলে তোমায় এমন কর্ম করিতে দিতাম না।

দেবী। তোমার সাধ্য কি, দিবা! আমি স্থির করিয়াছি, তা অবশ্য করিব। আজ স্বামিদর্শন করিব, স্বামীর অনুমতি লইয়া জন্মান্তরে তাঁহাকে কামনা করিয়া প্রাণ সমর্পণ করিব। তোমরা আমার কথা শুনিও, দিবা নিশি! আমার স্বামী যখন ফিরিয়া যাইবেন, তখন তাঁহার নৌকায় উঠিয়া তাঁহার সঙ্গে চলিয়া যাইও। আমি একা ধরা দিব, আমি একা ফাঁসি যাব। সেই জন্যই বজরা হইতে আর সকলকে বিদায় দিয়াছি। তোমরা তখন গেলে না। কিন্তু আমায় এই ভিক্ষা দাও–আমার স্বামীর নৌকায় উঠিয়া পলায়ন করিও।

নি। ধড়ে প্রাণ থাকিতে তোমায় ছাড়িব না। মরিতে হয়, একত্র মরিব।

প্র। ও সকল কথা এখন থাক–যাহা বলিতেছিলাম, তা বলিয়া শেষ করিব। যাহা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছিলে না, তা যেমন দূরবীক্ষণের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিলে, তেমন ঈশ্বরকে মানস প্রত্যক্ষ করিতে দূরবীন চাই।

দি। মনের আবার দূরবীন কি?

প্র। যোগ।

দি। কি–সেই ন্যাস, প্রাণায়াম, কুম্ভক, বুজরুকি, ভেল্কি–

প্র। তাকে আমি যোগ বলি না। যোগ অভ্যাস মাত্র। কিন্তু সকল অভ্যাসই যোগ নয়। তুমি যদি দুধ ঘি খাইতে অভ্যাস কর, তাকে যোগ বলিব না। তিনটি অভ্যাসকেই যোগ বলি।

দি। কি কি তিনটি?

প্র। জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি। জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ।

তক্ষণ নিশি দূরবীন লইয়া এদিক ওদিক দেখিতেছিল। দেখিতে দেখিতে বলিল, “সম্প্রতি উপস্থিত গোলযোগ।”

প্র। সে আবার কি? আবার গোলযোগ কি?

নি। একখানা পান্‌সি আসিতেছে। বুঝি ইংরেজের চর।

প্রফুল্ল নিশির হাত হইতে দূরবীন লইয়া পান্‌সি দেখিল। বলিল, “এই আমার সুযোগ। তিনিই আসিতেছেন। তোমরা নীচে যাও।”

দিবা ও নিশি ছাদ হইতে নামিয়া কামরার ভিতর গেল। পান্‌সি ক্রমে বাহিয়া আসিয়া বজরার গায়ে লাগিল। সেই পান্‌সিতে–ব্রজেশ্বর। ব্রজেশ্বর, লাফাইয়া বজরায় উঠিয়া, পান্‌সি তফাতে বাঁধিয়া রাখিতে হুকুম দিলেন। পান্‌সিওয়ালা তাহাই করিল।

ব্রজেশ্বর নিকটে আসিল, প্রফুল্ল উঠিয়া দাঁড়াইয়া আনত মস্তকে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিল। পরে উভয়ে বসিলে, ব্রজেশ্বর বলিল, “আজ টাকা আনিতে পারি নাই, দুই চারি দিনে দিতে পারিব বোধ হয়। দুই চারি দিনের পরে কবে কোথায় তোমার সঙ্গে দেখা হইবে, সেটা জানা চাই।”

ও ছি! ছি! ব্রজেশ্বর! দশ বছরের পর প্রফুল্লের সঙ্গে এই কি কথা!

দেবী উত্তর করিল, “আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হইবে না–” বলিতে বলিতে দেবীর গলাটা বুজিয়া আসিল–দেবী একবার চোখ মুছিল –“আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না, কিন্তু আমার ঋণ শুধিবার অন্য উপায় আছে। যখন সুবিধা হইবে, ঐ টাকা গরীব-দুঃখীকে বিলাইয়া দিবেন–তাহা হইলে আমি পাইব।”

ব্রজেশ্বর দেবীর হাত ধরিল। বলিল, “প্রফুল্ল! তোমার টাকা–”

ছাই টাকা! কথা শেষ হইল না–মুখের কথা মুখে রহিল। যেমন ব্রজেশ্বর “প্রফুল্ল” বলিয়া ডাকিয়া হাত ধরিয়াছে, অমনি প্রফুল্লের দশ বছরের বাঁধা বাঁধ ভাঙ্গিয়া, চোখের জলের স্রোত ছুটিল। ব্রজেশ্বরের ছাই টাকার কথা সে স্রোতে কোথায় ভাসিয়া গেল। তেজস্বিনী দেবী রাণী ছেলেমানুষের মত বড় কান্নাটা কাঁদিল। ব্রজেশ্বর ততক্ষণ বড় বিপন্ন হইলেন। তাঁর মনে মনে বোধ আছে যে, এ পাপীয়সী ডাকাইতি করিয়া খায়, এর জন্য এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলা হবে না। কিন্তু চোখের জল, অত বিধি ব্যবস্থা অবগত নয়, তারা অনাহূত আসায় ব্রজেশ্বরের চোখ ভরিয়া গেল। ব্রজেশ্বর মনে করিলেন, হাত উঠাইয়া চোখ মুছিলেই ধরা পড়িব। কাজেই চোখ মোছা হইল না। চোখ যখন মোছা হইল না, তখন পুকুর ছাপাইল–গাল বাহিয়া ধারা চলিল–প্রফুল্লের হাতে পড়িল।

তখন বালির বাঁধটা ভাঙ্গিয়া গেল। ব্রজেশ্বর মনে করিয়া আসিয়াছিলেন যে, প্রফুল্লকে ডাকাইতি করার জন্য ভারী রকম তিরস্কার করিবেন, পাপীয়সী বলিবেন–আরও দুই চারিটা লম্বা চৌড়া কথা বলিয়া আবার একবার জন্মের মত ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন। কিন্তু কেঁদে যার হাত ভিজিয়ে দিলেন, তার উপর কি আর লম্বা চৌড়া কথা হয়?

তখন চক্ষু মুছিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “দেখ প্রফুল্ল, তোমার টাকা আমার টাকা–তার পরিশোধের জন্য আমি কেন কাতর হব? কিন্তু আমি বড় কাতরই হইয়াছি। আমি আজ দশ বৎসর কেবল তোমাকেই ভাবিয়াছি। আমার আর দুই স্ত্রী আছে–আমি তাহাদিগকে এ দশ বৎসর স্ত্রী মনে করি নাই; তোমাকেই স্ত্রী জানি। কেন, তা বুঝি তোমায় আমি বুঝাইতে পারিব না। শুনিয়াছিলাম, তুমি নাই। কিন্তু আমার পক্ষে তুমি ছিলে। আমি তার পরও মনে জানিতাম, তুমিই আমার স্ত্রী–মনে আর কাহারও স্থান ছিল না। বলবে না মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু বলাতেও ক্ষতি নাই–তুমি মরিয়াছ শুনিয়া, আমিও মরিতে বসিয়াছিলাম। এখন মনে হয়, মরিলেই ভাল হইত–না মরিয়াছিলে ত আমি মরিলেই ভাল হইত। এখন যাহা শুনিয়াছি, বুঝিয়াছি, তা শুনিতে হইত না, বুঝিতে হইত না। আজ দশ বৎসরের হারান ধন তোমায় পাইয়াছি, আমার স্বর্গসুখের অপেক্ষা অধিক সুখ হইত। তা না হয়ে প্রফুল্ল, আজ তোমায় পাইয়া মর্মান্তিক যন্ত্রণা।” তার পর একবার থামিয়া একটু ঢোক গিলিয়া, মাথা টিপিয়া ধরিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “মনের মন্দিরের ভিতর সোণার প্রতিমা গড়িয়া রাখিয়াছিলাম–আমার সেই প্রফুল্ল–মুখে আসে না–সেই প্রফুল্লের এই বৃত্তি!”

প্রফুল্ল বলিল, “কি? ডাকাইতি করি?”

ব্র। কর না কি?

ইহার উত্তরে প্রফুল্ল একটা কথা বলিতে পারিত। যখন ব্রজেশ্বরের পিতা প্রফুল্লকে জন্মের মত ত্যাগ করিয়া গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দেয়, তখন প্রফুল্ল কাতর হইয়া শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “আমি অন্নের কাঙ্গাল, তোমরা তাড়াইয়া দিলে–আমি কি করিয়া খাইব?” তাহাতে শ্বশুর উত্তর দিয়াছিলেন, “চুরি-ডাকাইতি করিয়া খাইও।” প্রফুল্ল মেধাবিনী–সে কথা ভুলে নাই। ভুলিবার কথাও নহে। আজ ব্রজেশ্বর প্রফুল্লকে ডাকাইত বলিয়া এই ভর্ৎসনা করিল; আজ প্রফুল্লের সেই উত্তর ছিল। প্রফুল্লের এই উত্তর ছিল, “আমি ডাকাইত বটে–তা এখন এত ভর্ৎসনা কেন? তোমরাই ত চুরি-ডাকাইতি করিয়া খাইতে বলিয়াছিলে। আমি গুরুজনের আজ্ঞা পালন করিতেছি।” এ উত্তর সম্বরণ করাই যথার্থ পুণ্য। প্রফুল্ল সে পুণ্য সঞ্চয় করিল, – সে কথা মুখেও আনিল না। প্রফুল্ল স্বামীর কাছে হাত জোড় করিয়া এই উত্তর দিল। বলিল, “আমি ডাকাইত নই। আমি তোমার কাছে শপথ করিতেছি, আমি কখন ডাকাইতি করি নাই। কখন ডাকাইতির এক কড়া লই নাই। তুমি আমার দেবতা। আমি অন্য দেবতার অর্চনা করিতে শিখিতেছিলাম–শিখিতে পারি নাই; তুমি সব দেবতার স্থান অধিকার করিয়াছ–তুমিই একমাত্র আমার দেবতা। আমি তোমার কাছে শপথ করিতেছি–আমি ডাকাইত নই। তবে জানি, লোকে আমাকে ডাকাইত বলে। কেন বলে, তাও জানি। সেই কথা তোমাকে আমার কাছে শুনিতে হইবে। সেই কথা শুনাইব বলিয়াই আজ এখানে আসিয়াছি। আজ না শুনিলে, আর শুনা হইবে না। শোন, আমি বলি।”

তখন যে দিন প্রফুল্ল শ্বশুরালয় হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছিল, সেই দিন হইতে আজ পর্যন্ত আপনার কাহিনী সকলই অকপটে বলিল। শুনিয়া ব্রজেশ্বর বিস্মিত, লজ্জিত, অতিশয় আহ্লাদিত, আর মহামহিমময়ী স্ত্রীর সমীপে কিছু ভীত হইলেন। প্রফুল্ল সমাপন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমার এ কথাগুলিতে বিশ্বাস করিলে কি?”

অবিশ্বাসের জায়গা ছিল না–প্রফুল্লের প্রতি কথা ব্রজেশ্বরের হাড়ে হাড়ে বসিয়াছিল। ব্রজেশ্বর উত্তর করিতে পারিল না–কিন্তু তাহার আনন্দপূর্ণ কান্তি দেখিয়া প্রফুল্ল বুঝিল, বিশ্বাস হইয়াছে। তখন প্রফুল্ল বলিতে লাগিল, “এখন পায়ের ধূলা দিয়া এ জন্মের মত আমায় বিদায় দাও। আর এখানে বিলম্ব করিও না–সম্মুখে কোন বিঘ্ন আছে। তোমায় এই দশ বৎসরের পর পাইয়া এখনই উপযাচিকা হইয়া বিদায় দিতেছি, ইহাতেই বুঝিবে যে, বিঘ্ন বড় সামান্য নহে। আমার দুইটি সখী এই নৌকায় আছে। তাহারা বড় গুণবতী, আমিও তাহাদের বড় ভালবাসি। তোমার নৌকায় তাহাদের লইয়া যাও। বাড়ী পৌঁছিয়া, তারা যেখানে যাইতে চায়, সেইখানে পাঠাইয়া দিও। আমায় যেমন মনে রাখিয়াছিলে, তেমনি মনে রাখিও। সাগর যেন আমায় না ভুলে।”

ব্রজেশ্বর ক্ষণেক কাল নীরবে ভাবিল। পরে বলিল, “আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, প্রফুল্ল! আমায় বুঝাইয়া দাও। তোমার এত লোক–কেহ নাই! বজরার মাঝিরা পর্যন্ত নাই! কেবল দুইটি স্ত্রীলোক আছে, তাদেরও বিদায় করিতে চাহিতেছ। সম্মুখে বিঘ্ন বলিতেছ–আমাকে থাকিতে নিষেধ করিতেছ। আর এ জন্মে সাক্ষাৎ হইবে না বলিতেছ। এ সব কি? সম্মুখে কি বিঘ্ন আমাকে না বলিলে, আমি যাইব না। বিঘ্ন কি, শুনিলেও যাইব কি না, তাও বলিতে পারি না।”

প্র। সে সব কথা তোমার শুনিবার নয়।

ব্র। তবে আমি কি তোমার কেহ নই?

এমন সময় দুম্ করিয়া একটা বন্দুকের শব্দ হইল।

0 Shares