আরণ্যক

আমার ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনিয়া লোকটি চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল-কে? তার পরেই আমায় চিনিতে পারিয়া তাড়াতাড়ি কাছে আসিল ও আমাকে খুব খাতির করিয়া ঘোড়া হইতে নামাইল।

পরিশ্রান্ত হইয়াছিলাম, প্রায় ছ-ঘণ্টা আছি ঘোড়ার উপর, কারণ সার্ভে ক্যাম্পেও আমিনের পিছু পিছু ঘোড়ায় টো টো করিয়া জঙ্গলের মধ্যে ঘুরিয়াছি। লোকটার প্রদত্ত একটা ঘাসের চেটাইয়ে বসিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম-তোমার নাম কি? লোকটা বলিল-গনু মাহাতো, জাতি গাঙ্গোতা। এ অঞ্চলে গাঙ্গোতা জাতির উপজীবিকা চাষবাস ও পশুপালন, তাহা আমি এতদিনে জানিয়াছিলাম-কিন্তু এ লোকটা এই জনহীন গভীর বনের মধ্যে একা কি করে?

বলিলাম-তুমি এখানে কি কর? তোমার বাড়ি কোথায়?

– হুজুর, মহিষ চরাই। আমার ঘর এখান থেকে দশ ক্রোশ উত্তরে ধরমপুর, লছমনিয়াটোলা।

– নিজের মহিষ? কতগুলো আছে?

লোকটা গর্বের সুরে বলিল- পাঁচটা মহিষ আছে হুজুর।

পাঁচটা মহিষ। দস্তুরমতো অবাক হইলাম। দশ ক্রোশ দূরের গ্রাম হইতে পাঁচটা মাত্র মহিষ সম্বল করিয়া লোকটি এই বিজন বনের মধ্যে মহিষচরির খাজনা দিয়া একা খুপরি বাঁধিয়া মহিষ চরায়-দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এই ছোট্ট খুপরিটাতে কি করিয়া সময় কাটায়-কলিকাতা হইতে নূতন আসিয়াছি, শহরের থিয়েটার-বায়োস্কোপে লালিত যুবক আমি- বুঝিতে পারিলাম না।

কিন্তু এদেশের অভিজ্ঞতা আরো বেশি হইলে বুঝিয়াছিলাম কেন গনু মাহাতো ওভাবে থাকে। তাহার অন্য কোনো কারণ নাই ইহা ছাড়া যে, গনু মাহাতোর জীবনের ধারণাই এইরূপ। যখন তাহার পাঁচটি মহিষ তখন তাহাদের চরাইতে হইবে, এবং যখন চরাইতে হইবে, তখন জঙ্গলে আছে, কুঁড়ে বাঁধিয়া একা থাকিতেই হইবে। এ অত্যন্ত সাধারণ কথা, ইহার মধ্যে আশ্চর্য হইবার কি আছে!

গনু কাঁচা শালপাতায় একটা লম্বা পিকা বা চুরুট তৈরি করিয়া আমার হাতে সসম্ভ্রমে দিয়া আমায় অভ্যর্থনা করিল। আগুনের আলোতে উহার মুখ দেখিলাম-বেশ চওড়া কপাল, উঁচু নাক, রং কালো- মুখশ্রী সরল, শান্ত চোখের দৃষ্টি। বয়স ষাটের উপর হইবে, মাথার চুল একটিও কালো নাই। কিন্তু শরীর এমন সুগঠিত যে, এই বয়সেও প্রত্যেকটি মাংসপেশী আলাদা করিয়া গুনিয়া লওয়া যায়।

গনু আগুনে আরো বেশি কাঠ ফেলিয়া দিয়া নিজেও একটি শালপাতার পিকা ধরাইল। আগুনের আভায় খুপরির মধ্যে এক-আধখানা পিতলের বাসন চক্চক্ করিতেছে। আগুনের কুণ্ডের মণ্ডলীর বাহিরে ঘোরতর অন্ধকার ও ঘন বন। বলিলাম-গনু, একা এখানে থাক, জন্তু-জানোয়ারের ভয় করে না? গনু বলিল-ভয় ডর করলে আমাদের কি চলে হুজুর? আমাদের যখন এই ব্যবসা! সেদিন তো রাত্রে আমার খুপরির পেছনে বাঘ এসেছিল। মহিষের দুটো বাচ্চা আছে, ওদের ওপর তাক্। শব্দ শুনে রাত্রে উঠে টিন বাজাই; মশাল জ্বালি, চিৎকার করি! রাত্রে আর ঘুম হোলো না হুজুর; শীতকালে তো সারারাত এই বনে ফেউ ডাকে।

-খাও কি এখানে? দোকানটোকান তো নেই, জিনিসপত্র পাও কোথায়? চালডাল-

-হুজুর, দোকানে জিনিস কেনবার মতো পয়সা কি আমাদের আছে, না আমরা বাঙালি বাবুদের মতো ভাত খেতে পাই? এই জঙ্গলের পেছনে আমার দু-বিঘে খেড়ী ক্ষেত আছে। খেড়ীর দানা সিদ্ধ, আর জঙ্গলে বাথুয়া শাক হয়, তাই সিদ্ধ, আর একটু লুন, এই খাই। ফাগুন মাসে জঙ্গলে গুড়মী ফল ফলে, লুন দিয়ে কাঁচা খেতে বেশ লাগে- লতানে গাছ, ছোট ছোট কাঁকুড়ের মতো ফল হয়; সে সময় এক মাস এ-অঞ্চলের যত গরিব লোক গুড়মী ফল খেয়ে কাটিয়ে দেয়। দলে দলে ছেলেমেয়ে আসবে জঙ্গলের গুড়মী তুলতে।

জিজ্ঞাসা করিলাম-রোজ রোজ খেড়ীর দানা সিদ্ধ আর বাথুয়া শাক ভালো লাগে?

– কি করব হুজুর, আমরা গরিব লোক, বাঙালি বাবুদের মতো ভাত খেতে পাব কোথায়? ভাত এ অঞ্চলের মধ্যে কেবল রাসবিহারী সিং আর নন্দলাল পাঁড়ে খায় দুবেলা। সারাদিন মহিষের পেছনে ভূতের মতন খাটি হুজুর, সন্ধের সময় ফিরি যখন, তখন এত ক্ষিদে পায় যে, যা পাই খেতে তাই ভালো লাগে।

গনুকে বলিলাম-কলকাতা শহর দেখেছ গনু?

– না হুজুর। কানে শুনেছি। ভাগলপুর শহরে একবার গিয়েছি, বড় ভারি শহর। ওখানে হাওয়ার গাড়ি দেখেছি, বড় তাজ্জব চিজ হুজুর। ঘোড়া নেই, কিছু নেই, আপনা-আপনি রাস্তা দিয়া চলছে।

এই বয়সে উহার স্বাস্থ্য দেখিয়া অবাক হইলাম। সাহসও যে আছে ইহা মনে মনে স্বীকার করিতে হইল।

গনুর জীবিকানির্বাহের একমাত্র অবলম্বন মহিষ কয়টি। তাদের দুধ অবশ্য এ-জঙ্গলে কে কিনিবে, দুধ হইতে মাখন তুলিয়া ঘি করে ও দু-তিন মাসের ঘি একত্রে জমাইয়া ন-মাইল দূরবর্তী ধরমপুরের বাজারে মাড়োয়ারীদের নিকট বিক্রয় করিয়া আসে। আর থাকিবার মধ্যে ওই দু-বিঘা খেড়ী অর্থাৎ শ্যামাঘাসের ক্ষেত, যার দানা সিদ্ধ এ-অঞ্চলের প্রায় সকল গরিব লোকেরই একটা প্রধান খাদ্য। গনু সে-রাত্রে আমাকে কাছারিতে পৌঁছাইয়া দিল, কিন্তু গনুকে আমার এত ভালো লাগিল যে, কতবার শান্ত বৈকালে তাহার খুপরির সামনে আগুন পোহাইতে পোহাইতে গল্প করিয়া কাটাইয়াছি। ওদেশের নানারূপ তথ্য গনুর কাছে যেরূপ শুনিয়াছিলাম, অত কেউ দিতে পারে নাই।
গনুর মুখে কত অদ্ভুত কথা শুনিতাম। উড়ুক্কু সাপের কথা, জীবন্ত পাথর ও আঁতুড়ে ছেলের হাঁটিয়া বেড়াইবার কথা, ইত্যাদি। ওই নির্জন জঙ্গলের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে গনুর সে-সব গল্প অতি উপাদেয় ও অতি রহস্যময় লাগিত- আমি জানি কলকাতা শহরে বসিয়া সে-সব গল্প শুনিলে তাহা আজগুবী ও মিথ্যা মনে হইতে বাধ্য। যেখানে-সেখানে যে-কোনো গল্প শোনা চলে না, গল্প শুনিবার পটভূমি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর উহার মাধুর্য যে কতখানি নির্ভর করে, তাহা গল্পপ্রিয় ব্যক্তি মাত্রেই জানেন। গনুর সকল অভিজ্ঞতার মধ্যে আমার আশ্চর্য বলিয়া মনে হইয়াছিল বন্যমহিষের দেবতা টাঁড়বারোর কথা।

কিন্তু, যেহেতু এই গল্পের একটি অদ্ভুত উপসংহার আছে-সেজন্য সে-কথা এখন না বলিয়া যথাস্থানে বলিব। এখানে বলিয়া রাখি, গনু আমাকে যে-সব গল্প বলিত-তাহা রূপকথা নহে, তাহার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়। গনু জীবনকে দেখিয়াছে তবে অন্যভাবে। অরণ্য-প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আজীবন কাটাইয়া সে অরণ্য-প্রকৃতির সম্বন্ধে একজন রীতিমতো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। তাহার কথা হঠাৎ উড়াইয়া দেওয়া চলে না। মিথ্যা বানাইয়া বলিবার মতো কল্পনাশক্তিও গনুর আছে বলিয়া আমার মনে হয় নাই।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ


গ্রীষ্মকাল পড়িতে গ্র্যাণ্ট সাহেবের বটগাছের মাথায় পীরপৈঁতি পাহাড়ের দিক হইতে একদল বক উড়িয়া আসিয়া বসিল, দূর হইতে মনে হয় যেন বটগাছের মাথা সাদা থোকা থোকা ফুলে ভরিয়া গিয়াছে।

একদিন অর্ধশুষ্ক কাশের বনের ধারে টেবিল-চেয়ার পাতিয়া কাজ করিতেছি, মুনেশ্বর সিং সিপাহী আসিয়া বলিল-হুজুর, নন্দলাল ওঝা গোলাওয়ালা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

একটু পরে প্রায় পঞ্চাশ বছরের একটি বৃদ্ধ ব্যক্তি আমার সামনে আসিয়া সেলাম করিল ও আমার নির্দেশ মতো একটা টুলের উপর বসিল। বসিয়াই সে একটি পশমের থলে বাহির করিল। তাহার পর থলেটির ভিতর হইতে খুব ছোট একখানি জাঁতি ও দুইটি সুপারি বাহির করিয়া সুপারি কাটিতে আরম্ভ করিল। পরে কাটা সুপারি হাতে রাখিয়া দুই হাত একত্র করিয়া আমার সামনে মেলিয়া ধরিয়া সসম্ভ্রমে বলিল- সুপারি লিজিয়ে হুজুর।

সুপারি ও-ভাবে খাওয়া অভ্যাস না-থাকিলেও ভদ্রতার খাতিরে লইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম- কোথা হতে আসা হচ্ছে, কি কাজ?

তাহার উত্তরে লোকটি বলিল, তাহার নাম নন্দলাল ওঝা, মৈথিল ব্রাহ্মণ। জঙ্গলের উত্তর-পূর্ব কোণে কাছারি হইতে প্রায় এগার মাইল দূরে সুংঠিয়া-দিয়ারাতে তাহার বাড়ি। বাড়িতে চাষবাস আছে, কিছু সুদের কারবারও আছে-সে আসিয়াছে তার বাড়িতে আগামী পূর্ণিমার দিন আমায় নিমন্ত্রণ করিতে-আমি কি তাহার বাড়িতে দয়া করিয়া পদধূলি দিতে রাজি আছি? এ সৌভাগ্য কি তাহার হইবে?

এগার মাইল দূরে এই রৌদ্রে নিমন্ত্রণ খাইতে যাইবার লোভ আমার ছিল না- কিন্তু নন্দলাল ওঝা নিতান্ত পীড়াপীড়ি করাতে অগত্যা রাজি হইলাম- তা ছাড়া এদেশের গৃহস্থসংসার সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিবার লোভও সংবরণ করিতে পারিলাম না।

0 Shares