আরণ্যক

বিকালের দিকে জুয়াড়ী ধরা পড়িল। সে মাইল তিন দূরে একটি বস্তিতে জুয়া খেলিতেছিল, আমার সিপাহীরা দেখিতে পাইয়া তাহাকে আমার নিকট হাজির করিল। ছেলেমেয়েগুলিও দেখিয়াই চিনিল।

লোকটা প্রথমে পয়সা ফেরত দিতে চায় না। বলে, সে তো জোর করিয়া কাড়িয়া লয় নাই, উহারা স্বেচ্ছায় খেলিয়া পয়সা হারিয়াছে, ইহাতে তাহার দোষ কি? অবশেষে তাহাকে ছেলেমেয়েদের সব পয়সা তো ফেরত দিতেই হইল-আমি তাহাকে পুলিসে দিবার আদেশ দিলাম।

সে হাতে পায়ে ধরিতে লাগিল। বলিলাম-তোমার বাড়ি কোথায়?

– বালিয়া জেলা, বাবুজী।

– এ রকম করে লোককে ঠকাও কেন? কত পয়সা ঠকিয়েছ লোকজনের?

– গরিব লোক, হুজুর! আমায় ছেড়ে দিন এবার। তিন দিনে মোটে দু-টাকা তিন আনা রোজগার-

– তিন দিনে খুব বেশি রোজগার হয়েছে মজুরদের তুলনায়।

– হুজুর, সারা বছরে এ-রকম রোজগার ক’বার হয়? বছরে ত্রিশ-চল্লিশ টাকা আয়।

লোকটাকে সেদিন ছাড়িয়া দিয়াছিলাম- কিন্তু আমার মহাল ছাড়িয়া সেদিনই চলিয়া যাইবার কড়ারে। আর তাকে কোনোদিন কেউ আমাদের মহালের সীমানার মধ্যে দেখেও নাই।

এবার মঞ্চীকে কাটুনী মজুরদের মধ্যে না দেখিয়া উদ্বেগ ও বিস্ময় দুই-ই অনুভব করিলাম। সে বারবার বলিয়াছিল গম কাটিবার সময়ে নিশ্চয়ই আমাদের মহালে আসিবে। ফসল কাটার মেলা আসিল, চলিয়াও গেল- কেন যে সে আসিল না, কিছুই বুঝিলাম না।

অন্যান্য মজুরদের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াও কোনো সন্ধান মিলিল না। মনে ভাবিলাম, এত বিস্তীর্ণ ফসলের মহাল কাছাকাছির মধ্যে আর কোথাও নাই, এক কুশী নদীর দক্ষিণে ইসমাইলপুরের দ্বিয়ারা মহাল ছাড়া। কিন্তু সেখানে কেন সে যাইবে, অত দূরে, যখন মজুরি উভয় স্থানেই একই।

অবশেষে ফসলের মেলার শেষ দিকে জনৈক গাঙ্গোতা মজুরের মুখে মঞ্চীর সংবাদ পাওয়া গেল। সে মঞ্চীকে ও তাহার স্বামী নক্ছেদী ভকতকে চেনে। একসঙ্গে বহু জায়গায় কাজ করিয়াছে নাকি। তাহারই মুখে শুনিলাম গত ফাল্গুন মাসে সে উহাদের আকবরপুর গবর্নমেন্ট খাসমহলে ফসল কাটিতে দেখিয়াছে। তাহার পর তাহারা যে কোথায় গেল সে জানে না।

ফসলের মেলা শেষ হইয়া গেল জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি, এমন সময় একদিন সদর কাছারির প্রাঙ্গণে নক্ছেদী ভকতকে দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। নক্ছেদী আমার পা জড়াইয়া হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। আরো বিস্মিত হইয়া পা ছাড়াইয়া লইয়া বলিলাম- কি ব্যাপার? তোমরা এবার ফসলের সময় আস নি কেন? মঞ্চী ভালো আছে তো? কোথায় সে?

উত্তরে নক্ছেদী যাহা বলিল তাহার মোট মর্ম এই, মঞ্চী কোথায় তাহা সে জানে না। খাসমহলে কাজ করিবার সময়েই মঞ্চী তাহাদের ফেলিয়া কোথায় পালাইয়া গিয়াছে। অনেক খোঁজ করিয়াও তাহার পাত্তা পাওয়া যায় নাই।

বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলাম। কিন্তু দেখিলাম বৃদ্ধ নক্ছেদী ভকতের প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি নাই, যা কিছু ভাবনা সবই সেই বন্য মেয়েটির জন্য। কোথায় সে গেল, কে তাহাকে ভুলাইয়া লইয়া গেল, কি অবস্থায় কোথায় বা সে আছে। সস্তায় বিলাসদ্রব্যের প্রতি তাহার যে রকম আসক্তি লক্ষ্য করিয়াছি সে-সবের লোভ দেখাইয়া তাহাকে ভুলাইয়া লইয়া যাওয়াও কষ্টকর নয়। তাহাই ঘটিয়াছে নিশ্চয়।
জিজ্ঞাসা করিলাম- তার ছেলে কোথায়?

– সে নেই। বসন্ত হয়ে মারা গিয়েছে মাঘ মাসে।

অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম শুনিয়া। বেচারি পুত্রশোকেই উদাসী হইয়া, যেদিকে দু-চোখ যায়, চলিয়া গিয়াছে নিশ্চয়ই। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলাম – তুলসী কোথায়?

– সে এখানেই এসেছে। আমার সঙ্গেই আছে। আমায় কিছু জমি দিন হুজুর। নইলে আমরা বুড়োবুড়ি, ফসল কেটে আর চলে না। মঞ্চী ছিল, তার জোরে আমরা বেড়াতাম। সে আমর হাত-পা ভেঙ্গে দিয়ে গিয়েছে!

সন্ধ্যার পর নক্ছেদীর খুপরিতে গিয়া দেখিলাম তুলসী তাহার ছেলেমেয়ে লইয়া চীনার দানা ছাড়াইতেছে। আমায় দেখিয়া কাঁদিয়া উঠিল। দেখিলাম মঞ্চী চলিয়া যাওয়াতে সেও যথেষ্ট দুঃখিত। বলিল- হুজুর, সব ঐ বুড়োর দোষ। গোরমিণ্টের লোক মাঠে সব টিকে দিতে এল, বুড়ো তাকে চার আনা পয়সা ঘুষ দিয়ে তাড়ালে। কাউকে টিকে নিতে দিল না। বললে, টিকে নিলে বসন্ত হবে। হুজুর, তিন দিন গেল না. মঞ্চীর ছেলেটার বসন্ত হোলো, মারাও গেল। তার শোকে সে পাগলের মতো হয়ে গেল- খায় না, দায় না, শুধু কাঁদে।

– তারপর?

– তারপর হুজুর, খাসমহল থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিলে। বললে-বসন্তে তোমাদের লোক মারা গিয়াছে, এখানে থাকতে দেবো না! এক ছোকরা রাজপুত মঞ্চীর দিকে নজর দিত। যেদিন আমরা খাসমহল থেকে চলে এলাম, সেই রাত্রেই মঞ্চী নিরুদ্দেশ হোলো। আমি সেদিন সকালে ঐ ছোকরাটাকে খুপরির কাছে ঘুরতে দেখেছি। ঠিক তার কাজ, হজুর! ইদানীং মঞ্চী বড় কলকাতা দেখব, কলকাতা দেখব, করত। তখনই জানি একটা কিছু ঘটবে।

আমারও মনে পড়িল মঞ্চী আর-বছর কলিকাতা দেখিবার যথেষ্ট আগ্রহ দেখাইয়াছিল বটে। আশ্চর্য নয়, ধূর্ত রাজপুত যুবক সরলা বন্যমেয়েটিকে কলিকাতা দেখাইবার লোভ দেখাইয়া ভুলাইয়া লইয়া যাইবে।

আমি জানি এ অবস্থায় এদেশের মেয়েদের শেষ পরিণতি হয় আসামের চা-বাগানে কুলিগিরিতে। মঞ্চীর অদৃষ্টে কি শেষকালে নির্বান্ধব আসামের পার্বত্য অঞ্চলে দাসত্ব ও নির্বাসন লেখা আছে?

বৃদ্ধ নক্ছেদীর উপর খুব রাগ হইল। এই লোকটা যত নষ্টের মূল। বৃদ্ধ বয়সে মঞ্চীকে বিবাহ করিতে গিয়াছিল কেন? দ্বিতীয়, গবর্নমেণ্টের টিকাদারকে ঘুষ দিয়া বিদায় করিয়াছিল কেন? যদি উহাকে জমি দিই, সে ওর জন্য নয়, উহার প্রৌঢ়া স্ত্রী তুলসী ও ছেলেমেয়েগুলির মুখের দিকে চাহিয়াই দিব।

দিলামও তাই। নাঢ়া-বইহারে শীঘ্র প্রজা বসাইতে হইবে, সদর আপিসের হুকুম আসিয়াছে, প্রথম প্রজা বসাইলাম নক্ছেদীকে।

নাঢ়া-বইহারে ঘোর জঙ্গল। মাত্র দু-চার ঘর প্রজা সামান্য জঙ্গল কাটিয়া খুপরি বাঁধিতে শুরু করিয়াছে। নক্ছেদী প্রথমেই জঙ্গল দেখিয়া পিছাইয়া গিয়াছিল, বলিল-হুজুর দিনমানেই বাঘে খেয়ে ফেলে দেবে ওখানে-কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ঘর করি-

তাহাকে স্পষ্ট বলিয়া দিলাম, তার পছন্দ না হয়, সে অন্যত্র দেখুক।

নিরুপায় হইয়া নক্ছেদী নাঢ়া-বইহারের জঙ্গলেই জমি লইল।


সে এখানে আসা পর্যন্ত আমি কখনো তাহার খুপরিতে যাই নাই। তবে সেদিন সন্ধ্যার সময় নাঢ়া বইহারের জঙ্গলের মধ্যে দিয়া আসিতে দেখি ঘন জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা ফাঁকা জায়গা-নিকটে কাশের দুটি ছোট খুপরি। একটার ভিতর হইতে আলো বাহির হইতেছে।

সেইটাই যে নক্ছেদীর তা আমি জানিতাম না, ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনিয়া যে প্রৌঢ়া স্ত্রীলোকটি খুপরির বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল- দেখিলাম সে তুলসী।

– তোমরা এখানে জমি নিয়েছ? নক্ছেদী কোথায়?

তুলসী আমায় দেখিয়া থতমত খাইয়া গিয়াছে। ব্যস্তসমস্ত হইয়া সে গমের ভুসি-ভরা একটা চটের গদি পাতিয়া দিয়া বলিল-নামুন বাবুজী- বসুন একটু। ও গিয়েছে লবটুলিয়া, তেল নুন কিনে আনতে দোকানে। বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে।

– তুমি একা এই ঘন বনের মধ্যে আছ?

– ও-সব সয়ে গিয়েছে, বাবুজী। ভয়ডর করলে কি আমাদের গরিবদের চলে? একা তো থাকতে হত না-কিন্তু অদৃষ্ট যে খারাপ। মঞ্চী যত দিন ছিল, জলে জঙ্গলে কোথাও ভয় ছিল না। কি সাহস, কি তেজ ছিল তার বাবুজী!

তুলসী তাহার তরুণী সপত্নীকে ভালবাসিত। তুলসী ইহাও জানে এই বাঙালি বাবু মঞ্চীর কথা শুনিতে পাইলে খুশি হইবে।

তুলসীর মেয়ে সুরতিয়া বলিল-বাবুজী, একটা নীলগাইয়ের বাচ্চা ধরে রেখেছি, দেখবেন? সেদিন আমাদের খুপরির পেছনের জঙ্গলে এসে বিকেলবেলা খস্‌খস্ করছিল-আমি আর ছনিয়া গিয়ে ধরে ফেলেছি। বড় ভালো বাচ্চা।

বলিলাম-কি খায় রে?

সুরতিয়া বলিল-শুধু চীনার দানার ভুসি আর গাছের কচি পাতা। আমি কচি কেঁদ পাতা তুলে এনে দিই।

তুলসী বলিল-দেখা না বাবুজীকে-

সুরতিয়া ক্ষিপ্রপদে হরিণীর মতো ছুটিয়া খুপরির পিছন দিকে অদৃশ্য হইল। একটু পরে তাহার বালিকা-কণ্ঠের চিৎকার শোনা গেল-আরে নীলগাইয়া তো ভাগলুয়া হৈ রে ছনিয়া-উধার-ইধার-জলদি পাকড়া-

দুই বোনে হুটাপুটি করিয়া নীলগাইয়ের বাচ্চা পাকড়াও করিয়া ফেলিল এবং হাঁপাইতে হাঁপাইতে হাসিমুখে আমার সামনে আনিয়া হাজির করিল।

0 Shares