বনের মধ্যে কাঁটা-লতা ঝোপ হইতে মাথা উঁচু স্তম্ভের মাথায় একটা বিকট মুখ খোদাই করা, সন্ধ্যাবেলা দেখিলে ভয় পাইবার কথা বটে।
মানুষের হাতের তৈরি এ-বিষয়ে ভুল নাই, কিন্তু এ জনহীন জঙ্গলের মধ্যে এ স্তম্ভ কোথা হইতে আসিল বুঝিতে পারিলাম না। জিনিসটা কত দিনের প্রাচীন তাহাও বুঝিতে পারিলাম না।
সে রাত্রি কাটিয়া গেল। সকালে উঠিয়া বেলা ন-টার মধ্যে আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়া গেলাম।
সেখানে পৌঁছিয়া জঙ্গলের বর্তমান মালিকের জনৈক কর্মচারীর সঙ্গে দেখা হইল। সে আমায় জঙ্গল দেখাইয়া বেড়াইতেছে-হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে একটা শুষ্ক নালার ওপারে ঘন বনের মধ্যে দেখি একটা প্রস্তরস্তম্ভের শীর্ষ জাগিয়া আছে-ঠিক কাল সন্ধ্যাবেলার সেই স্তম্ভটার মতো। সেই রকমের বিকট মুখ খোদাই করা।
আমার সঙ্গে বনোয়ারী পাটোয়ারী ছিল, তাহাকেও দেখাইলাম। মালিকের কর্মচারী স্থানীয় লোক, সে বলিল-ও আরো তিন-চারটা আছে এ-অঞ্চলে জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে। এ দেশে আগে অসভ্য বুনো জাতির রাজ্য ছিল, ও তাদেরই হাতের তৈরি। ওগুলো সীমানার নিশানদিহি খাম্বা।
বলিলাম-খাম্বা কি করে জানলে?
সে বলিল-চিরকাল শুনে আসছি বাবুজী, তা ছাড়া সেই রাজার বংশধর এখনো বর্তমান।
বড় কৌতূহল হইল।
-কোথায়?
লোকটা আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-এই জঙ্গলের উত্তর সীমানায় একটা ছোট বস্তি আছে-সেখানে থাকেন। এ-অঞ্চলে তাঁর বড় খাতির। আমরা শুনেছি উত্তরে হিমালয় পাহাড়, আর দক্ষিণে ছোটনাগপুরের সীমানা, পূর্বে কুশী নদী, পশ্চিমে মুঙ্গের-এই সীমানার মধ্যে সমস্ত পাহাড়-জঙ্গলের রাজা ছিল ওঁর পূর্বপুরুষ।
মনে পড়িল, পূর্বেও আমার কাছারিতে একবার গনোরী তেওয়ারী স্কুলমাস্টার গল্প করিয়াছিল বটে যে, এ-অঞ্চলের আদিম-জাতীয় রাজার বংশধর এখনো আছে। এ-দিকের যত পাহাড়ি জাতি-তাহাকে এখনো রাজা বলিয়া মানে। এখন সে কথা মনে পড়িল। জঙ্গলের মালিকের সেই কর্মচারীর নাম বুদ্ধু সিং, বেশ বুদ্ধিমান, এখানে অনেক কাল চাকুরি করিতেছে, এইসব বনপাহাড় অঞ্চলের অনেক ইতিহাস সে জানে দেখিলাম।
বুদ্ধু সিং বলিল-মুঘল বাদশাহের আমলে এরা মুঘল সৈন্যদের সঙ্গে লড়েছে-এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তারা যখন বাংলা দেশে যেত-এরা উপদ্রব করত তীর-ধনুক নিয়ে। শেষে রাজমহলে যখন মুঘল সুবাদারেরা থাকতেন, তখন এদের রাজ্য যায়। ভারি বীরের বংশ এরা, এখন আর কিছুই নেই। যা কিছু বাকি ছিল, ১৮৬২ সালের সাঁওতাল-বিদ্রোহের পর সব যায়। সাঁওতাল-বিদ্রোহের নেতা এখনো বেঁচে আছেন। তিনি বর্তমান রাজা। নাম দোবরু পান্না বীরবর্দী। খুব বৃদ্ধ আর খুব গরিব। কিন্তু এ দেশের সকল আদিম জাতি এখনো তাঁকে রাজার সম্মান দেয়। রাজ্য না থাকলেও রাজা বলেই মানে।
রাজার সঙ্গে দেখা করিবার বড়ই ইচ্ছা হইল।
রাজসন্দর্শনে যাইতে হইলে কিছু নজর লইয়া যাওয়া উচিত। যার যা প্রাপ্য সম্মান, তাকে তা না-দিলে কর্তব্যের হানি ঘটে।
কিছু ফলমূল, গোটা দুই বড় মুরগি-বেলা একটার মধ্যে নিকটবর্তী বস্তি হইতে কিনিয়া আনিলাম। এ-দিকের কাজ শেষ করিয়া বেলা দুইটার পরে বুদ্ধু সিংকে বলিলাম-চল, রাজার সঙ্গে দেখা করে আসি।
বুদ্ধু সিং তেমন উৎসাহ দেখাইল না। বলিল-আপনি সেখানে কী যাবেন! আপনাদের সঙ্গে দেখা করবার উপযুক্ত নয়। পাহাড়ি অসভ্য জাতের রাজা, তাই বলে কি আর আপনাদের সমান সমান কথা বলবার যোগ্য বাবুজী? সে তেমন কিছু নয়।
তাহার কথা না শুনিয়াই আমি ও বনোয়ারীলাল রাজধানীর দিকে গেলাম। তাহাকেও সঙ্গে লইলাম।
রাজধানীটা খুব ছোট, কুড়ি-পঁচিশ ঘর লোকের বাস।
ছোট ছোট মাটির ঘর, খাপরার চাল। পরিষ্কার করিয়া লেপা-পোঁছা। দেওয়ালের গায়ে মাটির সাপ, পদ্ম, লতা প্রভৃতি গড়া। ছোট ছোট ছেলেরা খেলা করিয়া বেড়াইতেছে, স্ত্রীলোকেরা গৃহকর্ম করিতেছে। কিশোরী ও যুবতী মেয়েদের সুঠাম গড়ন ও নিটোল স্বাস্থ্য, মুখে কেমন সুন্দর একটা লাবণ্য প্রত্যেকেরই। সকলেই আমাদের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।
বুদ্ধু সিং একজন স্ত্রীলোককে বলিল-রাজা ছে রে?
স্ত্রীলোকটি বলিল, সে দেখে নাই। তবে কোথায় আর যাইবে, বাড়িতেই আছে।
২
আমরা গ্রামে যেখানে আসিয়া দাঁড়াইলাম, বুদ্ধু সিং-এর ভাবে মনে হইল এইবার রাজপ্রাসাদের সম্মুখে নীত হইয়াছি। অন্য ঘরগুলির সঙ্গে রাজপ্রাসাদের পার্থক্য এইমাত্র লক্ষ্য করিলাম যে, ইহার চারিপাশ পাথরের পাঁচিলে ঘেরা-বস্তির পিছনেই অনুচ্চ পাহাড়, সেখান হইতেই পাথর আনা হইয়াছে। রাজবাড়িতে ছেলেমেয়ে অনেকগুলি-কতকগুলি খুব ছোট। তাদের গলায় পুঁতির মালা ও নীল ফলের বীজের মালা। দু-একটি ছেলেমেয়ে দেখিতে বেশ সুশ্রী! ষোল-সতের বছরের একটি মেয়ে বুদ্ধু সিং-এর ডাকে ছুটিয়া বাহিরে আসিয়াই আমাদের দেখিয়া অবাক হইয়া গেল, তাহার চোখের চাহনি দেখিয়া মনে হইল কিছু ভয়ও পাইয়াছে।
বুদ্ধু সিং বলিল-রাজা কোথায়?
মেয়েটি কে?-বুদ্ধু সিংকে জিজ্ঞাসা করিলাম। বুদ্ধু সিং বলিল-রাজার নাতির মেয়ে।
রাজা বহুদিন জীবিত থাকিয়া নিশ্চয়ই বহু যুবক ও প্রৌঢ়কে রাজসিংহাসনে বসিবার সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন।
মেয়েটি বলিল-আমার সঙ্গে এস। জ্যাঠামশায় পাহাড়ের নিচে পাথরে বসে আছেন।
মানি বা না-ই মানি, মনে মনে ভাবিলাম যে-মেয়েটি আমাদের পথ দেখাইয়া লইয়া চলিয়াছে, সে সত্যই রাজকন্যা-তাহার পূর্বপুরুষেরা এই আরণ্য-ভূভাগ বহুদিন ধরিয়া শাসন করিয়াছিল-সেই বংশের সে মেয়ে।
বলিলাম-মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস কর।
বুদ্ধু সিং বলিল-ওর নাম ভানুমতী।
বাঃ বেশ সুন্দর- ভানুমতী! রাজকন্যা ভানুমতী!
ভানুমতী নিটোল স্বাস্থ্যবতী, সুঠাম মেয়ে। লাবণ্যমাখা মুখশ্রী-তবে পরনের কাপড়, সভ্যসমাজের শোভনতা রক্ষা করিবার উপযুক্ত প্রমাণ মাপের নয়। মাথার চুল রুক্ষ, গলায় কড়ি ও পুঁতির দানা। দূর হইতে একটা বড় বকাইন্ গাছ দেখাইয়া দিয়া ভানুমতী বলিল-তোমরা যাও, জ্যাঠামশায় ওই গাছতলায় বসে গোরু চরাচ্ছেন।
গোরু চরাইতেছেন কি রকম! প্রায় চমকিয়া উঠিয়াছিলাম বোধ হয়। এই সমগ্র অঞ্চলের রাজা সাঁওতাল-বিদ্রোহের নেতা দোবরু পান্না বীরবর্দী গোরু চরাইতেছেন!
কিছু জিজ্ঞাসা করিবার পূর্বে মেয়েটি চলিয়া গেল এবং আমরা আর কিছু অগ্রসর হইয়া বকাইন্ গাছের তলায় এক বৃদ্ধকে কাঁচা শালপাতায় তামাক জড়াইয়া ধূমপানরত দেখিলাম।
বুদ্ধু সিং বলিল-সেলাম, রাজাসাহেব।
রাজা দোবরু পান্না কানে শুনিতে পাইলেও চোখে খুব ভালো দেখিতে পান বলিয়া মনে হইল না।
বলিল-কে? বুদ্ধু সিং? সঙ্গে কে?
বুদ্ধু বলিল-একজন বাঙালি বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। উনি কিছু নজর এনেছেন-আপনাকে নিতে হবে।
আমি নিজে গিয়া বৃদ্ধের সামনে মুরগি ও জিনিস কয়টি নামাইয়া রাখিলাম।
বলিলাম-আপনি দেশের রাজা, আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্য বহুৎ দূর থেকে এসেছি।
বৃদ্ধের দীর্ঘায়ত চেহারার দিকে চাহিয়া আমার মনে হইল যৌবনে রাজা দোবরু পান্না খুব সুপুরুষ ছিলেন সন্দেহ নাই। মুখশ্রীতে বুদ্ধির ছাপ সুস্পষ্ট। বৃদ্ধ খুব খুশি হইলেন। আমার দিকে ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন-কোথায় ঘর?
বলিলাম-কলকাতা।
-উঃ অনেক দূর। বড় ভারি জায়গা শুনেছি কলকাতা।
-আপনি কখনো যান নি?
-না, আমরা কি শহরে যেতে পারি? এই জঙ্গলেই আমরা থাকি ভালো। বোসো। ভান্মতী কোথায় গেল, ও ভান্মতী?
মেয়েটি ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া বলিল-কি জ্যাঠামশায়?
-এই বাঙালি বাবু ও তাঁর সঙ্গের লোকজন আজ আমার এখানে থাকবেন ও খাওয়াদাওয়া করবেন।
আমি প্রতিবাদ করিয়া বলিলাম-না, না, সে কি! আমরা এখুনি চলে যাব, আপনার সঙ্গে দেখা করেই-আমাদের থাকার বিষয়ে-
কিন্তু দোবরু পান্না বলিলেন-না, তা হতে পারে না। ভান্মতী, এই জিনিসগুলো নিয়ে যা এখান থেকে।
আমার ইঙ্গিতে বনোয়ারীলাল পাটোয়ারী নিজে জিনিসগুলি বহিয়া অদূরবর্তী রাজার বাড়িতে লইয়া গেল ভানুমতীর পিছুপিছু। বৃদ্ধের কথা অমান্য করিতে পারিলাম না, বৃদ্ধের দিকে চাহিয়াই আমার সম্ভ্রমে মন পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সাঁওতাল-বিদ্রোহের নেতা, প্রাচীন অভিজাত-বংশীয় বীর দোবরু পান্না (হইলই বা আদিম জাতি) আমাকে থাকিতে অনুরোধ করিতেছেন-এ অনুরোধ আদেশেরই শামিল।