রজনী

আর যিনি পুরা একখানি গৃহিণী, তাঁহার নাম লবঙ্গলতা। লবঙ্গলতা লোকে বলিত, কিন্তু তাঁহার পিতা নাম রাখিয়াছিলেন ললিতলবঙ্গলতা, এবং রামসদয় বাবু আদর করিয়া বলিতেন-ললিত-লবঙ্গলতা-পরিশীলন-কোমল-মলয়-সমীরে। রামসদয় বাবু প্রাচীন, বয়:ক্রম ৬৩ বৎসর। ললিতলবঙ্গলতা নবীনা, বয়স ১৯ বৎসর, দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী-আদরের আদরিণী, গৌরবের গৌরবিণী, মানের মানিনী, নয়নের মণি, ষোলআনা গৃহিণী। তিনি রামসদয়ের সিন্দুকের চাবি, বিছানার চাদর, পানের চূণ, গেলাসের জল। তিনি রামসদয়ের জ্বরে কুইনাইন, কাসিতে ইপিকা, বাতে ফ্লানেল এবং আরোগ্যে সুরুয়া।

নয়ন নাই-ললিত-লবঙ্গ-লতাকে কখন দেখিতে পাইলাম না-কিন্তু শুনিয়াছি, তিনি রূপসী। রূপ যাউক, গুণ শুনিয়াছি। লবঙ্গ বাস্তবিক গুণবতী। গৃহকার্যে নিপুণা, দানে মুক্তহস্তা, হৃদয়ে সরলা, কেবল বাক্যে বিষময়ী। লবঙ্গলতার অশেষ গুণের মধ্যে, একটি এই যে, তিনি বাস্তবিক পিতামহের তুল্য সেই স্বামীকে ভালবাসিতেন-কোন নবীনা নবীন স্বামীকে সেরূপ ভালবাসেন কি না সন্দেহ। ভালবাসিতেন বলিয়া, তাঁহাকে নবীন সাজাইতেন-সে সজ্জার রস কাহাকে বলি? আপন হস্তে নিত্য শুভ্র কেশে কলপ মাখাইয়া কেশগুলি রঞ্জিত করিতেন। যদি রামসদয় লজ্জার অনুরোধে কোন দিন মলমলের ধুতি পরিত, স্বহস্তে তাহা ত্যাগ করাইয়া কোকিলপেড়ে, ফিতেপেড়ে, কল্কাপেড়ে পরাইয়া দিতেন-মলমলের ধুতিখানি তৎক্ষণাৎ বিধবা দরিদ্রগণকে বিতরণ করিতেন। রামসদয় প্রাচীন বয়সে, আতরের শিশি দেখিলে ভয়ে পলাইত-লবঙ্গলতা, তাহার নিদ্রিতাবস্থায় সর্বাঙ্গে আতর মাখাইয়া দিতেন। রামসদয়ের চশমাগুলি লবঙ্গ প্রায় চুরি করিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিত, সোণাটুকু লইয়া, যাহার কন্যার বিবাহের সম্ভাবনা, তাহাকে দিত। রামসদয়ের নাক ডাকিলে, লবঙ্গ ছয়গাছা মল বাহির করিয়া, পরিয়া ঘরময় ঝম‍ঝম করিয়া, রামসদয়ের নিদ্রা ভাঙ্গিয়া দিত।

লবঙ্গলতা আমাদের ফুল কিনিত-চারি আনার ফুল লইয়া দুই টাকা মূল্য দিত। তাহার কারণ, আমি কাণা। মালা পাইলে, লবঙ্গ গালি দিত, বলিত, এমন কদর্য মালা আমাকে দিস কেন? কিন্তু মূল্য দিবার সময় ডবল পয়সার সঙ্গে ভুল করিয়া টাকা দিত। ফিরাইয়া দিতে গেলে বলিত-ও আমার টাকা নয়-দুই বার বলিতে গেলে গালি দিয়া তাড়াইয়া দিত। তাহার দানের কথা মুখে আনিলে মারিতে আসিত। বাস্তবিক, রামসদয় বাবুর ঘর না থাকিলে, আমাদিগের দিনপাত হইত না; তবে যাহা রয় সয়, তাই ভাল বলিয়া, মাতা, লবঙ্গের কাছে অধিক লইতেন না। দিনপাত হইলেই আমরা সন্তুষ্ট থাকিতাম। লবঙ্গলতা আমাদিগের নিকট রাশি রাশি ফুল কিনিয়া রামসদয়কে সাজাইত। সাজাইয়া বলিত-দেখ, রতিপতি। রামসদয় বলিত-দেখ, সাক্ষাৎ-অঞ্জনানন্দন। সেই প্রাচীনে নবীনে মনের মিল ছিল-দর্পণের মত দুইজনে দুইজনের মন দেখিতে পাইত। তাহাদের প্রেমের পদ্ধতিটা এইরূপ-

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

রামসদয় বলিত, “ললিতলবঙ্গলতাপরিশী-?”

ল। আজ্ঞে ঠাকুরদাদামহাশয়, দাসী হাজির।

রা। আমি যদি মরি?

ল। আমি তোমার বিষয় খাইব | লবঙ্গ মনে মনে বলিত,“আমি বিষ খাইব |” রামসদয় তাহা মনে মনে জানিত।

লবঙ্গ এত টাকা দিত, তবে বড়বাড়ীতে ফুল যোগান দু:খ কেন? শুন।

একদিন মার জ্বর। অন্ত:পুরে বাবা যাইতে পারিবেন না-তবে আমি বৈ আর কে লবঙ্গলতাকে ফুল দিতে যাইবে? আমি লবঙ্গের জন্য ফুল লইয়া চলিলাম। অন্ধ হই, যাই হই-কলিকাতার রাস্তা সকল আমার নখদর্পণে ছিল। বেত্রহস্তে সর্বত্র যাইতে পারিতাম, তখন গাড়ি ঘোড়ার সম্মুখে পড়ি নাই। অনেক বার পদচারীর ঘাড়ে পড়িয়াছি বটে-তাহার কারণ, কেহ কেহ অন্ধ যুবতী দেখিয়া সাড়া দেয় না, বরং বলে, “আ মলো! দেখতে পাসনে? কাণা না কি?” আমি ভাবিতাম, “উভয়ত:|”

ফুল লইয়া গিয়া লবঙ্গের কাছে গেলাম। দেখিয়া লবঙ্গ বলিলেন, “কি লো কাণি-আবার ফুল লইয়া মরতে এয়েছিস কেন?” কাণী বলিলে আমার হাড় জ্বলিয়া যাইত-আমি কি কদর্য উত্তর দিতে যাইতেছিলাম, এমত সময়ে সেখানে হঠাৎ কাহার পদধ্বনি শুনিলাম-কে আসিল। যে আসিল-বলিল, “এ কে ছোট মা?”

ছোট মা! তবে রামসদয়ের পুত্র। রামসদয়ের কোন্ পুত্র! বড় পুত্রের কণ্ঠ একদিন শুনিয়াছিলাম-সে এমন অমৃতময় নহে-এমন করিয়া কর্ণবিবর ভরিয়া, সুখ ঢালিয়া দেয় নাই। বুঝিলাম, এ ছোট বাবু।

ছোট মা বলিলেন, এবার বড় মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, “ও কাণা ফুলওয়ালী |”

“ফুলওয়ালী! আমি বলি বা কোন ভদ্রলোকের মেয়ে।”

লবঙ্গ বলিলেন, “কেন গা, ফুলওয়ালী হইলে কি ভদ্রলোকের মেয়ে হয় না?”

ছোট বাবু অপ্রতিভ হইলেন। বলিলেন, “হবে না কেন? এটি ত ভদ্রলোকের মেয়ের মতই বোধ হইতেছে। তা ওটি কাণা হইল কিসে?”

ল। ও জন্মান্ধ।

ছোট বাবু। দেখি?

ছোট বাবুর বিদ্যার গৌরব ছিল। তিনি অন্যান্য বিদ্যাও যেরূপ যত্নের সহিত শিক্ষা করিয়াছিলেন, অর্থের প্রত্যাশী না হইয়া চিকিৎসাশাস্ত্রেও সেইরূপ যত্ন করিয়াছিলেন। লোকে রাষ্ট্র করিত যে, শচীন্দ্র বাবু (ছোট বাবু) কেবল দরিদ্রগণের বিনামূল্যে চিকিৎসা করিবার জন্য চিকিৎসা শিখিতেছিলেন। “দেখি” বলিয়া আমাকে বলিলেন, “একবার দাঁড়াও ত গা!”

আমি জড়সড় হইয়া দাঁড়াইলাম।

ছোট বাবু বলিলেন, “আমার দিকে চাও |”

চাব কি ছাই!

“আমার দিকে চোখ ফিরাও!”

কাণা চোখে শব্দভেদী বাণ মারিলাম। ছোট বাবুর মনের মত হইল না। তিনি আমার দাড়ি ধরিয়া, মুখ ফিরাইলেন।

ডাক্তারির কপালে আগুন জ্বেলে দিই। সেই চিবুকস্পর্শে আমি মরিলাম!

সেই স্পর্শ পুষ্পময়। সেই স্পর্শে যূথী, জাতি, মল্লিকা, শেফালিকা, কামিনী, গোলাপ, সেঁউতি-সব ফুলের ঘ্রাণ পাইলাম। বোধ হইল, আমার আশেপাশে ফুল, আমায় মাথায় ফুল, পায়ে ফুল, আমার পরনে ফুল, আমার বুকের ভিতর ফুলের রাশি। আ মরি মরি! কোন্ বিধাতা এ কুসুমময় স্পর্শ গড়িয়াছিল! বলিয়াছি ত কাণার সুখদু:খ তোমরা বুঝিবে না। আ মরি মরি-সে নবনীত-সুকুমার-পুষ্পগন্ধময় বীণাধ্বনিবৎ স্পর্শ! বীণাধ্বনিবৎ স্পর্শ, যার চোখ আছে, সে বুঝিবে কি প্রকারে? আমার সুখদু:খ আমাতেই থাকুক। যখন সেই স্পর্শ মনে পড়িত, তখন কত বীণাধ্বনি কর্ণে শুনিতাম, তাহা তুমি, বিলোলকটাক্ষকুশলিনি! কি বুঝিবে?

ছোট বাবু বলিলেন, “না, এ কাণা সারিবার নয় |”

আমার ত সেইজন্য ঘুম হইতেছিল না।

লবঙ্গ বলিল, “তা না সারুক, টাকা খরচ করিলে কাণার কি বিয়ে হয় না?”

ছোট বাবু। কেন, এর কি বিবাহ হয় নাই?

ল। না। টাকা খরচ করিলে হয়?

ছোট বাবু। আপনি কি ইহার বিবাহ জন্য টাকা দিবেন?

0 Shares