রজনী

মালী বৌ রাগে গর গর করিতে লাগিল। সত্য বলিতেছি, আমার কিছুই রাগ হয় নাই। মালী বৌ একটু রাগ সামলাইয়া বলিল, “অমর বাবু আমার জামাই হইলেই বিষয় অমর বাবুর হইবে। তিনি টাকা দিয়া মোকদ্দমা করিতে পারেন, তাঁহার এমন শক্তি আছে |”

এই বলিয়া মালী বৌ উঠিয়া যায়, আমি তাহার আঁচল ধরিয়া বসাইলাম। মালী বৌ হাসিয়া বসিল। আমি বলিলাম, “অমর বাবু মোকদ্দমা করিয়া বিষয় লইলে তোমার কি উপকার?”

মালী বৌ। আমার মেয়ের সুখ হবে।

আমি। আর আমার ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে হলে বুঝি বড় দু:খ হবে?

মালী বৌ। তা কেন? তবে যেখানে থাকে, আমার মেয়ে সুখী হইলেই হইল।

আমি। তোমাদের নিজের কিছু সুখ চাহি না?

মালী বৌ। আমাদের আবার কি সুখ? মেয়ের সুখই আমাদের সুখ।

আমি। ঘটকালীটা?

মালী বৌ মুখ মুচকিয়া হাসিল। বলিল, “আসল কথা বলিব মা ঠাকুরাণি? এখানে বিয়ের মেয়ের মত নাই |”

আমি। সে কি? কি বলে?

মালী বৌ। এখানকার কথা হইলেই বলে, কাণার আবার বিয়ের কাজ কি?

আমি। আর অমরনাথের সঙ্গে বিয়ের কথা হইলে?

মালী বৌ। বলে, ওঁ হতে আমাদের সব। উনি যা বলিবেন, তাই করিতে হইবে।

আমি। তা বিয়ের কন্যার আবার মতামত কি? মা-বাপের মতামত হইলেই হইল।

মালী বৌ। রজনী ত ক্ষুদে মেয়ে নয়, আর আমার পেটের সন্তানও নয়। আর বিষয় তার, আমাদের নয়। সে আমাদের হাঁকাইয়া দিলে আমরা কি করিতে পারি? বরং তার মত রাখিয়াই আমাদের এখন চলিতে হইতেছে।

আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম-“রজনীর সঙ্গে অমরনাথের দেখাশুনা হয় কি?”

মালী বৌ। না। অমর বাবু দেখা করেন না।

আমি। আমার সঙ্গে রজনীর একবার দেখা হয় না কি?

মালী বৌ। আমারও তাই ইচ্ছা। আপনি যদি তাহাকে বুঝাইয়া পড়াইয়া তাহার মত করাইতে পারেন। আপনাকে রজনী বিশেষ ভক্তি শ্রদ্ধা করে।

আমি। তা চেষ্টা করিয়া দেখিব। কিন্তু রজনীর দেখা পাই কি প্রকারে? কাল তাহাকে এ বাড়ীতে একবার পাঠাইয়া দিতে পার?

মালী বৌ। তার আটক কি? সে ত এই বাড়ীতেই খাইয়া মানুষ। কিন্তু যার বিয়ের সম্বন্ধ হইতেছে, তাহাকে কি শ্বশুরবাড়ীতে অমন অদিনে অক্ষণে বিয়ের আগে আসিতে আছে?

মর মাগী! আবার কাচ! কি করি, আমি অন্য উপায় না দেখিয়া বলিলাম, “আচ্ছা, রজনী না আসিতে পারে, আমি একবার তোমাদের বাড়ী যাইতে পারি কি?

মালী বৌ। সে কি! আমাদের কি এমন ভাগ্য হইবে যে, আপনার পায়ের ধূলা আমাদের বাড়ীতে পড়িবে?

আমি। কুটুম্বিতা হইলে আমার কেন, অনেকেরই পড়িবে। তুমি আমাকে আজ নিমন্ত্রণ করিয়া যাও।

মালী বৌ। তা আমাদের বাড়ীতে আপনাকে পাঠাইতে কর্তার মত হইবে কেন?

আমি। পুরুষ মানুষের আবার মতামত কি? মেয়ে মানুষের যে মত, পুরুষ মানুষেরও সেই মত।

মালী বৌ যোড়হাত করিয়া হাসিতে হাসিতে বিদায় গ্রহণ করিল।

চতুর্থ খণ্ড
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : অমরনাথের কথা

রজনীর সম্পত্তির উদ্ধার জন্য আমার এত কষ্ট সফল হইয়াছে, মিত্রেরাও নির্বিবাদে বিষয় ছাড়িয়া দিয়াছে, তথাপি বিষয়ে দখল লওয়া হয় নাই, ইহা শুনিয়া অনেকে চমৎকৃত হইতে পারেন। তাহাতে আমিও কিছু বিস্মিত। বিষয় আমার নহে, আমি দখল লইবার কেহ নহি। বিষয় রজনীর, সে দখল না লইলে কে কি করিতে পারে? কিন্তু রজনী কিছুতেই বিষয়ে দখল লইতে সম্মত নহে। বলে-আজ নহে-আর দুই দিন যাক-পশ্চাৎ দখল লইবেন ইত্যাদি। দখল না লউক-কিন্তু দরিদ্রকন্যার ঐশ্বর্যে এত অনাস্থা কেন, আমি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। রাজচন্দ্র এবং রাজচন্দ্রের স্ত্রীও এ বিষয়ে রজনীকে অনুরোধ করিয়াছে, কিন্তু রজনী বিষয়ে সম্প্রতি দখল লইতে চায় না। ইহার মর্ম কি? কাহার জন্য এত পরিশ্রম করিলাম?

ইহার যা হয়, একটা চূড়ান্ত স্থির করিবার জন্য আমি রজনীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। রজনীর সঙ্গে আমার বিবাহের কথা উত্থাপিত হওয়া অবধি আমি আর রজনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে বড় যাইতাম না-কেন না, এখন আমাকে দেখিলে রজনী কিছু লজ্জিতা হইত। কিন্তু আজ না গেলে নয় বলিয়া রজনীর কাছে গেলাম। সে বাড়ীতে আমার অবারিত দ্বার। আমি রজনীর সন্ধানে তাহার ঘরে গিয়া তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। ফিরিয়া আসিতেছি, এমত সময়ে দেখিতে পাইলাম, রজনী আর একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে উপরে উঠিতেছে। সে স্ত্রীলোককে দেখিয়াই চিনিলাম-অনেকদিন দেখি নাই, কিন্তু দেখিয়াই চিনিলাম যে, ঐ গজেন্দ্রগামিনী ললিতলবঙ্গলতা!

রজনী ইচ্ছাপূর্বক জীর্ণ বস্ত্র পরিয়াছিল, লজ্জায় সে লবঙ্গলতার সঙ্গে ভাল করিয়া কথা কহিতেছিল না। লবঙ্গলতা হাসিতে উছলিয়া পড়িতেছিল-রাগ বা বিদ্বেষের কিছুমাত্র লক্ষণ দেখা গেল না।

সে হাসি অনেকদিন শুনি নাই। সে হাসি তেমনই ছিল-পূর্ণিমার সমুদ্রে ক্ষুদ্র তরঙ্গের তুল্য, সুপুষ্প বসন্তলতার আন্দোলন তুল্য-তাহা হইতে সুখ, ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া, ঝরিয়া পড়িতেছিল।

আমি অবাক হইয়া নিষ্পন্দশরীরে, সশঙ্কচিত্তে, এই বিচিত্রচরিত্রা, রমণীর মানসিক শক্তির আলোচনা করিতেছিলাম। ললিতলবঙ্গলতা কিছুতেই টলে না। লবঙ্গলতা মহান ঐশ্বর্য হইতে দারিদ্র্যে পড়িয়াছে-তবু সেই সুখময় হাসি; যে রজনী হইতে এই ঘোর বিপদ ঘটিয়াছে, তাহারই গৃহে উঠিতেছে, তাহার সঙ্গে আলাপ করিতেছে, তবু সেই সুখময় হাসি। আমি সম্মুখে-তবু সেই সুখময় হাসি! অথচ আমি জানি, লবঙ্গ কোন কথাই ভুলে নাই।

আমি সরিয়া পার্শ্বের ঘরে গেলাম। লবঙ্গলতা প্রথমে সেই ঘরে প্রবেশ করিল-নি:শঙ্কচিত্তে, আজ্ঞাদায়িনী রাজরাজেশ্বরীর ন্যায় রজনীকে বলিল, “রজনি-তুই এখন আর কোথাও যা! তোর বরের সঙ্গে আমার গোপনে কিছু কথা আছে। ভয় নাই! তোর বর সুন্দর হলেও আমার বৃদ্ধ স্বামীর অপেক্ষা সুন্দর নহে |” রজনী অপ্রতিভ হইয়া, কি ভাবিতে ভাবিতে সরিয়া গেল।

ললিতলবঙ্গলতা, ভ্রূকুটি কুটিল করিয়া, সেই মধুর হাসি হাসিয়া, ইন্দ্রাণীর মত আমার সম্মুখে দাঁড়াইল। একবার বৈ কেহ অমরনাথকে আত্মবিস্মৃত দেখে নাই। আবার আত্মবিস্মৃত হইলাম। সেবারও ললিতলবঙ্গলতা-এবারও ললিতলবঙ্গলতা।

লবঙ্গ হাসিয়া বলিল, “আমার মুখপানে চাহিয়া কি দেখিতেছ? তোমার অর্জিত ঐশ্বর্য কাড়িয়া লইতে আসিয়াছি কি না? মনে করিলে তাহা পারি |”

0 Shares