রজনী

আমি উঠিলাম- আমার দুই অন্ধ চক্ষে জল পড়িতেছিল-তাহা লবঙ্গকে দেখাইলাম না-ফিরিলাম। গৃহে যাইতেছিলাম, সিঁড়িতে আসিয়া একটু ইতস্তত: করিতেছিলাম,-কই, তিরস্কারের কথা কিছুই ত বলা হয় নাই-অকস্মাৎ কাহার পদশব্দ শুনিলাম। অন্ধের শ্রবণশক্তি অনৈসর্গিক প্রখরতা প্রাপ্ত হয়-আমি দুই এক বার সেই পদশব্দ শুনিয়াই চিনিয়াছিলাম, কাহার পদবিক্ষেপের এ শব্দ। আমি সিঁড়িতে বসিলাম। ছোট বাবু আমার নিকটে আসিলে, আমাকে দেখিয়া দাঁড়াইলেন। বোধ হয়, আমার চক্ষের জল দেখিতে পাইয়াছিলেন,-জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে, রজনী?”

সকল ভুলিয়া গেলাম! রাগ ভুলিলাম। অপমান ভুলিলাম, দু:খ ভুলিলাম।-কাণে বাজিতে লাগিল-“কে রজনী!” আমি উত্তর করিলাম না-মনে করিলাম, আর দুই এক বার জিজ্ঞাসা করুন-আমি শুনিয়া কাণ জুড়াই।

ছোট বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “রজনী! কাঁদিতেছ কেন?”

আমার অন্তর আনন্দে ভরিতে লাগিল-চক্ষের জল উছলিতে লাগিল। আমি কথা কহিলাম না-আরও জিজ্ঞাসা করুন। মনে করিলাম, আমি কি ভাগ্যবতী! বিধাতা আমায় কাণা করিয়াছেন, কালা করেন নাই।

তিনি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন কাঁদিতেছ? কেহ কিছু বলিয়াছে?”

আমি সে বার উত্তর করিলাম-তাঁহার সঙ্গে কথোপকথনের সুখ, যদি জন্মে একবার ঘটিতেছে-তবে ত্যাগ করি কেন? আমি বলিলাম, “ছোট মা তিরস্কার করিয়াছেন |”

ছোট বাবু হাসিলেন,-বলিলেন, “ছোট মার কথা ধরিও না-তাঁর মুখ ঐ রকম-কিন্তু মনে রাগ করেন না। তুমি আমার সঙ্গে এস-এখনই তিনি আবার ভাল কথা বলিবেন |”

তাঁহার সঙ্গে কেন না যাইব? তিনি ডাকিলে কি আর রাগ থাকে? আমি উঠিলাম-তাঁহার সঙ্গে চলিলাম। তিনি সিঁড়িতে উঠিতে লাগিলেন-আমি পশ্চাৎ পশ্চাৎ উঠিতেছিলাম। তিনি বলিলেন, “তুমি দেখিতে পাও না-সিঁড়িতে উঠ কিরূপে? না পার, আমি হাত ধরিয়া লইয়া যাইতেছি |”

আমার গা কাঁপিয়া উঠিল-সর্বশরীরে রোমাঞ্চ হইল-তিনি আমার হাত ধরিবেন! ধরুন না-লোকে নিন্দা করে করুক-আমার নারীজন্ম সার্থক হউক! আমি পরের সাহায্য ব্যতীত কলিকাতার গলি গলি বেড়াইতে পারি, কিন্তু ছোট বাবুকে নিষেধ করিলাম না। ছোট বাবু-বলিব কি? কি বলিয়া বলিব-উপযুক্ত কথা পাই না-ছোট বাবু হাত ধরিলেন!

যেন একটি প্রভাতপ্রফুল্ল পদ্ম দলগুলির দ্বারা আমার প্রকোষ্ঠ বেড়িয়া ধরিল-যেন গোলাবের মালা গাঁথিয়া কে আমার হাতে বেড়িয়া দিল! আমার আর কিছু মনে নাই। বুঝি সেই সময়ে ইচ্ছা হইয়াছিল-এখন মরি না কেন? বুঝি তখন গলিয়া জল হইয়া যাইতে ইচ্ছা করিয়াছিল-বুঝি ইচ্ছা করিয়াছিল, শচীন্দ্র আর আমি, দুইটি ফুল হইয়া এইরূপ সংস্পৃষ্ট হইয়া কোন বন্য বৃক্ষে গিয়া এক বোঁটায় ঝুলিয়া থাকি। আর কি মনে হইয়াছিল-তাহা মনে নাই। যখন সিঁড়ির উপরে উঠিয়া, ছোট বাবু হাত ছাড়িয়া দিলেন-তখন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলাম-এ সংসার আবার মনে পড়িল-সেই সঙ্গে মনে পড়িল-“কি করিলে প্রাণেশ্বর! না বুঝিয়া কি করিলে! তুমি আমার পাণিগ্রহণ করিয়াছ। এখন তুমি আমায় গ্রহণ কর না কর-তুমি আমার স্বামী-আমি তোমার পত্নী-ইহজন্মে অন্ধ ফুলওয়ালীর আর কেহ স্বামী হইবে না |”

সেই সময় কি পোড়া লোকের চোখ পড়িল? বুঝি তাই।

প্রথম খণ্ড
পঞ্চম পরিচ্ছেদ

ছোট বাবু ছোট মার কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রজনীকে কি বলিয়াছ গা? সে কাঁদিতেছে |” ছোট মা আমার চক্ষে জল দেখিয়া অপ্রতিভ হইলেন,-আমাকে ভাল কথা বলিয়া কাছে বসাইলেন-বয়োজ্যেষ্ঠ সপত্নীপুত্রের কাছে সকল কথা ভাঙ্গিয়া বলিতে পারিলেন না। ছোট বাবু ছোট মাকে প্রসন্ন দেখিয়া নিজ প্রয়োজনে বড় মার কাছে চলিয়া গেলেন। আমিও বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম।

এ দিকে গোপাল বাবুর সঙ্গে আমার বিবাহের উদ্যোগ হইতে লাগিল। দিন স্থির হইল। আমি কি করিব? ফুল গাঁথা বন্ধ করিয়া, দিবারাত্র কিসে এ বিবাহ বন্ধ করিব-সেই চিন্তা করিতে লাগিলাম। এ বিবাহে মাতার আনন্দ, পিতার উৎসাহ, লবঙ্গলতার যত্ন, ছোট বাবু ঘটক-এই কথাটি সর্বাপেক্ষা কষ্টদায়ক- ছোট বাবু ঘটক! আমি একা অন্ধ কি প্রকারে ইহার প্রতিবন্ধকতা করিব? কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না। মালা গাঁথা বন্ধ হইল। মাতাপিতা মনে করিলেন, বিবাহের আনন্দে আমি বিহ্বল হইয়া মালা গাঁথা ত্যাগ করিয়াছি।

ঈশ্বর আমাকে এক সহায় আনিয়া দিলেন। বলিয়াছি, গোপাল বসুর বিবাহ ছিল-তাঁহার পত্নীর নাম চাঁপা-বাপ রেখেছিল চম্পকলতা। চাঁপাই কেবল এ বিবাহে অসম্মত। চাঁপা একটু শক্ত মেয়ে। যাহাতে ঘরে সপত্নী না হয়-তাহার চেষ্টার কিছু ত্রুটি করিল না।

হীরালাল নামে চাঁপার এক ভাই ছিল-চাঁপার অপেক্ষা দেড় বৎসরের ছোট। হীরালাল মদ খায়-তাহাও অল্প মাত্রায় নহে। শুনিয়াছি, গাঁজাও টানে। তাহার পিতা তাহাকে লেখা-পড়া শিখান নাই-কোন প্রকারে সে হস্তাক্ষরটি প্রস্তুত করিয়াছিল মাত্র, তথাপি রামসদয় বাবু তাহাকে কোথা কেরানিগিরি করিয়া দিয়াছিলেন। মাতলামির দোষে সে চাকরিটি গেল। হরনাথ বসু তাহার দমে ভুলিয়া, তাহাকে লাভের আশায় তাহাকে দোকান করিয়া দিলেন। দোকানে লাভ দূরে থাক, দেনা পড়িল-দোকান উঠিয়া গেল। তার পর কোন গ্রামে, বার টাকা বেতনে হীরালাল মাষ্টার হইয়া গেল। সে গ্রামে মদ পাওয়া যায় না বলিয়া হীরালাল পলাইয়া আসিল। তার পর সে একখানা খবরের কাগজ করিল। দিনকতক তাহাতে খুব লাভ হইল, বড় পসার জাঁকিল-কিন্তু অশ্লীলতা দোষে পুলিসে টানাটানি আরম্ভ করিল-ভয়ে হীরালাল কাগজ ফেলিয়া রূপোষ হইল। কিছুদিন পরে হীরালাল আবার হঠাৎ ভাসিয়া উঠিয়া ছোট বাবুর মোসায়েবি করিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু ছোট বাবুর কাছে মদের চাল নাই দেখিয়া আপনাআপনি সরিল। অনন্যোপায় হইয়া নাটক লিখিতে আরম্ভ করিল। নাটক একখানিও বিক্রয় হইল না। তবে ছাপাখানার দেনা শোধিতে হয় না বলিয়া সে যাত্রা রক্ষা পাইল। এক্ষণে এ ভবসংসারে আর কূলকিনারা না দেখিয়া-হীরালাল চাঁপাদিদির আঁচল ধরিয়া বসিয়া রহিল।

চাঁপা হীরালালকে স্বকার্যোদ্ধার জন্য নিয়োজিত করিল। হীরালাল ভগিনীর কাছে সবিশেষ শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “টাকার কথা সত্য ত? যেই কাণীকে বিবাহ করিবে, সেই টাকা পাইবে?”

চাঁপা সে বিষয়ে সন্দেহভঞ্জন করিল। হীরালালের টাকার বড় দরকার। সে তখনই আমার পিতৃভবনে আসিয়া দর্শন দিল। পিতা তখন বাড়ী ছিলেন। আমি তখন সেখানে ছিলাম না। আমি নিকটস্থ অন্য ঘরে ছিলাম-অপরিচিত পুরুষে পিতার সঙ্গে কথা কহিতেছে, কণ্ঠস্বরে জানিতে পারিয়া. কাণ পাতিয়া, কথাবার্তা শুনিতে লাগিলাম। হীরালালের কি কর্কশ কদর্য স্বর!

0 Shares