আরণ্যক

ভানুমতীর মধ্যে যে আদিম নারী আছে, সভ্য সমাজে সে-নারীর আত্মা সংস্কারের ও বন্ধনের চাপে মূর্ছিত।

সে-বার যে রকম ব্যবহার পাইয়াছিলাম, এবারকার ব্যবহার তার চেয়েও আপন, ভানুমতী বুঝিতে পারিয়াছে এ বাঙালি বাবু তাদের পরিবারের বন্ধু, তাদেরই শুভাকাক্সক্ষী আপনার লোকদের মধ্যে গণ্য- সুতরাং যে ব্যবহার তাহার নিকট পাইলাম তাহা নিজের স্নেহময়ী ভগ্নীর মতোই।

অনেককাল হইয়া গিয়াছে-কিন্তু ভানুমতীর এই সুন্দর প্রীতি ও বন্ধুত্বের কথা আমার স্মৃতিপটে তেমনি সমুজ্জ্বল-বন্য অসভ্যতার এই দানের নিকট সভ্য সমাজের বহু সম্পদ আমার মনে নিষ্প্রভ হইয়া আছে।

রাজা দোবরু উৎসবের অন্য আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন, এইবার আসিয়া আমার ঘরে বসিলেন।

আমি বলিলাম-ঝুলন কি আপনাদের এখানে বরাবর হয়?

রাজা দোবরু বলিলেন-আমাদের বংশে বহুদিনের উৎসব এইটি। এ সময়ে অনেক দূর থেকে আত্মীয়স্বজন আসে ঝুলনে নাচতে। আড়াই মন চাল রান্না হবে কাল।

মটুকনাথ আসিয়াছে পণ্ডিত-বিদায়ের লোভে-ভাবিয়াছিল কত বড় রাজবাড়ি, কি কাণ্ডই আসিয়া দেখিবে! তাহার মুখের ভাবে মনে হইল সে বেশ একটু নিরাশ হইয়াছে। এ রাজবাড়ি অপেক্ষা টোলগৃহ যে অনেক ভালো।

রাজু তো মনের কথা চাপিতে না পারিয়া স্পষ্টই বলিল-রাজা কোথায় হুজুর, এ তো এক সাঁওতাল সর্দার! আমার যে ক’টা মহিষ আছে, রাজার শুনলাম তাও নেই, হুজুর!

সে ইহারই মধ্যে রাজার পার্থিব সম্পদের বিষয় অনুসন্ধান করিয়াছে-গোরু, মহিষ এদেশে সম্পদের বড় মাপকাঠি। যার যত মহিষ, সে তত বড়লোক।

গভীর রাত্রে চতুর্দশীর জ্যোৎস্না বনের বড় বড় গাছপালার আড়ালে উঠিয়া যখন সেই বন্য গ্রামের গৃহস্থবাড়ির প্রাঙ্গণে আলো-আঁধারের জাল বুনিয়াছে, তখন শুনিলাম রাজবাড়িতে বহু নারীকণ্ঠের সম্মিলিত এক অদ্ভুত ধরনের গান। কাল ঝুলন পূর্ণিমা, রাজবাড়িতে নবাগত কুটুম্বিনী ও রাজকন্যার সহচরীগণ কল্যকার নাচগানের মহলা দিতেছে। সারারাত ধরিয়া তাহাদের গান ও মাদল বাজনা থামিল না।

শুনিতে শুনিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছি, ঘুমের মধ্যেও ওদের সেই গান কতবার যেন শুনিতে পাইতেছিলাম।


কিন্তু পরদিন ঝুলনোৎসব দেখিয়া মটুকনাথ, রাজু, এমন কি মুনেশ্বর সিং পর্যন্ত মুগ্ধ হইয়া গেল।

পরদিন সকালে উঠিয়া দেখি ভানুমতীর বয়সী কুমারী মেয়েই অন্তত ত্রিশজন চারিপাশের বহু টোলা ও পাহাড়ি বস্তি হইতে উৎসব উপলক্ষে আসিয়া জুটিয়াছে। একটি ভালো প্রথা দেখিলাম, এত নাচগানের মধ্যে ইহাদের কেহই মহুয়ার মদ খায় নাই। রাজা দোবরুকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি হাসিয়া গর্বের সুরে বলিলেন- আমাদের বংশে মেয়েদের মধ্যে ও নিয়ম নেই। তা ছাড়া, আমি হুকুম না দিলে, কারো সাধ্যি নেই আমার ছেলেমেয়ের সামনে মদ খায়।

মটুকনাথ দুপুরবেলা আমায় চুপি চুপি বলিল-রাজা দেখছি আমার চেয়ে গরিব। রাঁধবার জন্যে দিয়েছে মোটা রাঙা চাল, আর পাকা চালকুমড়ো, আর বুনো ধুঁধুল। এতগুলো লোকের জন্যে কি রাঁধি বলুন তো?

সারা সকাল ভানুমতীর দেখা পাই নাই-খাইতে বসিয়াছি, সে এক বাটি দুধ আনিয়া আমার সামনে বসিল।

বলিলাম-তোমাদের গান কাল রাত্রে বেশ লেগেছিল।

ভানুমতী হাসিমুখে বলিল-আমাদের গান বুঝতে পারেন?

বলিলাম-কেন পারব না? এতদিন তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমাদের গান বুঝব না কেন?

-আজ ও-বেলা আপনি ঝুলন দেখতে যাবেন তো?

-সে জন্যেই তো এসেছি। কতদূর যেতে হবে?

ভানুমতী ধন্‌ঝরি পাহাড়শ্রেণীর দিকে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-আপনি তো গিয়েছেন ও পাহাড়ে। আমাদের সেই মন্দির দেখেন নি?

এই সময় ভানুমতীর বয়সী একদল কিশোরী মেয়ে আমার খাবার ঘরের দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, বাঙালি বাবুর ভোজন পরম কৌতূহলের সহিত দেখিতে এবং পরস্পরে কি বলাবলি করিতে লাগিল।

ভানুমতী বলিল-যা সব এখান থেকে, এখানে কি?

একটি মেয়ের সাহস অন্য মেয়েদের চেয়ে বেশি, সে একটু আগাইয়া আসিয়া বলিল-বাবুজীকে ঝুলনের দিন নুন করমচা খেতে দিস্ নি তো?

তাহার এ কথায় পিছনের সব মেয়ে খিলখিল করিয়া হাসির উঠিয়া এ উহার গায়ে হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল।

ভানুমতীকে বলিলাম-ওরা হাসছে কেন?

ভানুমতী সলজ্জ মুখে বলিল-ওদের জিজ্ঞেস করুন! আমি কি জানি!

ইতিমধ্যে একটি মেয়ে বড় একটা পাকা কামরাঙা লঙ্কা আনিয়া আমার পাতে দিয়া হাসিয়া বলিল- খান বাবুজী একটু লঙ্কার আচার। ভানুমতী শুধু আপনাকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, তা তো হবে না। আমরা একটু ঝাল খাওয়াই!

সকলে আবার হাসিয়া উঠিল। এতগুলি তরুণীর মুখের সরল হাসিতে দিনমানেই যেন পূর্ণিমার জ্যোৎস্না ফুটিয়া উঠিয়াছে।

সন্ধ্যার পূর্বেই একদল তরুণ-তরুণী পাহাড়ের দিকে রওনা হইল-তাহদের পিছু পিছু আমরাও গেলাম-সে এক প্রকাণ্ড শোভাযাত্রা! পূর্বদিকে নাওয়াদা লছমীপুরার সীমানায় ধন্ঝরি পাহাড়, যে পাহাড়ের নিচে মিছি নদী উত্তরবাহিনী হইয়াছে, সে পাহাড়ের বনশীর্ষে পূর্ণচন্দ্র উঠিতেছে, একদিকে নিচু উপত্যকা, বনে বনে সবুজ, অন্যদিকে ধন্ঝরি শৈলমালা। মাইলখানেক হাঁটিয়া আমরা পাহাড়ের পাদদেশে আসিয়া পৌঁছিলাম। কিছুদূর উঠিতে একটা সমতল স্থান পাহাড়ের মাথায়। জায়গাটার ঠিক মাঝখানে একটা প্রাচীন পিয়াল গাছ-গাছের গুঁড়ি ফুল ও লতায় জড়ানো। রাজা দোবরু বলিলেন-এই গাছ অনেক কালের পুরোনো-আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি এই গাছের তলায় ঝুলনের সময় মেয়েরা নাচে।

আমরা একপাশে তালপাতার চেটাই পাতিয়া বসিলাম, আর এই পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বনান্তস্থলীতে প্রায় ত্রিশটি কিশোরী তরুণী গাছটিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচিতে লাগিল-পাশে পাশে মাদল বাজাইয়া একদল যুবক তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিতেছে। ভানুমতীকে দেখিলাম এই দলের পুরোভাগে। মেয়েদের খোঁপায় ফুলের মালা, গায়ে ফুলের গহনা। …

কত রাত পর্যন্ত সমানভাবে নাচ ও গান চলিল-মাঝে মাঝে দলটি একটু বিশ্রাম করিয়া লয় আবার আরম্ভ করে-মাদলের বোল, জ্যোৎস্না, বর্ষাস্নিগ্ধ বনভূমি, সুঠাম শ্যামা নৃত্যপরায়ণা তরুণীর দল- সব মিলিয়া কোনো বড় শিল্পীর অঙ্কিত একখানি ছবির মতো তা সুশ্রী-একটি মধুর সঙ্গীতের মতো তার আকুল আবেদন। মনে পড়ে দূর ইতিহাসের সোলাঙ্কি-রাজকন্যা ও তার সহচরীগণের এমনি ঝুলন নাচ ও গানের কথা, মনে পড়ে রাখাল বালক বাপ্পাদিত্যকে খেলার ছলে মাল্যদানের কথা।

আজু কি আনন্দ, আজু কি আনন্দ
ঝুলত ঝুলনে শ্যামর চন্দ্

তার চেয়েও বহু দূরের অতীতে, প্রাচীন প্রাচীন যুগের প্রস্তর যুগের ভারতের রহস্যাচ্ছন্ন ইতিহাসের সকল ঘটনা যেন আবার সম্মুখে অভিনীত হইতে দেখিলাম-আদিম ভারতের সংস্কৃতি যেন মূর্তিমতী হইয়া উঠিয়াছে সরলা পর্বতবালা ভানুমতী ও তাহার সখীগণের নৃত্যে-হাজার হাজার বৎসর পূর্বে এমনি কত বন, কত শৈলমালা, এমনিতর কত জ্যোৎস্নারাত্রি, ভানুমতীর মতো কত বালিকার নৃত্যচঞ্চল চরণের ছন্দে আকুল হইয়া উঠিয়াছিল, তাহাদের মুখের সে হাসি আজও মরে নাই-এইসব গুপ্ত অরণ্য ও শৈলমালার আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া তারা তাদের বর্তমান বংশধরগণের রক্তে আজও আনন্দ ও উৎসাহের বাণী পাঠাইয়া দিতেছে।

গভীর রাত্রি। চাঁদ ঢলিয়া পড়িয়াছে পশ্চিম দিকের দূর বনের পিছনে। আমরা সবাই পাহাড় হইতে নামিয়া আসিলাম। সুখের বিষয় আজ আকাশে মেঘ নাই, কিন্তু আর্দ্র বাতাস শেষরাত্রে অত্যন্ত শীতল হইয়া উঠিয়াছে। অত রাত্রেও আমি খাইতে বসিলে ভানুমতী দুধ ও পেঁড়া আনিল।

আমি বলিলাম-বড় চমৎকার নাচ দেখলাম তোমাদের।

সে সলজ্জ হাসিমুখে বলিল-আপনার কি আর ভালো লাগবে বাবুজী-আপনাদের কলকাতায় ওসব কি দ্যাখে?

পরদিন ভানুমতী ও তাহার প্রপিতামহ রাজা দোবরু আমায় কিছুতেই আসিতে দিবে না। অথচ আমার কাজ ফেলিয়া থাকিলে চলে না, বাধ্য হইয়া চলিয়া আসিলাম। আসিবার সময় ভানুমতী বলিল-বাবুজী, কল্কাতা থেকে আমার জন্যে একখানা আয়না এনে দেবেন? আমার আয়না একখানা ছিল, অনেক দিন ভেঙ্গে গিয়েছে।

ষোল বছর বয়সের সুশ্রী নবযৌবনা কিশোরীর আয়নার অভাব! তবে আয়নার সৃষ্টি হইয়াছে কাদের জন্যে? এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ণিয়া হইতে একখানা ভালো আয়না আনাইয়া তাহাকে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম।

0 Shares