মৃণালিনী

তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : উপনয়-বহ্নিব্যাপ্যো ধূমবান্

গিরিজায়া গীত গায়িল,

“কাহে সই জীয়ত মরত কি বিধান?

ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই,

ব্রজজন টুটায়ল পরাণ |”

সঙ্গীতধ্বনি হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ করিল। স্বপ্নশ্রুত শব্দের ন্যায় কর্ণে প্রবেশ করিল।

গিরিজায়া আবার গায়িল,

“ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই,

ব্রজবধূ টুটায়ল পরাণ |”

হেমচন্দ্র উন্মুখ হইয়া শুনিতে লাগিলেন।

গিরিজায়া আবার গায়িল,

“মিলি সেই নাগরী, ভুলি সেই মাধব,

রূপবিহীন গোপকুঙারী।

কো জানে পিয় সই, রসময় প্রেমিক,

হেন বঁধূ রূপকি ভিখারী ||”

হেমচন্দ্র কহিলেন, “এ কি! মনোরমা, এ যে গিরিজায়ার স্বর! আমি চলিলাম |” এই বলিয়া লম্ফ দিয়া হেমচন্দ্র শয্যা হইতে অবতরণ করিলেন। গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,

“আগে নাহি বুঝনু, রূপ দেখি ভুলনু,

হৃদি বৈনু চরণ যুগল।

যমুনা-সলিলে সই, তব তনু ডারব,

আন সখি ভখিব গরল ||”

হেমচন্দ্র গিরিজায়ার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। ব্যস্ত স্বরে কহিলেন, “গিরিজায়া। এ কি গিরিজায়া! তুমি এখানে? তুমি এখানে কেন? তুমি এ দেশে কবে আসিলে?”

গিরিজায়া কহিল, “আমি এখানে অনেক দিন আসিয়াছি |” এই বলিয়া আবার গায়িতে লাগিল,

“কিবা কাননবল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই,

নবীন তমালে দিব ফাঁস |”

হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি এ দেশে কেন এলে?”

গিরিজায়া কহিল, “ভিক্ষা আমার উপজীবিকা। রাজধানীতে অধিক ভিক্ষা পাইব বলিয়া আসিয়াছি-

কিবা কাননবল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই,

নবীন তমালে দিব ফাঁস |”

হেমচন্দ্র গীতে কর্ণপাত না করিয়া কহিলেন, “মৃণালিনী কেমন আছে; দেখিয়া আসিয়াছ?

গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,

“নহে-শ্যাম শ্যাম শ্যাম, শ্যাম নাম জপয়ি,

ছার তনু করব বিনাশ |”

হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার গীত রাখ। আমার কথার উত্তর দাও! মৃণালিনী কেমন আছে, দেখিয়া আসিয়াছ?”

গিরিজায়া কহিল, “মৃণালিনীকে আমি দেখিয়া আসি নাই। এ গীত আপনার ভাল না লাগে, অন্য গীত গায়িতেছি।

এ জনমের সঙ্গে কি সই জনমের সাধ ফুরাইবে।

কিবা জন্ম জন্মান্তরে, এ সাধ মোর পুরাইবে ||”

হেমচন্দ্র কহিলেন, “গিরিজায়া তোমাকে মিনতি করিতেছি-গান রাখ, মৃণালিনীর সংবাদ বল |”

গি। কি বলিব?

হে। মৃণালিনীকে কেন দেখিয়া আইস নাই?

গি। গৌড়নগরে তিনি নাই।

হে। কেন? কোথায় গিয়াছেন?

গি। মথুরায়।

হে। মথুরায়? মথুরায় কাহার সঙ্গে গেলেন? কি প্রকারে গেলেন? কেন গেলেন?

গি। তাঁহার পিতা কি প্রকারে সন্ধান পাইয়া লোক পাঠাইয়া লইয়া গিয়াছেন। বুঝি তাঁহার বিবাহ উপস্থিত। বুঝি বিবাহ দিতে লইয়া গিয়াছেন।

হে। কি? কি করিতে?

গি। মৃণালিনীর বিবাহ দিতে তাঁহার পিতা তাঁহাকে লইয়া গিয়াছেন।

হেমচন্দ্র মুখ ফিরাইলেন। গিরিজায়া সে মুখ দেখিতে পাইল না; আর যে হেমচন্দ্রের স্কন্ধস্থ ক্ষতমুখ ছুটিয়া বন্ধনবস্ত্র রক্তে প্লাবিত হইতেছিল, তাহাও দেখিতে পাইল না। সে পূর্বমত গায়িল,

“বিধি তোরে সাধি শুন, জন্ম যদি দিবে পুন,

আমারে আবার যেন, রমণী জনম দিবে।

লাজ ভয় তেয়াগিব এ সাধ মোর পুরাইব,

সাগর ছেঁচে রতন নিব, কণ্ঠে রাখব নিশি দিবে ||”

হেমচন্দ্র মুখ ফিরাইলেন। বলিলেন, “গিরিজায়া, তোমার সংবাদ শুভ। উত্তম হইয়াছে |”

এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে পুন: প্রবেশ করিলেন। গিরিজায়ার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। গিরিজায়া মনে করিয়াছিল, মিছা করিয়া মৃণালিনীর বিবাহের কথা বলিয়া সে হেমচন্দ্রের পরীক্ষা করিয়া দেখিবে। মনে করিয়াছিল যে, মৃণালিনী বিবাহ উপস্থিত শুনিয়া হেমচন্দ্র বড় কাতর হইবে, বড় রাগ করিবে। কৈ, তা ত কিছুই হইল না। তখন গিরিজায়া কপালে করাঘাত করিয়া ভাবিল, “হায় কি করিলাম! কেন অনর্থক মিথ্যা কথা রটনা করিলাম। হেমচন্দ্র ত সুখী হইল দেখিতেছি – বলিয়া গেল – সংবাদ শুভ। এখন ঠাকুরাণীর দশা কি হইবে?” হেমচন্দ্র যে কেন গিরিজায়াকে বলিলেন, তোমার সংবাদ শুভ, তাহা, গিরিজায়া ভিখারিণী বৈ ত নয়-কি বুঝিবে? যে ক্রোধভরে, হেমচন্দ্র, এই মৃণালিনীর জন্য গুরুদেবের প্রতি শরসন্ধানে উদ্যত হইয়াছিলেন, সেই দুর্জয় ক্রোধ হৃদয়মধ্যে সমুদিত হইল। অভিমানাধিক্যে দুর্দম ক্রোধাবেগে, হেমচন্দ্র গিরিজায়াকে বলিলেন, “তোমার সংবাদ শুভ!”

গিরিজায়া তাহা বুঝিতে পারিল না। মনে করিল, এই ষষ্ঠ লক্ষণ। কেহ তাহাকে ভিক্ষা দিল না; সেও ভিক্ষার প্রতীক্ষা করিল না। “শিকলী কাটিয়াছে” সিদ্ধান্ত করিয়া গৃহাভিমুখে চলিল।

0 Shares