আরণ্যক

এই সেই কাশীর বাইজীর মেয়ে, প্রেমবিহ্বলা কুন্তা!…প্রেমের উজ্জ্বল বর্তিকা এই দুঃখিনী রমণীর হাতে এখনো সগৌরবে জ্বলিতেছে, তাই ওর এত দুঃখ-দৈন্য, এত হেনস্থা, অপমান। প্রেমের মান রাখিয়াছে কুন্তা।

বলিলাম- কুন্তা, জমি নেবে?

কুন্তা কথাটি ঠিক শুনিয়াছে কি না যেন বুঝিতে পারিল না। বিস্মিত মুখে বলিল-জমি, হুজুর?

– হাঁ, জমি। নূতন বিলি জমি!

কুন্তা একটুখানি কি ভাবিল। পরে বলিল- আগে তো আমাদেরই কত জোতজমা ছিল। প্রথম প্রথম এসে দেখেছি। তারপর সব গেল একে একে। এখন আর কি দিয়ে জমি নেব, হুজুর?

– কেন, সেলামির টাকা দিতে পারবে না?

– কোথা থেকে দেব? রাত্তির করে ক্ষেত থেকে ফসল কুড়োই পাছে দিনমানে কেউ অপমান করে। আধ টুক্রি এক টুক্রি কলাই পাই- তাই গুঁড়ো করে ছাতু করে বাচ্ছাদের খাওয়াই। নিজে খেতে সব দিন কুলোয় না-

কুন্তা কথা বন্ধ করিয়া চোখ নিচু করিল। দুই চোখ বাহিয়া টস্‌টস্ করিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।

আস্‌রফি সরিয়া গেল। ছোকরার হৃদয় কোমল, এখনো পরের দুঃখ ভালো রকম সহ্য করিতে পারে না।

আমি বলিলাম- কুন্তা, আচ্ছা ধর যদি সেলামি না লাগে?

কুন্তা চোখ তুলিয়া জলভরা বিস্মিত চোখে আমার মুখের দিকে চাহিল।

আস্‌রফি তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া কুন্তার সামনে হাত নাড়িয়া বলিল- হুজুর তোমায় এমনি জমি দেবেন, এমনি জমি দেবেন- বুঝলে না দাইজী?

আস্‌রফিকে বলিলাম- ওকে জমি দিলে ও চাষ করবে কি করে আস্‌রফি?

আস্‌রফি বলিল- সে বেশি কঠিন কথা নয় হুজুর। ওকে দু-একখানা লাঙল দয়া করে সবাই ভিক্ষে দেবে। এত ঘর গাঙ্গোতা প্রজা, একখানা লাঙল ঘর-পিছু দিলেই ওর জমি চাষ হয়ে যাবে। আমি সে-ভার নেব, হুজুর।

– আচ্ছা, কত বিঘে হলে ওর হয়, আস্‌রফি?

– দিচ্ছেন যখন মেহেরবানি করে হুজুর, দশ বিঘে দিন।

কুন্তাকে জিজ্ঞাসা করিলাম- কুন্তা, কেমন, দশ বিঘে জমি যদি তোমায় বিনা সেলামিতে দেওয়া যায়- তুমি ঠিকমতো চাষ করে ফসল তুলে কাছারির খাজনা শোধ করতে পারবে তো? অবিশ্যি প্রথম দু-বছর তোমার খাজনা মাফ। তৃতীয় বছর থেকে খাজনা দিতে হবে।

কুন্তা যেন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছে। আমরা তাহাকে লইয়া ঠাট্টা করিতেছি, না সত্য কথা বলিতেছি- ইহাই যেন এখনো সম্‌ঝাইয়া উঠিতে পারে নাই।

কতকটা দিশাহারাভাবে বলিল- জমি! দশ বিঘে জমি!

আস্‌রফি আমার হইয়া বলিল- হাঁ- হুজুর তোমায় দিচ্ছেন। খাজনা এখন দু-বছর মাফ। তীসরা সাল থেকে খাজনা দিও। কেমন রাজি?

কুন্তা লজ্জাজড়িত মুখে আমার দিকে চাহিয়া বলিল-জ্বি হুজুর মেহেরবান। পরে হঠাৎ বিহ্বলার মতো কাঁদিয়া ফেলিল।

আমার ইঙ্গিতে আস্‌রফি তাহাকে লইয়া চলিয়া গেল।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ


সন্ধ্যার পরে লবটুলিয়ার নূতন বস্তিগুলি দেখিতে বেশ লাগে। কুয়াশা হইয়াছে বলিয়া জ্যোৎস্না একটু অস্পষ্ট, বিস্তীর্ণ প্রান্তরব্যাপী কৃষিক্ষেত্র, দূরে দূরে দু-পাঁচটা আলো জ্বলিতেছে বিভিন্ন বস্তিতে। কত লোক, কত পরিবার অন্নের সংস্থান করিতে আসিয়াছে আমাদের মহালে-বন কাটিয়া গ্রাম বসাইয়াছে, চাষ আরম্ভ করিয়াছে। আমি সব বস্তির নামও জানি না, সকলকে চিনিও না। কুয়াশাবৃত জ্যোৎস্নালোকে এখানে ওখানে দূরে নিকটে ছড়ানো বস্তিগুলি কেমন রহস্যময় দেখাইতেছে। যে-সব লোক এইসব বস্তিতে বাস করে, তাহাদের জীবনও আমার কাছে এই কুয়াশাচ্ছন্ন জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রির মতো রহস্যাবৃত। ইহাদের কাহারো কাহারো সঙ্গে আলাপ করিয়া দেখিয়াছি- জীবন সম্বন্ধে ইহাদের দৃষ্টিভঙ্গি, ইহাদের জীবনযাত্রাপ্রণালী আমার বড় অদ্ভুত লাগে।

প্রথম ধরা যাক ইহাদের খাদ্যের কথা। আমাদের মহালের জমিতে বছরে তিনটি খাদ্যশস্য জন্মায়- ভাদ্র মাসে মকাই, পৌষ মাসে কলাই এবং বৈশাখ মাসে গম। মকাই খুব বেশি হয় না, কারণ ইহার উপযুক্ত জমি বেশি নাই। কলাই ও গম যথেষ্ট উৎপন্ন হয়, কলাই বেশি, গম তাহার অর্ধেক। সুতরাং লোকের প্রধান খাদ্য কলাইয়ের ছাতু।

ধান একেবারেই হয় না-ধানের উপযুক্ত নাবাল-জমি নাই। এ অঞ্চলের কোথাও- এমন কি কড়ারী জমিতে কিংবা গবর্নমেণ্ট খাসমহালেও ধান হয় না। ভাত জিনিসটা সুতরাং এখানকার লোকে কালেভদ্রে খাইতে পায়-ভাত খাওয়াটা শখের বা বিলাসিতার ব্যাপার বলিয়া গণ্য। দু-চার জন খাদ্যবিলাসী লোক গম বা কলাই বিক্রয় করিয়া ধান কিনিয়া আনে বটে, কিন্তু তাহাদের সংখ্যা আঙ্গুলে গোনা যায়।

তারপর ধরা যাক ইহাদের বাসগৃহের কথা। এই যে আমাদের মহালের দশ হাজার বিঘা জমিতে অগণ্য গ্রাম বসিয়াছে- সব গৃহস্থের বাড়িই জঙ্গলের কাশ ছাওয়া, কাশডাঁটার বেড়া, কেহ কেহ তাহার উপর মাটি লেপিয়াছে, কেহ কেহ তাহা করে নাই। এদেশে বাঁশগাছ আদৌ নাই, সুতরাং বনের গাছের, বিশেষ করিয়া কেঁদ ও পিয়াল ডালের বাতা, খুঁটি ও আড়া দিয়াছে ঘরে।

ধর্মের কথা বলিয়া কোনো লাভ নাই। ইহারা যদিও হিন্দু, কিন্তু তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে ইহারা হনুমানজীকে কি করিয়া বাছিয়া বাহির করিয়া লইয়াছে জানি না-প্রত্যেক বস্তিতে একটা উঁচু হনুমানজীর ধ্বজা থাকিবেই-এই ধ্বজার রীতিমতো পূজা হয়, ধ্বজার গায়ে সিঁদুর লেপা হয়। রাম-সীতার কথা ক্বচিৎ শোনা যায়, তাঁহাদের সেবকের গৌরব তাঁহাদের দেবত্বকে একটু বেশি আড়ালে ফেলিয়াছে। বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেবদেবীর পূজার প্রচার তত নাই-আদৌ আছে কি না সন্দেহ, অন্তত আমাদের মহালে তো আমি দেখি নাই।

ভুলিয়া গিয়াছি, একজন শিবভক্ত দেখিয়াছি বটে। তার নাম দ্রোণ মাহাতো, জাতিতে গাঙ্গোতা। কাছারিতে কোথা হইতে কে একটা শিলাখণ্ড আনিয়া আজ নাকি দশ-বারো বছর কাছারির হনুমানজীর ধ্বজার নিচে রাখিয়া দিয়াছে-সিপাহীরা মাঝে মাঝে পাথরখানাতে সিঁদুর মাখায়, একঘটি জলও কেউ কেউ দেয়। কিন্তু পাথরখানা বেশির ভাগ অনাদৃত অবস্থাতেই পড়িয়া থাকে।

কাছারির কিছুদূরে একটা নূতন বস্তি আজ মাস-দুই গড়িয়া উঠিয়াছে-দ্রোণ মাহাতো সেখানে আসিয়া ঘর বাঁধিয়াছে। দ্রোণের বয়স সত্তরের বেশি ছাড়া কম নয়- প্রাচীন লোক বলিয়াই তাহার নাম দ্রোণ, আধুনিক কালের ছেলেছোকরা হইলে নাকি নাম হইত ডোমন, লোধাই, মহারাজ ইত্যাদি। এসব বাবুগিরি নাম সেকালে বাপ-মায়ে রাখিতে লজ্জাবোধ করিত।

যাহা হউক, বৃদ্ধ দ্রোণ একবার কাছারি আসিয়া হনুমান-ধ্বজার নিচে পাথরখানা লক্ষ্য করিল। তারপর হইতে বৃদ্ধ কল্বলিয়া নদীতে প্রাতঃস্নান করিয়া একঘটি জল প্রত্যহ আনিয়া নিয়মিতভাবে পাথরের উপরে ঢালিত ও সাতবার পরম ভক্তিভরে প্রদক্ষিণ করিয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া তবে বাড়ি ফিরিত।

দ্রোণকে বলিয়াছিলাম-কল্বলিয়া তো এক ক্রোশ দূর, রোজ যাও সেখানে, তার চেয়ে ছোট কুণ্ডীর জল আনলেই পার-

দ্রোণ বলিল-মহাদেওজী স্রোতের জলে তুষ্ট থাকেন, বাবুজী। আমার জন্ম সার্থক যে ওঁকে রোজ জল দিয়ে স্নান করাতে পাই।

ভক্তও ভগবানকে গড়ে। দ্রোণ মাহাতোর শিবপূজার কাহিনী লোকমুখে বিভিন্ন বস্তিতে ছড়াইয়া পড়িতেই মাঝে মাঝে দেখি দু-পাঁচজন শিবের পূজারী নরনারী যাতায়াত শুরু করিল। এ অঞ্চলে এক ধরনের সুগন্ধ ঘাস জঙ্গলে উৎপন্ন হয়, ঘাসের পাতা বা ডাঁটা হাতে লইয়া আঘ্রাণ লইলে চমৎকার সুবাস পাওয়া যায়। ঘাস যত শুকায়, গন্ধ তত তীব্র হয়। কে একজন সেই ঘাস আনিয়া শিবঠাকুরের চারিধারে রোপণ করিল। একদিন মটুকনাথ পণ্ডিত আসিয়া বলিল- বাবুজী, – একজন গাঙ্গোতা কাছারির শিবের মাথায় জল ঢালে, এটা কি ভালো হচ্ছে?

বলিলাম- পণ্ডিতজী, সেই গাঙ্গোতাই ওই ঠাকুরটিকে লোকসমাজে প্রচার করেছে যতদূর দেখতে পাচ্ছি! কই তুমিও তো ছিলে, একঘটি জল তো কোনোদিন দিতে দেখি নি তোমায়।

রাগের মাথায় খেই হারাইয়া মটুকনাথ বলিয়া বসিল- ও শিবই নয় বাবুজী। ঠাকুর প্রতিষ্ঠা না করলে পুজো পাওয়ার যোগ্য হয় না। ও তো একখানা পাথরের নুড়ি।

-তবে আর বলছ কেন? পাথরের নুড়িতে জল দিলে তোমার আপত্তি কি?

সেই হইতেই দ্রোণ মাহাতো কাছারির শিবলিঙ্গের চার্টার্ড পূজারী হইয়া গেল।

কার্তিক মাসে ছট্-পরব এদেশের বড় উৎসব। বিভিন্ন টোলা হইতে মেয়েরা হলুদ-ছোপানো শাড়ি পরিয়া দলে দলে গান করিতে করিতে কল্বলিয়া নদীতে ছট্ ভাসাইতে চলিয়াছে। সারাদিন উৎসবের ধুম। সন্ধ্যায় বস্তিগুলির কাছ দিয়া যাইতে যাইতে ছট্-পরবের পিঠে ভাজার ভরপুর গন্ধ পাওয়া যায়। কত রাত পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের হাসি কলরব, মেয়েদের গান- যেখানে নীলগাইয়ের জেরা গভীর রাত্রে দৌড়িয়া যাইত, হায়েনার হাসি ও বাঘের কাশি (অভিজ্ঞ ব্যক্তি জানে, বাঘে অবিকল মানুষের গলায় কাশির মতো একপ্রকার শব্দ করে ) শোনা যাইত- সেখানে আজকাল কলহাস্যমুখরিত, গীতিরবপূর্ণ উৎসবদীপ্ত এক বিস্তীর্ণ জনপদ।

0 Shares