রজনী

হইবে না কেন, কিন্তু সে কেবল আমার যন্ত্রণার জন্য। বোবার কবিত্ব, কেবল তাহার যন্ত্রণার জন্য। বধিরের সঙ্গীতানুরাগ যদি হয়, কেবল তাহার যন্ত্রণার জন্য; আপনার গীত আপনি শুনিতে পায় না। আমার হৃদয়ে প্রণয়সঞ্চার তেমনই যন্ত্রণার জন্য। পরের রূপ দেখিব কি-আমি আপনার কখন আপনি দেখিলাম না। রূপ! রূপ! আমার কি রূপ! এই ভূমণ্ডলে রজনীনামে ক্ষুদ্র বিন্দু কেমন দেখায়? আমাকে দেখিলে, কখনও কি কাহার আবার ফিরিয়া দেখিতে ইচ্ছা হয় নাই? এমন নীচাশয়, ক্ষুদ্র কেহ কি জগতে নাই যে, আমাকে সুন্দর দেখে? নয়ন না থাকিলে নারী সুন্দরী হয় না-আমার নয়ন নাই-কিন্তু তবে কারিগরে পাথর খোদিয়া চক্ষু:শূন্য মূর্তি গড়ে কেন? আমি কি কেবল সেইরূপ পাষাণী মাত্র? তবে বিধাতা এ পাষাণমধ্যে এ সুখদু:খসমাকুল প্রণয়ালালসাপরবশ হৃদয় কেন পুরিল? পাষাণের দু:খ পাইয়াছি, পাষাণের সুখ পাইলাম না কেন? এ সংসারে এ তারতম্য কেন? অনন্ত দুষ্কৃতিকারীও চক্ষে দেখে আমি জন্মপূর্বেই কোন্ দোষ করিয়াছিলাম যে, আমি চক্ষে দেখিতে পাইব না? এ সংসারে বিধাতা নাই, বিধান নাই, পাপপুণ্যের দণ্ড পুরস্কার নাই-আমি মরিব।

আমার এই জীবনে বহু বৎসর গিয়াছে-বহু বৎসর আসিতেও পারে! বৎসরে বৎসরে বহু দিবস-দিবসে দিবসে বহু দণ্ড-দণ্ডে দণ্ডে বহু মুহূর্ত-তাহার মধ্যে এক মুহূর্ত জন্য, এক পলক জন্য, আমার কি চক্ষু ফুটিবে না? এক মুহূর্ত জন্য, চক্ষু: মেলিতে পারিলে দেখিয়া লই, এই শব্দস্পর্শময় বিশ্বসংসার কি-আমি কি-শচীন্দ্র কি?

প্রথম খণ্ড
চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আমি প্রত্যহই ফুল লইয়া যাইতাম, ছোট বাবুর কথায় শব্দশ্রবণ প্রায় ঘটিত না-কিন্তু কদাচিৎ দুই এক দিন ঘটিত। সে আহ্লাদের কথা বলিতে পারি না। আমার বোধ হইত, বর্ষার জলভরা মেঘ যখন ডাকিয়া বর্ষে, তখন মেঘের বুঝি সেইরূপ আহ্লাদ হয়; আমারও সেইরূপ ডাকিতে ইচ্ছা করিত। আমি প্রত্যহ মনে করিতাম, আমি ছোট বাবুকে কতকগুলি বাছা ফুলের তোড়া বাঁধিয়া দিয়া আসিব-কিন্তু তাহা একদিনও পারিলাম না। একে লজ্জা করিত-আবার মনে ভাবিতাম, ফুল দিলে তিনি দাম দিতে চাহিবেন-কি বলিয়া না লইব? মনের দু:খে ঘরে আসিয়া ফুল লইয়া ছোট বাবুকেই গড়িতাম। কি গড়িতাম, তাহা জানি না-কখন দেখি নাই।

এদিকে আমার যাতায়াতে একটি অচিন্তনীয় ফল ফলিতেছিল-আমি তাহার কিছুই জানিতাম না। পিতামাতার কথোপকথনে তাহা প্রথম জানিতে পারিলাম। একদিন সন্ধ্যার পর, আমি মালা গাঁথিতে গাঁথিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। কি একটা শব্দে নিদ্রা ভাঙ্গিল। জাগ্রত হইলে কর্ণে পিতামাতার কথোপকথনের শব্দ প্রবেশ করিল। বোধ হয়, প্রদীপ নিবিয়া গিয়া থাকিবে; কেন না, পিতামাতা আমার নিদ্রাভঙ্গ জানিতে পারিলেন, এমত বোধ হইল না। আমিও আমার নাম শুনিয়া কোন সাড়াশব্দ করিলাম না। শুনিলাম, মা বলিতেছেন, “তবে একপ্রকার স্থিরই হইয়াছে?”

পিতা উত্তর করিলেন, “স্থির বৈ কি? অমন বড়মানুষ লোক, কথা দিলে কি আর নড়চড় আছে? আর আমার মেয়ে দোষের মধ্যে অন্ধ, নহিলে অমন মেয়ে লোকে তপস্যা করিয়া পায় না |”

মাতা। তা, পরে এত করবে কেন?

পিতা। তুমি বুঝিতে পার না যে, ওরা আমাদের মত টাকার কাঙ্গাল নয়-হাজার দুহাজার টাকা ওরা টাকার মধ্যে ধরে না।

যে দিন রজনীর সাক্ষাতে রামসদয় বাবুর স্ত্রী বিবাহের কথা প্রথম পাড়িলেন, সেই দিন হইতে রজনী তাঁহার কাছে প্রত্যহ যাতায়াত আরম্ভ করিল। তিনি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “টাকায় কি কাণার বিয়ে হয়?” ইহাতে অবশ্য মেয়ের মনে আশা ভরসা হইতে পারে যে, বুঝি ইনি দয়াবতী হইয়া টাকা খরচ করিয়া আমার বিবাহ দিবেন। সেই দিন হইতে রজনী নিত্য যায় আসে। সেই দিন হইতে নিত্য যাতায়াত দেখিয়া লবঙ্গ বুঝিলেন যে, মেয়েটি বিবাহের জন্য বড় কাতর হয়েছে-না হবে কেন, বয়স ত হয়েছে! তাতে আবার ছোট বাবু টাকা দিয়া হরনাথ বসুকে রাজি করিয়াছেন। গোপালও রাজি হইয়াছে।

হরনাথ বসু রামসদয় বাবুর বাড়ীর সরকার। গোপাল তাহার পুত্র। গোপালের কথা কিছু কিছু জানিতাম। গোপালের বয়স ত্রিশ বৎসর-একটি বিবাহ আছে, কিন্তু সন্তানাদি হয় নাই। গৃহধর্মার্থে তাহার গৃহিণী আছে-সন্তানার্থ অন্ধ পত্নীতে তাহার আপত্তি নাই। বিশেষ লবঙ্গ তাহাকে টাকা দিবে। পিতামাতার কথায় বুঝিলাম, গোপালের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ স্থির হইয়াছে-টাকার লোভে সে কুড়ি বৎসরের মেয়েও বিবাহ করিতে প্রস্তুত। টাকায় জাতি কিনিবে। পিতামাতা মনে করিলেন, এ জন্মের মত অন্ধ কন্যা উদ্ধারপ্রাপ্ত হইল। তাঁহারা আহ্লাদ করিতে লাগিলেন। আমার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল।

তার পরদিন স্থির করিলাম, আর আমি লবঙ্গের কাছে যাইব না-মনে মনে তাহাকে শত বার পোড়ারমুখী বলিয়া গালি দিলাম। লজ্জায় মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। রাগে লবঙ্গকে মারিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। দু:খে কান্না আসিতে লাগিল। আমি লবঙ্গের কি করিয়াছি যে, সে আমার উপর এত অত্যাচার করিতে উদ্যত? ভাবিলাম, যদি সে বড়মানুষ বলিয়া অত্যাচার করিয়াই সুখী হয়, তবে জন্মান্ধ দু:খিনী ভিন্ন, আর কি অত্যাচার করিবার পাত্র পাইল না? মনে করিলাম-না, আর একদিন যাইব, তাহাকে এমন করিয়া তিরস্কার করিয়া আসিব-তার পর আর যাইব না-আর ফুল বেচিব না-আর তাহার টাকা লইব না-মা যদি তাহাকে ফুল দিয়া মূল্য লইয়া আসেন, তবে তাহার টাকার অন্ন ভোজন করিব না-না খাইয়া মরিতে হয়-সেও ভাল। ভাবিলাম, বলিব, বড় মানুষ হইলেই কি পরপীড়ন করিতে হয়? বলিব, আমি অন্ধ-অন্ধ বলিয়া কি দয়া হয় না? বলিব, পৃথিবীতে যাহার কোন সুখ নাই, তাহাকে বিনাপরাধে কষ্ট দিয়া তোমার কি সুখ? যত ভাবি, এই এই বলিব, তত আপনার চক্ষের জলে আপনি ভাসি। মনে ভয় হইতে লাগিল, পাছে বলিবার সময় কথাগুলি ভুলিয়া যাই।

যথাসময়ে আবার রামসদয় বাবুর বাড়ী চলিলাম। ফুল লইয়া যাইব না মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু শুধু হাতে যাইতে লজ্জা করিতে লাগিল-কি বলিয়া গিয়া বসিব। পূর্বমত কিছু ফুল লইলাম। কিন্তু আজি মাকে লুকাইয়া গেলাম।

ফুল দিলাম-তিরস্কার করিব বলিয়া লবঙ্গের কাছে বসিলাম। কি বলিয়া প্রসঙ্গ উত্থাপন করিব? হরি! হরি! কি বলিয়া আরম্ভ করিব? গোড়ার কথা কোন‍্টা? যখন চারি দিকে আগুন জ্বলিতেছে-আগে কোন্ দিক্ নিবাইব? কিছু বলা হইল না! কথা পাড়িতেই পাড়িলাম না। কান্না আসিতে লাগিল।

ভাগ্যক্রমে লবঙ্গ আপনিই প্রসঙ্গ তুলিল, “কাণি-তোর বিয়ে হবে |”

আমি জ্বলিয়া উঠিলাম। বলিলাম, “ছাই হবে |”

লবঙ্গ বলিল, “কেন, ছোট বাবু বিবাহ দেওয়াইবেন-হবে না কেন?”

আরও জ্বলিলাম। বলিলাম, “কেন, আমি তোমাদের কাছে কি দোষ করেছি?”

লবঙ্গও রাগিল। বলিল, “আ: মলো! তোর কি বিয়ের মন নাই না কি?”

আমি মাথা নাড়িয়া বলিলাম, “না |”

লবঙ্গ আরও রাগিল, বলিল, “পাপিষ্ঠা কোথাকার! বিয়ে করবিনে কেন?”

আমি বলিলাম, “খুসি |”

লবঙ্গের মনে বোধ হয়, সন্দেহ হইল-আমি ভ্রষ্টা-নহিলে বিবাহে অসম্মত কেন? সে বড় রাগ করিয়া বলিল, “আ: মলো! বের বলিতেছি-নহিলে খেঙ‍্‍রা মারিয়া বিদায় করিব |”

0 Shares