আরণ্যক

অন্ধকারে আমার দেখিবার সুবিধার জন্য তুলসী একখানা জ্বলন্ত কাঠ উঁচু করিয়া ধরিল। সুরতিয়া বলিল, কেমন, ভালো না বাবুজী? একে খাবার জন্যে কাল রাত্রে ভালুক এসেছিল। ওই মহুয়া গাছে কাল ভালুক উঠেছিল মহুয়া ফুল খেতে-তখন অনেক রাত-বাপ মা ঘুমোয়, আমি সব টের পাই-তারপর গাছ থেকে নেমে আমাদের খুপরির পেছনে এসে দাঁড়াল। আমি একে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে শুই রাতে-ভালুকের পায়ের শব্দ পেয়ে ওর মুখ হাত দিয়ে জোর করে চেপে আরো জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলুম-

-ভয় করল না তোর, সুরতিয়া ?

-ইস্! ভয় বই কি! ভয় আমি করি নে। কাঠ কুড় ুতে গিয়ে জঙ্গলে কত ভালুক-ঝোড় দেখি-তাতেও ভয় করি নে। ভয় করলে চলে বাবুজী?

সুরতিয়া বিজ্ঞের মতো মুখখানা করিল।

বড় বড় কলের চিমনির মতো লম্বা, কালো কেঁদ গাছের গুঁড়ি ঠেলিয়া আকাশে উঠিয়াছে খুপরির চারিধারে, যেন কালিফোর্নিয়া রেডউড গাছের জঙ্গল। বাদুড় ও নিশাচর কাঁকপাখির ডানা-ঝটাপটি ডালে ডালে, ঝোপে ঝোপে অন্ধকারে জোনাকির ঝাঁক জ্বলিতেছে, খুপরির পিছনের বনেই শিয়াল ডাকিতেছে-এই কয়টি ছোট ছেলেমেয়ে লইয়া উহাদের মা যে কেমন করিয়া এই নির্জন বনে-প্রান্তরে থাকে, তাহা বুঝিয়া ওঠা কঠিন। হে বিজ্ঞ, রহস্যময় অরণ্য, আশ্রিত জনের প্রতি তোমার সত্যই বড় কৃপা।

কথায় কথায় বলিলাম-মঞ্চী নিজের জিনিস সব নিয়ে গিয়েছে?

সুরতিয়া বলিল-ছোট মা কোনো জিনিস নিয়ে যায় নি। ওর যে বাক্সটা সেবার দেখেছিলেন-ফেলেই রেখে গিয়েছে। দেখবেন? আনছি।
বাক্সটা আনিয়া সে আমার সামনে খুলিল। চিরুনি, ছোট আয়না, পুঁতির মালা, একখানা সবুজ-রঙের খেলো রুমাল-ঠিক যেন ছোট খুকির পুতুলখেলার বাক্স! সেই হিংলাজের মালাছড়াটা কিন্তু নাই, সেবার লবটুলিয়া খামারে সেই যেটা কিনিয়াছিল।

কোথায় চলিয়া গেল নিজের ঘর-সংসার ছাড়িয়া কে বলিবে? ইহারা তো জমি লইয়া এতদিন পরে গৃহস্থালি পাতাইয়া বসবাস শুরু করিয়াছে, ইহাদের দলের মধ্যে সে-ই কেবল যে-ভবঘুরেই রহিয়া গেল!

ঘোড়ায় উঠিবার সময় সুরতিয়া বলিল-আর একদিন আসবেন বাবুজী-আমরা পাখি ধরি ফাঁদ পেতে। নূতন ফাঁদ বুনেছি। একটা ডাহুক আর একটা গুড়গুড়ি পাখি পুষেছি। এরা ডাকলে বনের পাখি এসে ফাঁদে পড়ে-আজ আর বেলা নেই-নইলে ধরে দেখাতাম-

নাঢ়া-বইহারের বন-প্রান্তরের পথে এত রাত্রে আসিতে ভয় ভয় করে। বাঁয়ে ছোট একটি পাহাড়ি ঝরনার জলস্রোত কুলকুল করিয়া বহিতেছে, কোথায় কি বনের ফুল ফুটিয়াছে, গন্ধে ভরা অন্ধকার এক-এক জায়গায় এত নিবিড় যে ঘোড়ার ঘাড়ের লোম দেখা যায় না, আবার কোথাও নক্ষত্রালোকে পাতলা।

নাঢ়া বইহার নানাপ্রকার বৃক্ষলতা, বন্যজন্তু ও পাখিদের আশ্রয়স্থান- প্রকৃতি ইহার বনভূমি ও প্রান্তরকে অজস্র সম্পদে সাজাইয়াছে, সরস্বতী কুণ্ডী এই নাঢ়া-বইহারেরই উত্তর সীমানায়। প্রাচীন জরিপের থাক-নক্সায় দেখা যায় সেখানে কুশী নদীর প্রাচীন খাত ছিল-এখন মজিয়া মাত্র ঐ জলটুকু অবশিষ্ট আছে- অন্যদিকে সেই প্রাচীন খাতই ঘন অরণ্যে পরিণত-

পুরা যত্র স্রোতঃ পুলিনমধুনা তত্র সরিতাম-

কি অবর্ণনীয় শোভা দেখিলাম এই বনভূমির সেই নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত্রে! কিন্তু মন খারাপ হইয়া গেল যখন বেশ বুঝিলাম নাঢ়া-বইহারের এ বন আর বেশি দিন নয়। এত ভালবাসি ইহাকে অথচ আমার হাতেই ইহা বিনষ্ট হইল। দু-বৎসরের মধ্যেই সমগ্র মহালটি প্রজাবিলি হইয়া কুশ্রী টোলা ও নোংরা বস্তিতে ছাইয়া ফেলিল বলিয়া। প্রকৃতি নিজের হাতে সাজানো তার শত বৎসরের সাধনার ফল এই নাঢ়া-বইহার, ইহার অতুলনীয় বন্য সৌন্দর্য ও দূরবিসর্পী প্রান্তর লইয়া বেমালুম অন্তর্হিত হইবে। অথচ কি পাওয়া যাইবে তাহার বদলে?

কতকগুলি খোলার চালের বিশ্রী ঘর, গোয়াল, মকাই জনারের ক্ষেত, শোনের গাদা, দড়ির চারপাই, হনুমানজীর ধ্বজা, ফনিমনসার গাছ, যথেষ্ট দোক্তা, যথেষ্ট খৈনী, যথেষ্ট কলেরা ও বসন্তের মড়ক।

হে অরণ্য, হে সুপ্রাচীন, আমায় ক্ষমা করিও।

আর একদিন গেলাম সুরতিয়াদের পাখি-ধরা দেখিতে।

সুরতিয়া ও ছনিয়া দুটি খাঁচা লইয়া আমার সঙ্গে নাঢ়া-বইহারের জঙ্গলের বাহিরে মুক্ত প্রান্তরের দিকে চলিল।

বৈকালবেলা, নাঢ়া-বইহারের মাঠে সুদীর্ঘ ছায়া ফেলিয়া সূর্য পাহাড়ের আড়ালে নামিয়া পড়িয়াছে।

একটা শিমুলচারার তলায় ঘাসের উপর খাঁচা দুটি নামাইল। একটিতে একটি বড় ডাহুক অন্যটিতে গুড়গুড়ি। এ দুটি শিক্ষিত পাখি, বন্য পাখিকে আকৃষ্ট করিবার জন্য ডাহুকটি অমনি ডাকিতে আরম্ভ করিল।

গুড়গুড়িটা প্রথমত ডাকে নাই।

সুরতিয়া শিস্ দিয়া তুড়ি দিয়া বলিল-বোলো রে বহিনিয়া-তোহর কির-

গুড়গুড়ি অমনি ডাকিয়া উঠিল-গুড়-ড়-ড়-ড়-

নিস্তব্ধ অপরাহে¦ বিস্তীর্ণ মাঠের নির্জনতার মধ্যে সে অদ্ভুত সুর শুধুই মনে আনিয়ে দেয় এমনি দিগন্তবিস্তীর্ণতার ছবি, এমনি মুক্ত দিক্চক্রবালের স্বপ্ন, ছায়াহীন জ্যোৎস্নালোক নিকটেই ঘাসের মধ্যে যেখানে রাশি রাশি হলুদ রঙের দুধলি ফুল ফুটিয়াছে তারই উপর ছনিয়া ফাঁদ পাতিল-যেন পাখির খাঁচার বেড়ার মতো, বাঁশের তৈরি। সেই বেড়া ক’খানা দিয়া গুড়গুড়ি-পাখির খাঁচাটা ঢাকিয়া দিল।

সুরতিয়া বলিল-চলুন বাবুজী, লুকিয়ে বসি গে ঝোপের আড়ালে, মানুষ দেখলে চিড়িয়া ভাগবে।-সবাই মিলিয়া আমরা শাল-চারার আড়ালে কতক্ষণ ঘাপটি মারিয়া বসিয়া রহিলাম।-

ডাহুকটি মাঝে মাঝে থামিতেছে-গুড়গুড়ির কিন্তু রবের বিরাম নাই-একটানা ডাকিয়াই চলিয়াছে- গুড়-ড়-ড়-ড়-

সে কি মধুর অপার্থিব রব! বলিলাম- সুরতিয়া, তোদের গুড়গুড়িটা বিক্রি করবি? কত দাম?

সুরতিয়া বলিল-চুপ চুপ বাবুজী, কথা বলবেন না-ঐ শুনুন বুনো পাখি আসছে-

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিবার পরে অন্য একটি সুর মাঠের উত্তর দিকে বন-প্রান্তর হইতে ভাসিয়া আসিল-গুড়-ড়-ড়-ড়।

আমার শরীর শিহরিয়া উঠিল। বনের পাখি খাঁচার পাখির সুরে সাড়া দিয়েছে।

ক্রমে সে সুর খাঁচার নিকটবর্তী হইতে লাগিল।

কিছুক্ষণ ধরিয়া দুইটি পাখির রব পাশাপাশি শোনা যাইতেছিল, ক্রমে দুইটি সুর যেন মিশিয়া এক হইয়া গেল…হঠাৎ আবার একটা সুর… একটা পাখিই ডাকিতেছে…খাঁচার পাখিটা।

ছনিয়া ও সুরতিয়া ছুটিয়া গেল, ফাঁদে পাখি পড়িয়াছে। আমিও ছুটিয়া গেলাম।

ফাঁদে পা বাঁধাইয়া পাখিটা ঝট্পট্ করিতেছে। ফাঁদে পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে তাহার ডাক বন্ধ হইয়া গিয়াছে-কি আশ্চর্য কাণ্ড! চোখকে যেন বিশ্বাস করা শক্ত।

সুরতিয়া পাখিটা হাতে তুলিয়া দেখাইল-দেখুন বাবুজী, কেমন ফাঁদে পা আটকেছে। দেখলেন?

সুরতিয়াকে বলিলাম-পাখি তোরা কি করিস!

সে বলিল-বাবা তিরাশি-রতনগঞ্জের হাটে বিক্রি করে আসে। এক একটা গুড়গুড়ি দু’পয়সা-একটা ডাহুক সাত পয়সা।

বলিলাম-আমাকে বিক্রি কর, দাম দেব।

সুরতিয়া গুড়গুড়িটা আমায় এমনি দিয়া দিল-কিছুতেই তাহাকে পয়সা লওয়াইতে পারিলাম না।


আশ্বিন মাস। এই সময় একদিন সকালে পত্র পাইলাম রাজা দোবরু পান্না মারা গিয়াছেন, এবং রাজপরিবার খুব বিপন্ন-আমি সময় পাইলে যেন যাই। পত্র দিয়াছে জগরু পান্না, ভানুমতীর দাদা।

তখনি রওনা হইয়া সন্ধ্যার কিছু পূর্বে চক্মকিটোলা পৌঁছিয়া গেলাম। রাজার বড় ছেলে ও নাতি আমাকে আগাইয়া লইয়া গেল। শুনিলাম, রাজা দোবরু গোরু চরাইতে চরাইতে হঠাৎ পড়িয়া গিয়া হাঁটুতে আঘাতপ্রাপ্ত হন, শেষ পর্যন্ত হাঁটুর সেই আঘাতেই তাঁর মৃত্যুর কারণ ঘটে।

রাজার মৃত্যুসংবাদ পাওয়া মাত্র মহাজন আসিয়া গোরু-মহিষ বাঁধিয়া রাখিয়াছে। টাকা না পাইলে সে গোরু-মহিষ ছাড়িবে না। এদিকে বিপদের উপর বিপদ, নূতন রাজার অভিষেক-উৎসব আগামীকল্য সম্পন্ন হইবে। তাহাতেও কিছু খরচ আছে। কিন্তু সে-টাকা কোথায়? তা ছাড়া গোরু-মহিষ মহাজনে যদি লইয়া যায়, তবে রাজপরিবারের অবস্থা খুবই হীন হইয়া পড়িবে-ঐ দুধের ঘি বিক্রয় করিয়া রাজার সংসারের অর্ধেক খরচ চলিত-এখন তাহাদের না খাইয়া মরিতে হইবে।

শুনিয়া আমি মহাজনকে ডাকাইলাম। তার নাম বীরবর সিং। আমার কোনো কথাই সে দেখিলাম শুনিতে প্রস্তুত নয়। টাকা না পাইলে কিছুতেই সে গোরু-মহিষ ছাড়িবে না। লোকটা ভালো নয় দেখিলাম।

0 Shares