চাঁদের পাহাড়

শঙ্করকে তা না বললেও চলতো, কারণ এসব অঞ্চল যে শখের পার্ক নয়, তা এর চেহারা দেখেই সে বুঝতে পেরেছে। সে জিজ্ঞেস করলে— তোমার সেই হলদে হীরের খনি কতদূরে? এই তো রিখটারসভেল্ড পর্বতমালা, ম্যাপে যতদূর বোঝা যাচ্ছে।

আলভারেজ হেসে বললে— তোমার ধারণা নেই বললাম যে। আসল রিখটারসভেল্ডের এটা বাইরের থাক্‌। এরকম আরো অনেক থাক্‌ আছে। সমস্ত অঞ্চলটা এত বিশাল যে পুবে সত্তর মাইল ও পশ্চিম দিকে একশো থেকে দেড়শো মাইল পর্যন্ত গেলেও এ বন-পাহাড় শেষ হবে না। সর্বনিম্ন প্রস্থ চল্লিশ মাইল। সমস্ত জড়িয়ে আট-ন’হাজার বর্গমাইল সমস্ত রিখটারসভেল্ড পার্বত্য অঞ্চল ও অরণ্য। এই বিশাল অজানা অঞ্চলের কোনখানটাতে এসেছিলুম আজ সাত-আট বছর আগে, ঠিক সে জায়গাটা খুঁজে বার করা কি ছেলেখেলা ইয়্যাংম্যান?

শঙ্কর বললে— এদিকে খাবার ফুরিয়েছে, শিকারের ব্যবস্থা দেখতে হয়, নইলে কাল থেকে বায়ু ভক্ষণ করা ছাড়া উপায় নেই।

আলভারেজ বললে— কিচ্ছু ভেব না। দেখছ না গাছে গাছে বেবুনের মেলা। কিছু না মেলে, বেবুনের দাপনা ভাজা আর কফি দিয়ে দিব্যি ব্রেকফাস্ট খাব আজ থেকে। আজ আর নয়, তাঁবু ফেল, বিশ্রাম করা যাক।

একটা বড় গাছের নিচে তাঁবু খাটিয়ে ওরা আগুন জ্বাললে। শঙ্কর রান্না করলে, আহারাদি শেষ করে যখন দু’জনে আগুনের সামনে বসেছে, তখনো বেলা আছে।

আলভারেজ কড়া তামাকের পাইপ টানতে টানতে বললে— জানো শঙ্কর, আফ্রিকার এইসব অজানা অরণ্যে এখনো কত জানোয়ার আছে, যার খবর বিজ্ঞানশাস্ত্র রাখে না? খুব কম সভ্য মানুষ এখানে এসেছে। ওকাপি বলে যে জানোয়ার সে তো প্রথম দেখা গেল ১৯০০ সালে। এক ধরনের বুনো শুওর আছে, যা সাধারন বুনো শুওরের প্রায় তিনগুণ বড় আকারে। ১৮৮৮ সালে মোজেস কাউলে, পৃথিবী পর্যটক ও বড় শিকারী, সর্বপ্রথম ওই বুনো শুওরের সন্ধান পান বেলজিয়ান কঙ্গোর লুয়ালাবু অরণ্যের মধ্যে। তিনি বহু কষ্টে একটা শিকার করেন এবং নিউইয়র্ক প্রাণীবিদ্যা সংক্রান্ত মিউজিয়ামে উপহার দেন। বিখ্যাত রোডেসিয়ান মনস্টারের নাম শুনেছ?

শঙ্কর বললে— না, কী সেটা?

শোনো তবে। রোডেসিয়ার উত্তর সীমায় প্রকান্ড জলাভূমি আছে। ওদেশের অসভ্য জুলুদের মধ্যে অনেকেই এক অদ্ভুত ধরনের জানোয়ারকে এই জলাভূমিতে মাঝে মাঝে দেখেছে। ওরা বলে তার মাথা কুমিরের মতো, গন্ডারের মতো তার শিং আছে, গলাটা অজগর সাপের মতো লম্বা ও আঁশওয়ালা দেহটা জলহস্তীর মতো, লেজটা কুমিরের মতো। বিরাটদেহ এই জানোয়ারের প্রকৃতিও খুব হিংস্র। জল ছাড়া কখনো ডাঙায় এ জানোয়ারকে দেখা যায়নি। তবে এই সব অসভ্য দেশী লোকের অতিরঞ্জিত বিবরণ বিশ্বাস করা শক্ত।

কিন্তু ১৮৮০ সালে জেমস মার্টিন বলে একজন প্রসপেক্টর রোডেসিয়ার এই অঞ্চলে বহুদিন ঘুরেছিল সোনার সন্ধানে। মিস্টার মার্টিন আগে জেনারেল ম্যাথিউসের এডিকিং ছিলেন, নিজে একজন ভালো ভূতত্ত্ব ও প্রাণীতত্ত্ববিদও ছিলেন। ইনি তাঁর ডায়েরির মধ্যে রোডেসিয়ার এই অজ্ঞাত জানোয়ার দূর থেকে দেখেছেন বলে উল্লেখ করে গিয়েছেন। তিনিও বলেন জানোয়ারটা আকৃতিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসর জাতীয় সরীসৃপের মতো ও বেজায় বড়। কিন্তু তিনি জোর করে কিছু বলতে পারেননি, কারণ খুব ভোরের কুয়াশার মধ্যে কোভিরান্ডো হ্রদের সীমানায়, জলাভূমিতে আবছায়া ভাবে তিনি জানোয়ারটিকে দেখেছিলেন। জানোয়ারটার ঘোড়ার চিঁহিঁ ডাকের মতো ডাক শুনেই তাঁর সঙ্গের জুলু চাকরগুলো উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে পালাতে বললে— সাহেব পালাও, ডিঙ্গোনেক! ডিঙ্গোনেক! ডিঙ্গোনেক ঐ জানোয়ারটার জুলু নাম। দু-তিন বছরে এক আধবার দেখা দেয় কি না দেয়, কিন্তু সেটা এতই হিংস্র যে তার আবির্ভাব সে দেশের লোকের পক্ষে ভীষণ ভয়ের ব্যাপার। মিস্টার মার্টিন বলেন, তিনি তাঁর ৩০৩ টোটা গোটা দুই উপরি উপরি ছুঁড়েছিলেন জানোয়ারটার দিকে। অত দূর থেকে তাক হল হল না, রাইফেলের আওয়াজে সেটা সম্ভবত জলে ডুব দিলে।

শঙ্কর বললে— তুমি কি করে জানলে এ সব? মার্টিনের ডায়েরি ছাপানো হয়েছিল নাকি?

না, অনেকদিন আগে বুলাওয়েও ক্রনিকল কাগজে মিস্টার মার্টিনের এই ঘটনাটা বেরিয়েছিল। আমি তখন সবে এদেশে এসেছি। রোডেসিয়া অঞ্চলে আমিও প্রসপেক্টিং করে বেড়াতুম বলে জানোয়ারটার বিবরণ আমাকে খুব আকৃষ্ট করে। কাগজখানা অনেকদিন আমার কাছে রেখেও দিয়েছিলুম। তারপর কোথায় হারিয়ে গেল। ওরাই নাম দিয়েছিল জানোয়ারটার— ‘রোডেসিয়ান মনস্টার’।

শঙ্কর বললে— তুমি কোনো কিছু অদ্ভুত জানোয়ার দেখনি?

প্রশ্নটার সঙ্গে সঙ্গে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল।

তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে নেমে এসেছে। সেই আবছায়া আলো অন্ধকারের মধ্যে শঙ্করের মনে হল— হয়তো শঙ্করের ভুল হতে পারে— কিন্তু শঙ্করের মনে হল সে দেখলে আলভারেজ, দুর্ধর্ষ ও নির্ভীক আলভারেজ, দুঁদে ও অব্যর্থলক্ষ্য আলভারেজ, ওর প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল— এবং— এবং সেটাই সকলের চেয়ে আশ্চর্য— যেন পরক্ষণেই শিউরে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে আলভারেজ যেন নিজের অজ্ঞাতসারেই চারপাশের জনমানবহীন ঘন জঙ্গল ও রহস্যভরা দুরারোহ পর্বতমালার দিকে একবার চেয়ে দেখলে, কোনো কথা বললে না। যেন এই পর্বত-জঙ্গলে বহুকাল পরে এসে অতীতের কোনো বিভীষিকাময় পুরাতন ঘটনা ওর স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে— যে স্মৃতিটা ওর পক্ষে খুব প্রীতিকর নয়।

আলভারেজ ভয় পেয়েছে!

অবাক! আলভারেজের ভয়! শঙ্কর ভাবতেও পারে না।

কিন্তু সেই ভয়টা অলক্ষিতে এসে শঙ্করের মনেও চেপে বসল। এই সম্পূর্ণ অজানা বিচিত্র রহস্যময় বনানী, এই বিরাট পর্বত প্রাচীর যেন এক গভীর রহস্যকে যুগ যুগ ধরে গোপন করে আসছে। যে বীর, যে নির্ভীক, এগিয়ে এসো সে— কিন্তু মৃত্যুপণে ক্রয় করতে হবে সেই গহন রহস্যের সন্ধান।

রিখটারসভেল্ড পর্বতমালা ভারতবর্ষের দেবাত্মা নগাধিরাজ হিমালয় নয়— এদেশের মাসাই, জুলু, মাটাবেল প্রভৃতি আদিম জাতির মতোই ওর আত্মা নিষ্ঠুর, বর্বর, নরমাংসলোলুপ। সে কাউকে রেহাই দেবে না।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

তারপর দিন দুই কেটে গেল। ওরা ক্রমশঃ গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল। পথ কোথাও সমতল নয়, কেবল চড়াই আর উতরাই, মাঝে মাঝে কর্কশ ও দীর্ঘ টুসক ঘাসের বন, জল প্রায় দুষ্প্রাপ্য, ঝরনা এক-আধটা যদিও বা দেখা যায়, আলভারেজ তাদের জল ছুঁতেও দেয় না। দিব্যি স্ফটিকের মতো নির্মল জল পড়ছে ঝরনা বেয়ে, সুশীতল ও লোভনীয়, তৃষ্ণার্ত লোকের পক্ষে সে লোভ সম্বরণ করা বড়ই কঠিন— কিন্তু আলভারেজ জলের বদলে ঠান্ডা চা খাওয়াবে তবুও জল খেতে দেবে না। জলের তৃষ্ণা ঠান্ডা চায়ে দূর হয় না, তৃষ্ণার কষ্টই সব চেয়ে বেশি বলে মনে হচ্ছিল শঙ্করের। এক জায়গায় টুসক ঘাসের বন বেজায় ঘন। তবে উপরে ওদের চারধার ঘিরে সেদিন কুয়াশাও খুব গভীর। হঠাৎ বেলা উঠলে নিচের কুয়াশা সরে গেল। সামনে চেয়ে শঙ্করের মনে হল, খুব বড় একটা চড়াই তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে, কত উঁচু সেটা তা জানা সম্ভব নয়, কারণ নিবিড় কুয়াশা কিংবা মেঘে তার উপরের দিকটা সম্পূর্ণরূপে আবৃত।

আলভারেজ বললে— রিখটারসভেল্ডের আসল রেঞ্জ।

শঙ্কর বললে— এটা পার হওয়ার কি দরকার?

আলভারেজ বললে— এইজন্যে দরকার যে, সেবার আমি আর জিম দক্ষিণ দিক থেকে এসেছিলুম এই পর্বতশ্রেণীর পাদমূলে কিন্তু আসল রেঞ্জ পার হই নি। যে নদীর ধারে হলদে হীরে পাওয়া গিয়েছিল, তার গতি পুব থেকে পশ্চিমে। এবার আমরা যাচ্ছি উত্তর থেকে দক্ষিণে, সুতরাং পর্বত পার হয়ে ওপারে না গেলে কি সেই নদীটার ঠিকানা করতে পারি?

শঙ্কর বললে— আজ যে রকম কুয়াশা হয়েছে দেখতে পাচ্ছি, তাতে একটু অপেক্ষা করা যাক না কেন? আর একটু বেলা বাড়ুক।

তাঁবু ফেলে আহারাদি সম্পন্ন করা হল। বেলা বাড়লেও কুয়াশা তেমন কাটল না। শঙ্কর ঘুমিয়ে পড়ল তাঁবুর মধ্যে। ঘুম যখন ভাঙল, বেলা তখন নেই। চোখ মুছতে মুছতে তাঁবুর বাইরে এসে সে দেখলে আলভারেজ চিন্তিত মুখে ম্যাপ খুলে বসে আছে। শঙ্করকে দেখে বললে— শঙ্কর, আমাদের এখনো অনেক ভুগতে হবে। সামনে চেয়ে দেখ।

0 Shares