আরণ্যক

পূর্ণিমার দিন দুপুরের পরে দীর্ঘ কাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়া কাহাদের একটি হাতি আসিতেছে দেখা গেল। হাতি কাছারিতে আসিলে মাহুতের মুখে শুনিলাম হাতিটি নন্দলাল ওঝার নিজের- আমাকে লইয়া যাইতে পাঠাইয়া দিয়াছে। হাতি পাঠাইবার আবশ্যক ছিল না- কারণ আমার নিজের ঘোড়ায় অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে পৌঁছিতে পারিতাম।

যাহাই হউক, হাতিতে চড়িয়াই নন্দলালের বাড়িতে রওনা হইলাম। সবুজ বনশীর্ষ আমার পায়ের তলায়, আকাশ যেন আমার মাথায় ঠেকিয়াছে- দূর, দূর-দিগন্তের নীল শৈলমালার রেখা বনভূমিতে ঘিরিয়া যেন মায়ালোক রচনা করিয়াছে- আমি সে-মায়ালোকের অধিবাসী- বহু দূর স্বর্গের দেবতা। কত মেঘের তলায় তলায় পৃথিবীর কত শ্যামল বনভূমির উপরকার নীল বায়ুমণ্ডল ভেদ করিয়া যেন আমার অদৃশ্য যাতায়াত।

পথে চাম্‌টার বিল পড়িল, শীতের শেষেও সিল্লী আর লাল হাঁসের ঝাঁকে ভর্তি। আর একটু গরম পড়িলেই উড়িয়া পলাইবে। মাঝে মাঝে নিতান্ত দরিদ্র পল্লী। ফণীমনসা-ঘেরা তামাকের ক্ষেত ও খোলায় ছাওয়া দীনকুটির।

সুংঠিয়া গ্রামে হাতি ঢুকিলে দেখা গেল পথের দু-ধারে সারবন্দি লোক দাঁড়াইয়া আছে আমায় অভ্যর্থনা করিবার জন্য। গ্রামে ঢুকিয়া অল্প দূর পরেই নন্দলালের বাড়ি।

খোলায় ছাওয়া মাটির ঘর আট-দশখানা- সবই পৃথক পৃথক, প্রকাণ্ড উঠানের মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো। আমি বাড়িতে ঢুকিতেই দুইবার হঠাৎ বন্দুকের আওয়াজ হইল। চমকাইয়া গিয়াছি- এমন সময়ে সহাস্যমুখে নন্দলাল ওঝা আসিয়া আমায় অভ্যর্থনা করিয়া বাড়িতে লইয়া গিয়া একটা বড়ঘরের দাওয়ায় চেয়ারে বসাইল। চেয়ারখানি এদেশের শিশুকাঠের তৈয়ারি এবং এদেশের গ্রাম্য মিস্ত্রির হাতেই গড়া। তাহার পর দশ-এগার বছরের একটি ছোট মেয়ে আসিয়া আমার সামনে একখানা থালা ধরিল-থালায় গোটাকতক আস্ত পান, আস্ত সুপারি, একটা মধুপর্কের মতো ছোট বাটিতে সামান্য একটু আতর, কয়েকটি শুষ্ক খেজুর; ইহা লইয়া কি করিতে হয় আমার জানা নাই- আমি আনাড়ির মতো হাসিলাম ও বাটি হইতে আঙুলের আগায় একটু আতর তুলিয়া লইলাম মাত্র। মেয়েটিকে দু-একটি ভদ্রতাসূচক মিষ্টকথাও বলিলাম! মেয়েটি থালা আমার সামনে রাখিয়া চলিয়া গেল।

তারপর খাওয়ানোর ব্যবস্থা। নন্দলাল যে ঘটা করিয়া খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিয়াছে, তাহা আমার ধারণা ছিল না। প্রকাণ্ড কাঠের পিঁড়ির আসন পাতা-সম্মুখে এমন আকারের একখানি পিতলের থালা আসিল, যাহাতে করিয়া আমাদের দেশে দুর্গাপূজার বড় নৈবেদ্য সাজায়। থালায় হাতির কানের মতো পুরী, বাথুয়া শাক ভাজা, পাকা শশার রায়তা, কাঁচা তেঁতুলের ঝোল, মহিষের দুধের দই, পেঁড়া। খাবার জিনিসের এমন অদ্ভুত যোগাযোগ কখনো দেখি নাই। আমায় দেখিবার জন্য উঠানে লোকে লোকারণ্য হইয়া গিয়াছে ও আমার দিকে এমনভাবে চাহিতেছে যে, আমি যেন এক অদৃষ্টপূর্ব জীব। শুনিলাম, ইহারা সকলেই নন্দলালের প্রজা।

সন্ধ্যার পূর্বে উঠিয়া আসিবার সময় নন্দলাল একটি ছোট থলি আমার হাতে দিয়া বলিল-হুজুরের নজর। আশ্চর্য হইয়া গেলাম। থলিতে অনেক টাকা, পঞ্চাশের কম নয়। এত টাকা কেহ কাহাকেও নজর দেয় না, তা ছাড়া নন্দলাল আমার প্রজাও নয়। নজর প্রত্যাখ্যান করাও গৃহস্থের পক্ষে নাকি অপমানজনক- সুতরাং আমি থলি খুলিয়া একটা টাকা লইয়া থলিটা তাহার হাতে ফিরাইয়া দিয়া বলিলাম- তোমার ছেলেপুলেদের পেঁড়া খাইতে দিও।

নন্দলাল কিছুতেই ছাড়িবে না- আমি সে-কথায় কান না-দিয়াই বাহিরে আসিয়া হাতির পিঠে চড়িলাম।

পরদিনই নন্দলাল ওঝা আমার কাছারিতে গেল, সঙ্গে তাহার বড় ছেলে। আমি তাহাদিগকে সমাদর করিলাম- কিন্তু খাইবার প্রস্তাবে তাহারা রাজি হইল না। শুনিলাম মৈথিল ব্রাহ্মণ অন্য ব্রাহ্মণের হস্তের প্রস্তুত কোনো খাবারই খাইবে না। অনেক বাজে কথার পরে নন্দলাল একান্তে আমার নিকট কথা পাড়িল, তাহার বড় ছেলে ফুলকিয়া বইহারের তহসিলদারির জন্য উমেদার- তাহাকে আমায় বহাল করিতে হইবে। আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম- কিন্তু ফুলকিয়ার তহসিলদার তো আছে – সে পোস্ট তো খালি নেই। তাহার উত্তরে নন্দলাল আমাকে চোখ ঠারিয়া ইশারা করিয়া বলিল, হুজুর, মালিক তো আপনি। আপনি মনে করলে কি না হয়?

আমি আরো অবাক হইয়া গেলাম। সে কি রকম কথা! ফুলকিয়ার তহসিলদার ভালোই কাজ করিতেছে- তাহাকে ছাড়াইয়া দিব কোন্ অপরাধে?

নন্দলাল বলিল- কত রুপেয়া হুজুরকে পান খেতে দিতে হবে বলুন, আমি আজ সাঁজেই হুজুরকে পৌঁছে দেব। কিন্তু আমার ছেলেকে তহসিলদারি দিতে হবেই হুজুরের। বলুন কত, হুজুর। পাঁচ-শ’? এতক্ষণে বেশ বুঝিতে পারিলাম, নন্দলাল যে আমাকে কাল নিমন্ত্রণ করিয়াছিল তাহার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি। এদেশের লোক যে এমন ধড়িবাজ, তাহা জানিলে কখনো ওখানে যাই? আচ্ছা বিপদে পড়িয়াছি বটে!

নন্দলালকে স্পষ্ট কথা বলিয়াই বিদায় করিলাম। বুঝিলাম নন্দলাল আশা ছাড়িল না।

আর একদিন দেখি, ঘন বনের ধারে নন্দলাল আমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে।

কি কুক্ষণেই উহার বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাইতে গিয়াছিলাম-দুখানা পুরী খাওয়াইয়া সে যে আমার জীবন এমন অতিষ্ঠ করিয়া তুলিবে-তাহা আগে জানিলে কি উহার ছায়া মাড়াই?

নন্দলাল আমাকে দেখিয়া মিষ্টি মোলায়েম হাসিয়া বলিল-নোমোস্কার হুজুর।

-হুঁ। তারপর, এখানে কি মনে করে?

-হুজুর সবই জানেন। আমি আপনাকে বারো-শ’ টাকা নগদ দেব। আমার ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিন।

-তুমি পাগল নন্দলাল? আমি বহাল করবার মালিক নই। যাদের জমিদারি তাদের কাছে দরখাস্ত করতে পারো। তা ছাড়া বর্তমানে যে রয়েছে-তাকে ছাড়ব কোন্ অপরাধে?

বলিয়াই বেশি কথা না বাড়াইয়া ঘোড়া ছুটাইয়া দিলাম।

ক্রমে আমার কড়া ব্যবহারে নন্দলালকে আমি আমার ও স্টেটের মহা শত্রু করিয়া তুলিলাম। তখনো বুঝি নাই, নন্দলাল কিরূপ ভয়ানক প্রকৃতির মানুষ। ইহার ফল আমাকে ভালো করিয়াই ভুগিতে হইয়াছিল।


উনিশ মাইল দূরবর্তী ডাকঘর হইতে ডাক আনা এখানকার এক অতি আবশ্যক ঘটনা। অতদূরে প্রতিদিন লোক পাঠানো চলে না বলিয়া সপ্তাহে দুবার মাত্র ডাকঘরে লোক যাইত। মধ্য-এশিয়ার জনহীন, দুস্তর ও ভীষণ টাক্‌লামাকান মরুভূমির তাঁবুতে বসিয়া বিখ্যাত পর্যটক সোয়েন হেডিনও বোধ হয় এমনি আগ্রহে ডাকের প্রতীক্ষা করিতেন। আজ আট-নয় মাস এখানে আসিবার ফলে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই জনহীন বন-প্রান্তরে সূর্যাস্ত, নক্ষত্ররাজি, চাঁদের উদয়, জ্যোৎস্না ও বনের মধ্যে নীলগাইয়ের দৌড় দেখিতে দেখিতে যে বহির্জগতের সঙ্গে সকল যোগ হারাইয়া ফেলিয়াছি-ডাকের চিঠি কয়েকখানির মধ্য দিয়া আবার তাহার সহিত একটা সংযোগ স্থাপিত হইত।

নির্দিষ্ট দিনে জওয়াহিরলাল সিং ডাক আনিতে গিয়াছে-আজ দুপুরে সে আসিবে। আমি ও বাঙালি মুহুরীবাবুটি ঘন ঘন জঙ্গলের দিকে চাহিতেছি। কাছারি হইতে মাইল দেড় দূরে একটা উঁচু ঢিবির উপর দিয়া পথ। ওখানে আসিলে জওয়াহিরলাল সিংকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়।

বেলা দুপুর হইয়া গেল। জওয়াহিরলালের দেখা নেই। আমি ঘন ঘন ঘর-বাহির করিতেছি। এখানের আপিসের কাজের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। বিভিন্ন আমিনের রিপোর্ট দেখা, দৈনিক ক্যাশবই সই করা, সদরের চিঠিপত্রের উত্তর লেখা, পাটোয়ারী ও তহসিলদারের আদায়ের হিসাব-পরীক্ষা, নানাবিধ দরখাস্তের ডিগ্রি-ডিস্মিস্ করা, পূর্ণিয়া মুঙ্গের ভাগলপুর প্রভৃতি স্থানে নানা আদালতে নানাপ্রকার মামলা ঝুলিতেছে-ঐ সকল স্থানের উকিল ও মামলা-তদ্বিরকারকদের রিপোর্ট পাঠ ও তার উত্তর দেওয়া-আরো নানা প্রকার বড় ও খুচরা কাজ প্রতিদিন নিয়ম-মতো না করিলে দু-তিনদিনে এত জমিয়া যায় যে, তখন কাজ শেষ করিতে প্রাণান্ত হইয়া ওঠে। ডাক আসিবার সঙ্গে সঙ্গে আবার একরাশি কাজ আসিয়া পড়ে। শহরের নানা ধরনের চিঠি, নানা ধরনের আদেশ, অমুক জায়গায় যাও, অমুকের সঙ্গে অমুক মহালের বন্দোবস্ত কর, ইত্যাদি।

বেলা তিনটার সময় জওয়াহিরলালের সাদা পাগড়ি রৌদ্রে চক্চক্ করিতেছে দেখা গেল। বাঙালি মুহুরীবাবু হাঁকিলেন- ম্যানেজারবাবু, আসুন, ডাকপেয়াদা আসছে- ঐ যে-

0 Shares