শঙ্করের মধ্যে যে সৌন্দর্যপ্রিয় ভাবুক মনটি ছিল, (হাজার হোক সে বাঙলার মাটির ছেলে, ডিয়েগো আলভারেজের মতো শুধু কঠিন প্রাণ স্বর্ণান্বেষী প্রসপেক্টর নয়) এই রূপের মেলায় সে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে রাঙা অপরাহ্নে ও দুপুর রোদে আপন মনে কত কি স্বপ্নজাল রচনা করে।
অনেক রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, অচেনা তারাভরা বিদেশের আকাশের তলায় রহস্যময়ী বন্য প্রকৃতি তখন যেন জেগে উঠেছে— জঙ্গলের দিক থেকে কত বন্যজন্তুর ডাক কানে আসে। শঙ্করের চোখে ঘুম নেই, এই সৌন্দর্যস্বপ্নে বিভোর হয়ে, মধ্য-আফ্রিকার নৈশ শীতলতাকে তুচ্ছ করেও সে জেগে বসে থাকে।
ঐ জ্বলজ্বলে সপ্তর্ষিমন্ডল— আকাশের অনেকদূরে তার ছোট গ্রামের মাথায়ও আজ অমনি সপ্তর্ষিমন্ডল উঠেছে, ঐ রকম একফালি কৃষ্ণপক্ষের গভীর রাত্রির চাঁদও। সেসব পরিচিত আকাশ ছেড়ে কতদূরে এসে সে পড়েছে, আরও কতদূরে তাকে যেতে হবে, কী এর পরিণতি কে জানে!
দু’দিন পরে বোট এসে সানকিনি পৌঁছুল। সেখান থেকে ওরা আবার পদব্রজে রওনা হল। জঙ্গল এদিকে বেশি নেই, কিন্তু দিগন্তপ্রসারী জনমানবহীন প্রান্তর ও অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়, অধিকাংশ পাহাড় রুক্ষ ও বৃক্ষশূন্য, কোনো কোনো পাহাড়ে ইউফোর্বিয়া জাতীয় গাছের ঝোপ। কিন্তু শঙ্করের মনে হল, আফ্রিকার এই অঞ্চলের দৃশ্য বড় অপরূপ। এতটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে মন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। সূর্যাস্তের রং, জোত্স্নারাত্রির মায়া, এই দেশকে রাত্রে অপরাহ্নে রূপকথার পরীরাজ্য করে তোলে।
আলভারেজ বললে— এই ভেল্ড অঞ্চলে সব জায়গা দেখতে এক রকম বলে পথ হারাবার সম্ভাবনা কিন্তু খুব বেশি।
কথাটা যেদিন বলা হল, সেদিনই এক কান্ড ঘটল। জনহীন ভেল্ডে সূর্য অস্ত গেলে ওরা একটা ছোট পাহাড়ের আড়ালে তাঁবু খাটিয়ে আগুন জ্বাললে— শঙ্কর জল খুঁজতে বেরুল। সঙ্গে আলভারেজের বন্দুকটা নিয়ে গেল, কিন্তু মাত্র দুটি টোটা। আধ ঘন্টা এদিক ওদিক ঘুরে বেলাটুকু গেল, পাতলা অন্ধকার সমস্ত প্রান্তরকে ধীরে ধীরে আবৃত করে দিলে। শঙ্কর শপথ করে বলতে পারে, সে আধঘন্টার বেশি হাঁটেনি। হঠাৎ চারধারে চেয়ে শঙ্করের কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হল, যেন কী একটা বিপদ আসছে, তাঁবুতে ফেরা ভালো। দূরে দূরে ছোট বড় পাহাড়, একই রকম দেখতে সবদিক, কোনো চিহ্ন নেই, সব একাকার।
মিনিট পাঁচ-ছয় হাঁটবার পরই শঙ্করের মনে হল সে পথ হারিয়েছে। তখন আলভারেজের কথা তার মনে পড়ল। কিন্তু তখনো সে অনভিজ্ঞতার দরুন বিপদের গুরুত্বটা বুঝতে পারলে না। হেঁটেই যাচ্ছে— হেঁটেই যাচ্ছে— একবার মনে হয় সামনে, একবার মনে হয় বাঁয়ে, একবার মনে হয় ডাইনে। তাঁবুর আগুনের কুন্ডটা দেখা যায় না কেন? কোথায় সেই ছোট পাহাড়টা?
দু’ঘন্টা হাঁটবার পরে শঙ্করের খুব ভয় হল। ততক্ষণে সে বুঝেছে যে সে সম্পূর্ণরূপে পথ হারিয়েছে এবং ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। একা তাকে রোডেসিয়ার এই জনমানবশূন্য, সিংহসঙ্কুল অজানা প্রান্তরে রাত কাটাতে হবে— অনাহারে এবং এই কনকনে শীতে বিনা কম্বলে ও বিনা আগুনে। সঙ্গে একটা দেশলাই পর্যন্ত নেই।
ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই দাঁড়াল যে— পরদিন সন্ধ্যার পূর্বে অর্থাৎ পথ হারানোর চব্বিশ ঘন্টা পরে, উদ্ভ্রান্ত, তৃষ্ণায় মুমূর্ষু শঙ্করকে, ওদের তাঁবু থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে, একটা ইউফোর্বিয়া গাছের তলা থেকে আলভারেজ উদ্ধার করে তাঁবুতে নিয়ে এল।
আলভারেজ বললে— তুমি যে পথ ধরেছিলে শঙ্কর, তোমাকে আজ খুঁজে বার করতে না পারলে তুমি গভীর থেকে গভীরতর মরুপ্রান্তরের মধ্যে গিয়ে পড়ে, কাল দুপুর নাগাদ তৃষ্ণায় প্রাণ হারাতে। এর আগে তোমার মতো অনেকেই রোডেসিয়ার ভেল্ডে এ ভাবে মারা গিয়েছে। এ সব ভয়ানক জায়গা। তুমি আর কখনো তাঁবু থেকে ও রকম বেরিও না, কারণ তুমি আনাড়ি। মরুভূমিতে ভ্রমণের কৌশল তোমার জানা নেই, ডাহা মারা পড়বে।
শঙ্কর বললে— আলভারেজ, তুমি দু’বার আমার প্রাণ রক্ষা করলে, এ আমি ভুলব না।
আলভারেজ বললে— ইয়্যাংম্যান, ভুলে যাচ্ছ যে তার আগে তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। তুমি না থাকলে ইউগান্ডার তৃণভূমিতে আমার হাড়গুলো সাদা হয়ে আসতো এতদিনে।
মাস দুই ধরে রোডেসিয়া ও এঙ্গোলার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভেল্ড অতিক্রম করে, অবশেষে দূরে মেঘের মতো পর্বতশ্রেণী দেখা গেল। আলভারেজ ম্যাপ মিলিয়ে বললে— ওই হচ্ছে আমাদের গন্তব্যস্থান, রিখটারসভেল্ড পর্বত, এখনো এখান থেকে চল্লিশ মাইল হবে। আফ্রিকার এইসব খোলা জায়গায় অনেক দূর থেকে জিনিস দেখা যায়।
এ অঞ্চলে অনেক বাওবাব গাছ। শঙ্করের এ গাছটা বড় ভালো লাগে— দূর থেকে যেন মনে হয় বট কি অশ্বত্থ গাছের মতো, কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায় বাওবাব গাছ, ছায়াবিরল অথচ বিশাল, আঁকাবাঁকা সারা গায়ে যেন বড় বড় আঁচিল কি আব্ বেরিয়েছে, যেন আরব্য উপন্যাসের একটা বেঁটে, কুদর্শন, কুব্জ দৈত্য। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এখানে ওখানে প্রায় সর্বত্রই দূরে নিকটে বড় বড় বাওবাব গাছ দাঁড়িয়ে।
একদিন সন্ধ্যাবেলার দুর্জয় শীতে তাঁবুর সামনে আগুন করে বসে আলভারেজ বললে— এই যে দেখছ রোডেসিয়ার ভেল্ড অঞ্চল, এখানে হীরে ছড়ানো আছে সর্বত্র, এটা হীরের খনির দেশ। কিম্বার্লি খনির নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। আরও অনেক ছোটখাটো খনি আছে, এখানে ওখানে ছোট বড় হীরের টুকরো কত লোক পেয়েছে, এখনো পায়।
কথা শেষ করেই বলে উঠল— ও কারা?
শঙ্কর সামনে বসে ওর কথা শুনছিল। বললে— কোথায়? কে?
কিন্তু আলভারেজের তীক্ষ্ণদৃষ্টি তার হাতের বন্দুকের গুলির মতোই অব্যর্থ, একটু পরে তাঁবু থেকে দূরে অন্ধকারে কয়েকটি অস্পষ্ট মূর্তি এদিকে এগিয়ে আসছে, শঙ্করের চোখে পড়ল। আলভারেজ বললে— শঙ্কর, বন্দুক নিয়ে এসো, চট করে যাও, টোটা ভরে—
বন্দুক হাতে শঙ্কর বাইরে এসে দেখলে, আলভারেজ নিশ্চিন্ত মনে ধূমপান করছে, কিছুদূরে অজানা মূর্তি কয়টি এখনো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আসছে। একটু পরে তারা এসে তাঁবুর অগ্নিকুন্ডের বাইরে দাঁড়াল। শঙ্কর চেয়ে দেখলে আগন্তুক কয়েকটি কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘকায়— তাদের হাতে কিছু নেই, পরনে লেংটি, গলায় সিংহের লোম, মাথায় পালক— সুগঠিত চেহারা। তাঁবুর আলোয় মনে হচ্ছিল, যেন কয়েকটি ব্রোঞ্জের মূর্তি।
আলভারেজ জুলু ভাষায় বললে— কি চাও তোমরা?
ওদের মধ্যে কি কথাবার্তা চলল, তারপর ওরা সব মাটির ওপর বসে পড়ল। আলভারেজ বললে— শঙ্কর, ওদের খেতে দাও—
তারপর অনুচ্চস্বরে বললে— বড় বিপদ। খুব হুঁশিয়ার, শঙ্কর!
টিনের খাবার খোলা হল। সকলের সামনেই খাবার রাখলে শঙ্কর। আলভারেজও ওই সঙ্গে আবার খেতে বসল যদিও সে ও শঙ্কর সন্ধ্যার সময়েই তাদের নৈশ আহার শেষ করেছে। শঙ্কর বুঝলে আলভারেজের কোনো মতলব আছে, কিংবা এদেশের রীতি অতিথির সাথে খেতে হয়।
আলভারেজ খেতে খেতে জুলু ভাষায় আগন্তুকদের সঙ্গে গল্প করছে, অনেকক্ষণ পরে খাওয়া শেষে ওরা চলে গেল। যাবার আগে সবাইকে একটা করে সিগারেট দেওয়া হল।
ওরা চলে গেলে আলভারেজ বললে— ওরা মাটাবেল জাতির লোক। ভয়ানক দুর্দান্ত, ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের সঙ্গে অনেকবার লড়েছে। শয়তানকেও ভয় করে না। ওরা সন্দেহ করেছে আমরা ওদের দেশে এসেছি হীরের খনির সন্ধানে। আমরা যে জায়গাটায় আছি, এটা ওদের একজন সর্দারের রাজ্য। কোনো সভ্য গভর্ণমেন্টের আইন এখানে খাটবে না। ধরবে আর নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারবে। চল আমরা তাঁবু তুলে রওনা হই।
শঙ্কর বললে— তবে তুমি বন্দুক আনতে বললে কেন?
আলভারেজ হেসে বললে— দেখ, ভেবেছিলাম যদি ওরা খেয়েও না ভোলে, কিংবা কথাবার্তায় বুঝতে পারি যে, ওদের মতলব খারাপ, ভোজনরত অবস্থাতেই ওদের গুলি করবো। এই দ্যাখো রিভলবার পিছনে রেখে তবে খেতে বসেছিলাম, এ ক’টাকে সাবাড় করে দিতাম। আমার নাম আলভারেজ, আমিও এককালে শয়তানকে ভয় করতুম না, এখনো করিনে। ওদের হাতের মাছ মুখে পৌঁছবার আগেই আমার পিস্তলের গুলি ওদের মাথার খুলি উড়িয়ে দিত।
আরও পাঁচ-ছ’দিন পথ চলবার পরে একটা খুব বড় পর্বতের পাদমূলে নিবিড় ট্রপিক্যাল অরণ্যানীর মধ্যে ওরা প্রবেশ করলে। স্থানটি যেমন নির্জন, তেমনি বিশাল। সে বন দেখে শঙ্করের মনে হল, একবার যদি সে এর মধ্যে পথ হারায় সারাজীবন ঘুরলেও বার হয়ে আসবার সাধ্য তার হবে না। আলভারেজও তাকে সাবধান করে দিয়ে বললে— খুব হুঁশিয়ার শঙ্কর, বনে চলাফেরা যার অভ্যাস নেই, সে পদে পদে এইসব বনে পথ হারাবে। অনেক লোক বেঘোরে পড়ে বনের মধ্যে মারা পড়ে। মরুভূমির মধ্যে যেমন পথ হারিয়ে ঘুরেছিলে, এর মধ্যেও ঠিক তেমনিই পথ হারাতে পার। কারণ এখানে সবই একরকম, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গাকে পৃথক করে চিনে নেবার কোনো চিহ্ন নেই। ভালো বুশম্যান না হলে পদে পদে বিপদে পড়তে হবে। বন্দুক না নিয়ে এক পা কোথাও যাবে না, এটিও যেন মনে থাকে। মধ্য-আফ্রিকার বন শৌখিন ভ্রমণের পার্ক নয়।