রজনী

হীরালাল বলিতেছে, “সতীনের উপর কেন মেয়ে দিবে?”

পিতা দু:খিতভাবে বলিলেন, “কি করি! না দিলে ত বিয়ে হয় না-এতকাল ত হলো না!”

হী। কেন, তোমার মেয়ের বিবাহের ভাবনা কি?

পিতা হাসিলেন, বলিলেন, “আমি গরিব-ফুল বেচিয়া খাই-আমার মেয়ে কে বিবাহ করিবে? তাতে আবার কাণা মেয়ে, আবার বয়সও ঢের হয়েছে |”

হী। কেন, পাত্রের অভাব কি? আমায় বলিলে আমি বিয়ে করি। এখন বয়:স্থা মেয়ে ত লোকে চায়। আমি যখন স্তুশ্চুভিশ্চশাৎ পত্রিকার এডিটার ছিলাম, তখন আমি মেয়ে বড় করিয়া বিবাহ দিবার জন্য কত আর্টিকেল লিখেছি-পড়িয়া আকাশের মেঘ ডেকে উঠেছিল। বাল্যবিবাহ! ছি! ছি! মেয়ে ত বড় করিয়াই বিবাহ দিবে। এস! আমাকে দেশের উন্নতির একজাম্পল সেট করিতে দাও-আমিই এ মেয়ে বিয়ে করিব।

আমরা তখন হীরালালের চরিত্রের কথা সবিশেষ শুনি নাই-পশ্চাৎ শুনিয়াছি। পিতা ইতস্তত: করিতে লাগিলেন। এত বড় পণ্ডিত জামাই হাতছাড়া হয় ভাবিয়া শেষ একটু দু:খিত হইলেন; শেষ বলিলেন, “এখন কথা ধার্য হইয়া গিয়াছে-এখন আর নড়চড় হয় না। বিশেষ এ বিবাহের কর্তা শচীন বাবু। তাঁহারাই বিবাহ দিতেছেন। তাঁহারা যাহা করিবেন, তাহাই হইবে। তাঁহারাই গোপাল বাবুর সঙ্গে সম্বন্ধ করিয়াছেন।”

হী। তাঁদের মতলব তুমি কি বুঝিবে? বড়মানুষের চরিত্রের অন্ত পাওয়া ভার। তাঁদের বড় বিশ্বাস করিও না।

এই বলিয়া হীরালাল চুপি চুপি কি বলিল, তাহা শুনিতে পাইলাম না। পিতা বলিলেন, “সে কি? না-আমার কাণা মেয়ে |”

হীরালাল তৎকালে ভগ্নমনোরথ হইয়া ঘরের এ দিক সে দিক দেখিতে লাগিল। চারিদিক দেখিয়া বলিল, “তোমার ঘরে মদ নাই, বটে হে?” পিতা বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “মদ! কিজন্য রাখিব!”

হীরালাল মদ নাই জানিয়া, বিজ্ঞের ন্যায় বলিল, “সাবধান করিয়া দিবার জন্য বলছিলাম। এখন ভদ্রলোকের সঙ্গে কুটুম্বতা করিতে চলিলে, ওগুলা যেন না থাকে |”

কথাটা পিতার বড় ভাল লাগিল না। তিনি চুপ করিয়া রহিলেন। হীরালাল না বিবাহে না মদে, কোন দিকেই দেশের উন্নতির একজাম্পল সেট করিতে না পারিয়া, ক্ষুণ্ণমনে বিদায় হইল।

প্রথম খণ্ড
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বিবাহের দিন অতি নিকট হইল-আর একদিনমাত্র বিলম্ব আছে। উপায় নাই! নিষ্কৃতি নাই! চারিদিক হইতে উচ্ছ্বসিত বারিরাশি গর্জিয়া আসিতেছে-নিশ্চিত ডুবিব।

তখন লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়া, মাতার পায়ে আছড়াইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলাম। যোড়হাত করিয়া বলিলাম,-“আমার বিবাহ দিও না-আমি আইবুড়ো থাকিব |”

মা বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?” কেন? তাহার উত্তর দিতে পারিলাম না। কেবল যোড়হাত করিতে লাগিলাম, কেবল কাঁদিতে লাগিলাম। মাতা বিরক্ত হইলেন,-রাগিয়া উঠিলেন; গালি দিলেন। শেষ পিতাকে বলিয়া দিলেন। পিতাও গালি দিয়া মারিতে আসিলেন। আর কিছু বলিতে পারিলাম না।

উপায় নাই! নিষ্কৃতি নাই! ডুবিলাম।

সেই দিন বৈকালে গৃহে কেবল আমি একা ছিলাম-পিতা বিবাহের খরচসংগ্রহে গিয়াছিলেন-মাতা দ্রব্যসামগ্রী কিনিতে গিয়াছিলেন। এ সব যে সময়ে হয়, সে সময়ে আমি দ্বার দিয়া থাকিতাম, না হয় বামাচরণ আমার কাছে বসিয়া থাকিত। বামাচরণ এদিন বসিয়া ছিল। একজন কে দ্বার ঠেলিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। চেনা পায়ের শব্দ নহে। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে গা?”

উত্তর “তোমার যম |”

কথা কোপযুক্ত বটে, কিন্তু স্বর স্ত্রীলোকের। ভয় পাইলাম না। হাসিয়া বলিলাম-“আমার যম কি আছে? তবে এতদিন কোথা ছিলে?”

স্ত্রীলোকটির রাগশান্তি হইল না। “এখন জানবি! বড় বিয়ের সাধ! পোড়ারমুখী ; আবাগী!” ইত্যাদি গালির ছড়া আরম্ভ হইল। গালি সমাপ্তে সেই মধুরভাষিণী বলিলেন, “হাঁ দেখ্, কাণি, যদি আমার স্বামীর সঙ্গে তোর বিয়ে হয়, তবে যেদিন তুই ঘর করিতে যাইবি, সেই দিন তোকে বিষ খাওয়াইয়া মারিব |”

বুঝিলাম, চাঁপা খোদ। আদর করিয়া বসিতে বলিলাম। বলিলাম, “শুন-তোমার সঙ্গে কথা

আছে!” এত গালির উত্তরে সাদর সম্ভাষণ দেখিয়া, চাঁপার একটু শীতল হইয়া বসিল।

আমি বলিলাম, “শুন, এই বিবাহে তুমি যেমন বিরক্ত, আমিও তেমনি। আমার এ বিবাহ যাহাতে না হয়, আমি তাহাই করিতে রাজি আছি। কিসে বিবাহ বন্ধ হয়, তাহার উপায় বলিতে পার?”

চাঁপা বিস্মিত হইল। বলিল, “তা তোমার বাপ-মাকে বল না কেন?”

আমি বলিলাম, “হাজার বার বলিয়াছি। কিছু হয় নাই |”

চাঁ। বাবুদের বাড়ী গিয়া তাঁদের হাতে পায়ে ধর না কেন?

আমি। তাতেও কিছু হয় নাই।

চাঁপা একটু ভাবিয়া বলিল, “তবে এক কাজ করিবি?”

আমি। কি?

চাঁ। দুদিন লুকাইয়া থাকিবি?

আমি। কোথায় লুকাইব? আমার স্থান কোথায় আছে?

চাঁ। আবার একটু ভাবিল। বলিল, “আমার বাপের বাড়ী গিয়া থাকিবি?”

ভাবিলাম, মন্দ কি? আর ত উদ্ধারের কোন উপায় দেখি না। বলিলাম, “আমি কাণা, নূতন স্থানে আমাকে কে পথ চিনাইয়া লইয়া যাইবে? তাহারাই বা স্থান দিবে কেন?”

চাঁপা আমার সর্বনাশী কুপ্রবৃত্তি মূর্তিমতী হইয়া আসিয়াছিল; সে বলিল, “তোর তা ভাবিতে হইবে না। সে সব বন্দোবস্ত আমি করিব। আমি সঙ্গে লোক দিব, আমি তাদের বলিয়া পাঠাইব। তুই যাস ত বল্?”

মজ্জনোন্মুখের সমীপবর্তী কাষ্ঠফলকবৎ এই প্রবৃত্তি আমার চক্ষে একমাত্র রক্ষার উপায় বলিয়া বোধ হইল। আমি সম্মত হইলাম।

চাঁপা বলিল, “আচ্ছা, তবে ঠিক থাকিস। রাত্রে সবাই ঘুমাইলে আমি আসিয়া দ্বারে টোকা মারিব; বাহির হইয়া আসিস |”

আমি সম্মত হইলাম।

* * *

রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে দ্বারে ঠকঠক করিয়া অল্প শব্দ হইল। আমি জাগ্রত ছিলাম। দ্বিতীয় বস্ত্র মাত্র লইয়া, আমি দ্বারোদ্ঘাটনপূর্বক বাহির হইলাম। বুঝিলাম, চাঁপা দাঁড়াইয়া আছে। তাহার সঙ্গে চলিলাম। একবার ভাবিলাম না-একবার বুঝিলাম না যে, কি দুষ্কর্ম করিতেছি। পিতামাতার জন্য মন কাতর হইল বটে, কিন্তু তখন মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, অল্প দিনের জন্য যাইতেছি। বিবাহের কথা নিবৃত্তি পাইলেই আবার আসিব।

0 Shares