আরণ্যক

ছট্-পরবের সন্ধ্যায় ঝল্লুটোলায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গেলাম। শুধু এই একটি টোলায় নয়-পনেরোটি বিভিন্ন টোলা হইতে ছট্-পরবের নিমন্ত্রণ পাইয়াছি কাছারিসুদ্ধ সকল আমলা।

ঝল্লুটোলার মোড়ল ঝল্লু মাহাতোর বাড়ি গেলাম প্রথমে।

ঝল্লু মাহাতোর বাড়ির একপাশে দেখি এখনো জঙ্গল কিছু কিছু আছে। ঝল্লু উঠানে এক ছেঁড়া সামিয়ানা টাঙাইয়াছে- তাহারই তলায় আমাদের আদর করিয়া বসাইল। টোলার সকল লোক ফর্সা ধুতি ও মেরজাই পরিয়া সেখানে ঘাসে-বোনা একজাতীয় মাদুরের আসনে বসিয়া আছে। বলিলাম- খাইবার অনুরোধ রাখিতে পারিব না, কারণ অনেক স্থানে যাইতে হইবে।

ঝল্লু বলিল- একটু মিষ্টিমুখ করতেই হবে। মেয়েরা নইলে বড় ক্ষুন্ন হবে, আপনি পায়ের ধুলো দেবেন বলে ওরা বড় উৎসাহ করে পিঠে তৈরি করেছে।

উপায় নাই। গোষ্ঠবাবু মুহুরী, আমি ও রাজু পাঁড়ে বসিয়া গেলাম। শালপাতায় কয়েখখানি আটা ও গুড়ের পিঠে আসিল- এক-একখানি পিঠে এক ইঞ্চি পুরু ইটের মতো শক্ত, ছুঁড়িয়া মারিলে মানুষ মরিয়া না গেলেও দস্তুরমতো জখম হয়। অথচ প্রত্যেকখানা পিঠে ছাঁচে ফেলা চন্দ্রপুলির মতো বেশ লতাপাতা কাটা। ছাঁচে ফেলিবার পরে তবে ঘিয়ে ভাজা হইয়াছে।

অত যত্নে মেয়েদের হাতে তৈরি পিষ্টকের সদ্ব্যবহার করিতে পারিলাম না। আধখানা অতিকষ্টে খাইয়াছিলাম। না মিষ্টি, না কোনো স্বাদ। বুঝিলাম গাঙ্গোতা মেয়েরা খাবারদাবার তৈরি করিতে জানে না। রাজু পাঁড়ে কিন্তু চার-পাঁচখানা সেই বড় বড় পিঠে দেখিতে দেখিতে খাইয়া ফেলিল এবং আমাদের সামনে চক্ষুলজ্জা বশতই বোধ হয় আর চাহিতে পারিল না।

ঝল্লুটোলা হইতে গেলাম লোধাইটোলা। তারপর পর্বতটোলা, ভীমদাসটোলা, আস্রফিটোলা, লছমনিয়াটোলা। প্রত্যেক টোলায় নাচগান, হাসিবাজনার ধুম। আজ সারারাত ইহারা ঘুমাইবে না। এ-বাড়ি ও-বাড়ি খাওয়াদাওয়া করিয়া নাচগান করিয়াই কাটাইয়া দিবে!

একটি ব্যাপার দেখিয়া আনন্দ হইল, মেয়েরা সব টোলাতেই যত্ন করিয়া নাকি খাবার তৈরি করিয়াছে আমাদের জন্য। ম্যানেজারবাবু নিমন্ত্রণে আসিবেন শুনিয়া তাহারা অত্যন্ত উৎসাহের ও যত্নের সহিত নিজেদের চরম রন্ধনকৌশল প্রদর্শন করিয়া পিষ্টক গড়িয়াছে। মেয়েদের সহৃদয়তার জন্য মনে মনে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ হইলেও তাহাদের রন্ধনবিদ্যার প্রশংসা করিয়া উঠিতে পারিলাম না, ইহা আমার পক্ষে খুবই দুঃখের বিষয়। ঝল্লুটোলার অপেক্ষা নিকৃষ্টতর পিষ্টকের সহিতও স্থানে স্থানে পরিচয় ঘটিল।

সব জায়গায়ই দেখি রঙিন শাড়ি-পরা মেয়েরা কৌতূলহলপূর্ণ চোখে আড়াল হইতে ভোজনরত বাঙালি বাবুদের দিকে চাহিয়া আছে। রাজু পাঁড়ে কাহাকেও মনে কষ্ট দিল না-পিষ্টক ভক্ষণের সীমা অতিক্রম করিয়া রাজু পাঁড়ে ক্রমশ অসীমের দিকে চলিতে লাগিল দেখিয়া আমি গণনার হাল ছাড়িয়া দিলাম- সুতরাং সে কয়খানা পিষ্টক খাইয়াছিল বলিতে পারিব না।

শুধু রাজু কেন- নিমন্ত্রিত গাঙ্গোতাদের মধ্যে সেই ইটের মতো কঠিন পিষ্টক এক-একজন এক কুড়ি দেড় কুড়ি করিয়া খাইল-চোখে না দেখিলে বিশ্বাস করা শক্ত যে সেই জিনিস মানুষে অত খাইতে পারে।

নাঢ়া-বইহারে ছনিয়া ও সুরতিয়াদের ওখানে গেলাম।

সুরতিয়া আমায় দেখিয়া ছুটিয়া আসিল।

-বাবুজী, এত রাত করে ফেললেন? আমি আর মা দু-জনে বসে আপনার জন্যে আলাদা করে পিঠে গড়েছি-আমরা হাঁ করে বসে আছি আর ভাবছি এত দেরি হচ্ছে কেন। আসুন, বসুন।

নক্ছেদী সকলকে খাতির করিয়া বসাইল।

তুলসীকে খুব যত্ন করিয়া খাইবার আসন করিতে দেখিয়া মনে মনে হাসিলাম। ইহাদের এখানে খাইবার অবস্থা কি আর আছে?
সুরতিয়াকে বলিলাম-তোমার মাকে বল পিঠে তুলে নিতে। এত কে খাবে?

সুরতিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল- ও কি বাবুজী, এই ক’খানা খাবেন না? আমি আর ছনিয়াই তো পনর-ষোলখানা করে খেয়েছি। খান- আপনি খাবেন বলে ওর ভেতরে মা কিশমিশ দিয়েছে- ভালো আটা এনেছে বাবা ভীমদাসটোলা থেকে-
খাইব না বলিয়া ভালো করি নাই। সারা বছর এই বালকবালিকা এসব সুখাদ্যের মুখ দেখিতে পায় না। এদের কত কষ্টের, কত আশার জিনিস! ছেলেমানুষকে খুশি করিবার জন্য মরিয়া হইয়া দুইখানা পিষ্টক খাইয়া ফেলিলাম।

সুরতিয়াকে খুশি করিবার জন্য বলিলাম- চমৎকার পিঠে! কিন্তু সব জায়গায় কিছু কিছু খেয়েছি বলে খেতে পারলুম না সুরতিয়া। আর একদিন এসে হবে এখন।

রাজু পাঁড়ের হাতে একটা ছোটখাটো বোঁচকা। সে প্রত্যেকের বাড়ি হইতে ছাঁদা বাঁধিয়াছে, এক-একখানি পিষ্টকের ওজন বিবেচনা করিলে রাজুর বোঁচকার ওজন দশ-বারো সেরের কম তো কোনো মতেই হইবে না।

রাজু খুব খুশি। বলিল- এ পিঠে হঠাৎ নষ্ট হয় না হুজুর, দু-তিন দিন আর আমায় রাঁধতে হবে না। পিঠে খেয়েই চলবে।

কাছারিতে পরদিন সকালে কুন্তা একখানি পিতলের থালা লইয়া আসিয়া আমার সামনে সসঙ্কোচে স্থাপন করিল। এক টুক্‌রা ফর্সা নেকড়া দিয়া থালাখানা ঢাকা।

বলিলাম- ওতে কি কুন্তা?

কুন্তা সলজ্জ কণ্ঠে বলিল ছট্-পরবের পিঠে বাবুজী। কাল রাত্রে দু-বার নিয়ে এসে ফিরে গিয়েছি।

বলিলাম- কাল অনেক রাত্রে ফিরেছি, ছট্-পরবের নেমন্তন্ন রাখতে বেরিয়েছিলাম। আচ্ছা রেখে দাও, খাব এখন।

ঢাকা খুলিয়া দেখি, থালায় কয়েকখানি পিষ্টক, কিছু চিনি, দুটি কলা, একখণ্ড ঝুনা নারিকেল, একটা কলম্বা লেবু।

বলিলাম- বাঃ, বেশ পিঠে দেখছি।

কুন্তা পূর্ববৎ মৃদুস্বরে সসঙ্কোচে বলিল- বাবুজী, সবগুলো মেহেরবানি করে খাবেন। আপনি খাবেন বলে আলাদা করে তৈরি করেছি। তবুও আপনাকে গরম খাওয়াতে পারলাম না, বড় দুঃখ রইল।

– কিছু হয় নি তাতে, কুন্তা। আমি সবগুলো খাব। দেখতে বড় চমৎকার দেখাচ্ছে।

কুন্তা প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল।


একদিন মুনেশ্বর সিং সিপাহী আসিয়া বলিল- হুজুর, ওই বনের মধ্যে গাছের নিচে একটা লোক ছেঁড়া কাপড় পেতে শুয়ে আছে-লোকজনে তাকে বস্তিতে ঢুকতে দেয় না-ঢিল ছুঁড়ে মারে, আপনি হুকুম করেন তো তাকে নিয়ে আসি।

কথাটা শুনিয়া আশ্চর্য হইলাম। বৈকাল বেলা, সন্ধ্যার বেশি দেরি নাই, শীত তেমন না হইলেও কার্তিক মাস, রাত্রে যথেষ্ট শিশির পড়ে, শেষ রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা। এ অবস্থায় একটা লোক বনের মধ্যে গাছের তলায় আশ্রয় লইয়াছে কেন, লোকে তাকে ঢিল ছুঁড়িয়াই বা মারে কেন বুঝিতে পারিলাম না।

গিয়া দেখি গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছের ওদিকে (আজ প্রায় ত্রিশ বছর আগে গ্র্যাণ্ট সাহেব আমিন লবটুলিয়ার বন্য মহাল জরিপ করিতে আসিয়া এই বটতলায় তাঁবু ফেলেন, সেই হইতেই গাছটির এই নাম চলিয়া আসিতেছে) একটা বনঝোপে একটা অর্জুন গাছের তলায় একটা লোক ছেঁড়া ময়লা নেকড়াখানি পাতিয়া শয্যা রচনা করিয়া শুইয়া আছে। ঝোপের অন্ধকারে লোকটিকে ভালো করিয়া দেখিতে না পাইয়া বলিলাম-কে ওখানে? বাড়ি কোথায়? বের হয়ে এস-

লোকটি বাহির হইয়া আসিল- অনেকটা হামাগুড়ি দিয়া, অতি ধীরে ধীরে- বয়স পঞ্চাশের উপর, জীর্ণশীর্ণ চেহারা, মলিন ছেঁড়া কাপড় ও মেরজাই গায়ে,-যতক্ষণ সে ঝোপের ভিতর হইতে বাহির হইতেছিল, কি একরকম অদ্ভুত, অসহায়ভাবে শিকারির তাড়া-খাওয়া পশুর মতো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া ছিল।

ঝোপের অন্ধকার হইতে দিনের আলোয় বাহির হইয়া আসিলে দেখিলাম, তাহার বাম হাতে ও বাম পায়ে ভীষণ ক্ষত। বোধ হয় সেইজন্য সে একবার বসিলে বা শুইলে হঠাৎ আর সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না।

মুনেশ্বর সিং বলিল- হুজুর, ওর ওই ঘায়ের জন্যই ওকে বস্তিতে ঢুকতে দেয় না- জল পর্যন্ত চাইলে দেয় না। ঢিল মারে, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়-

বোঝা গেল তাই এ লোকটা বনের পশুর মতো বন-ঝোপের মধ্যেই আশ্রয় লইয়াছে এই হেমন্তের শিশিরার্দ্র রাত্রে।

বলিলাম- তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়?

লোকটা আমায় দেখিয়া ভয়ে কেমন হইয়া গিয়াছে- ওর চোখে রোগকাতর ও ভীত অসহায় দৃষ্টি। তা ছাড়া আমার পিছনে লাঠিহাতে মুনেশ্বর সিং সিপাহী। বোধ হয় সে ভাবিল, সে যে বনে আশ্রয় লইয়াছে তাহাতেও আমাদের আপত্তি আছে- তাহাকে তাড়াইয়া দিতেই আমি সিপাই সঙ্গে করিয়া সেখানে গিয়াছি।

0 Shares