চাঁদের পাহাড়

সেদিন অপরাহ্নে যখন আলভারেজ তাঁবু ফেলে বিশ্রাম করবার হুকুম দিলে— তখন তাঁবুর বাইরে বসে একপাত্র কফি খেতে খেতে শঙ্করের মনে হল, এ যেন সৃষ্টির আদিম যুগের অরণ্যানী, পৃথিবীর উদ্ভিদজগৎ যখন কোনো একটা সুনির্দিষ্ট রূপ ও আকৃতি গ্রহণ করেনি, যে যুগে পৃথিবীর বুকে বিরাটকায় সরীসৃপের দল জগৎ‌জোড়া বনজঙ্গলের নিবিড় অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতো— সৃষ্টির সেই অতীত প্রভাতে সে যেন কোনো যাদুমন্ত্রের বলে ফিরে গিয়েছে।

সন্ধ্যার পরেই সমগ্র বনানী নিবিড় অন্ধকারে আবৃত হল। তাঁবুর বাইরে ওরা আগুন করেছে— সেই আলোর মন্ডলীর বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। এ বনের আশ্চর্য নিস্তব্ধতা শঙ্করকে বিস্মিত করেছে। বনানীর সেই বিচিত্র নৈশ শব্দ এখানে স্তব্ধ কেন? আলভারেজ চিন্তিত মুখে ম্যাপ দেখছিল। বললে— শোনো শঙ্কর, একটা কথা ভাবছি। আট হাজার ফুট উঠলাম, কিন্তু এখনো পর্বতের সেই খাঁজটা পেলাম না যেটা দিয়ে আমরা রেঞ্জ পার হয়ে ওপারে যাবো। আর কত ওপরে উঠব? যদি ধরো এই অংশে স্যাডলটা না-ই থাকে?

শঙ্করের মনেও এ খটকা যে না জেগেছে তা নয়। সে আজই ওঠবার সময় মাঝে মাঝে ফিল্ড গ্লাস দিয়ে উপরের দিকে দেখবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ঘন মেঘে বা কুয়াশায় উপরের দিকটা সর্বদাই আবৃত থাকায় তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সত্যিই তো, তারা কত উঠবে আর, সমতল খাঁজ যদি না পাওয়া যায়? আবার নিচে নামতে হবে, আবার অন্য জায়গা বেয়ে উঠতে হবে। দফা সারা!

সে বললে— ম্যাপে কি বলে?

আলভারেজের মুখ দেখে মনে হল ম্যাপের উপর সে আস্থা হারিয়েছে। বললে— এ ম্যাপ অত খুঁটিনাটি ভাবে তৈরি নয়। এ পর্বতে উঠেছে কে যে ম্যাপ তৈরি হবে? এই যে দেখছ— এখানা স্যার ফিলিপো ডি ফিলিপির তৈরি ম্যাপ, যিনি পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকার ফার্ডিনান্ডো পো শৃঙ্গ আরোহণ করে খুব নাম করেন, এবং বছর কয়েক আগে বিখ্যাত পর্বত আরোহণকারী পর্যটক ডিউক অব আব্রুৎ‌সির অভিযানেও যিনি ছিলেন। কিন্তু রিখটারসভেল্ডে তিনি ওঠেননি, এ ম্যাপে পাহাড়ের যে কনটুর ছবি আঁকা আছে, তা খুব নিখুঁত বলে মনে তো হয় না। ঠিক বুঝছি নে।

হঠাৎ শঙ্কর বলে উঠল— ও কি?

তাঁবুর বাইরে প্রথমে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ, এবং পরক্ষণেই একটা কষ্টকর কাশির শব্দ পাওয়া গেল— যেন থাইসিসের রোগী খুব কষ্টে কাতর ভাবে কাশছে। একবার… দু’বার… তারপরেই শব্দটা থেমে গেল। কিন্তু সেটা মানুষের গলার শব্দ নয়, শোনবামাত্রই শঙ্করের সে কথা মনে হল।

রাইফেল নিয়ে সে ব্যস্তভাবে তাঁবুর বার হতে যাচ্ছে, আলভারেজ তাড়াতাড়ি উঠে ওর হাত ধরে বসিয়ে দিলে।

শঙ্কর আশ্চর্য হয়ে বললে— কেন, কিসের শব্দ ওটা?

বলে আলভারেজের দিকে চাইতেই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে! শব্দটা শুনেই কি?

সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর অগ্নিকুন্ডের মন্ডলীর বাইরে, নিবিড় অন্ধকারে একটা ভারী অথচ লঘুপদ জীব যেন বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে— বেশ মনে হল।

দু’জনেই খানিকটা চুপচাপ, তারপর আলভারেজ বললে— আগুনে কাঠ ফেলে দাও। বন্দুক দুটো ভরা আছে কিনা দেখ। ওর মুখের ভাব দেখে শঙ্কর ওকে আর কোনো প্রশ্ন করতে সাহস করলে না।

রাত্রি কেটে গেল।

পরদিন সকালে শঙ্করেরই ঘুম ভাঙলো আগে। তাঁবুর বাইরে এসে কফি করবার আগুন জ্বালতে সে তাঁবু থেকে কিছুদূরে কাঠ ভাঙতে গেল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল ভিজে মাটির উপর একটা পায়ের দাগ— লম্বায় দাগটা এগারো ইঞ্চির কম নয়, কিন্তু পায়ে তিনটে মাত্র আঙুল। তিন আঙুলেরই দাগ বেশ স্পষ্ট। পায়ের দাগ ধরে সে এগিয়ে গেল— আরও অনেকগুলো সেই পায়ের দাগ আছে, সবগুলোতেই সেই তিন আঙুল।

শঙ্করের মনে পড়ল ইউগান্ডার স্টেশনঘরে আলভারেজের মুখে শোনা জিম কার্টারের মৃত্যুকাহিনী। গুহার মুখের বালির উপর সেই অজ্ঞাত হিংস্র জানোয়ারের তিন আঙুলওয়ালা পায়ের দাগ। কাফির গ্রামের সেই সর্দারের মুখে শোনা গল্প।

কাল রাত্রে আলভারেজের বিবর্ণ মুখও সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। আর একদিনও আলভারেজ ঠিক এই রকমই ভয় পেয়েছিল, যেদিন পর্বতের পাদমূলে ওরা প্রথম এসে তাঁবু পাতে।

বুনিপ! কাফির সর্দারের গল্পের সেই বুনিপ! রিখটারসভেল্ড পর্বত ও অরণ্যের বিভীষিকা, যার ভয়ে শুধু অসভ্য মানুষ কেন, অন্য কোনো বন্যজন্তু পর্যন্ত এই আট হাজার ফুটের ওপরকার বনে আসে না। কাল রাত্রে কোনো জানোয়ারের শব্দ পাওয়া যায়নি কেন, এখন তা শঙ্করের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আলভারেজ পর্যন্ত ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল ওর গলার শব্দ শুনে। বোধহয় ও শব্দের সঙ্গে আলভারেজের পূর্বে পরিচয় ঘটেছে।

আলভারেজের ঘুম ভাঙতে সেদিন একটু দেরি হল। গরম কফি এবং কিছু খাদ্য গলাধঃকরণ করবার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার সেই নির্ভীক ও দুর্ধর্ষ আলভারেজ, যে মানুষকেও ভয় করে না, শয়তানকেও না। শঙ্কর ইচ্ছে করেই আলভারেজকে ঐ অজ্ঞাত জানোয়ারের পায়ের দাগটা দেখালে না— কি জানি যদি আলভারেজ বলে বসে— এখনো পাহাড়ের স্যাডলটা পাওয়া গেল না, তবে নেমে যাওয়া যাক।

সকালে সেদিন খুব মেঘ করে ঝম্‌ঝম্‌ করে বৃষ্টি নামল। পর্বতের ঢাল বেয়ে যেন হাজার ঝরনার ধারায় বৃষ্টির জল গড়িয়ে নিচে নামছে। এই বন ও পাহাড় চোখে কেমন যেন ধাঁধা লাগিয়ে দেয়, এতটা উঠেছে ওরা কিন্তু প্রতি হাজার ফুট উপর থেকে নিচের অরণ্যের গাছপালার মাথা দেখে সেগুলিকে সমতলভূমির অরণ্য বলে ভ্রম হচ্ছে— কাজেই প্রথমটা মনে হয় যেন কতটুকুই বা উঠেছি, ঐটুকু তো।

বৃষ্টি সেদিন থামল না— বেলা দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আলভারেজ উঠবার হুকুম দিলে। শঙ্কর এটা আশা করেনি। এখানে শঙ্কর কর্মী শ্বেতাঙ্গ চরিত্রের একটা দিক লক্ষ্য করলে। তার মনে হচ্ছিল, কেন এই বৃষ্টিতে মিছেমিছি বার হওয়া? একটা দিনে কি এমন হবে? বৃষ্টি মাথায় পথ চলে লাভ?

অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারার মধ্যে ঘন অরণ্যানী ভেদ করে সেদিন ওরা সারাদিন উঠল। উঠছে, উঠছে, উঠছেই— শঙ্কর আর পারে না। কাপড়-চোপড় জিনিসপত্র, তাঁবু সব ভিজে একাকার, একখানা রুমাল পর্যন্ত শুকনো নেই কোথাও। শঙ্করের কেমন একটা অবসাদ এসেছে দেহে ও মনে— সন্ধ্যার দিকে যখন সমগ্র পর্বত ও অরণ্য মেঘের অন্ধকারে ও সন্ধ্যার অন্ধকারে একাকার হয়ে ভীমদর্শন ও গম্ভীর হয়ে উঠল, তখন ওর মনে হল— এই অজানা দেশে অজানা পর্বতের মাথায় ভয়ানক হিংস্র জন্তুসঙ্কুল বনের মধ্যে দিয়ে, বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়, কোন অনির্দেশ্য হীরকখনি বা তার চেয়েও অজানা মৃত্যুর অভিমুখে চলেছে সে কোথায়? আলভারেজ কে তার? তার পরামর্শে কেন সে এখানে এল? হীরের খনিতে তার দরকার নেই। বাঙলাদেশের খড়ে ছাওয়া ঘর, ছায়াভরা শ্রান্ত গ্রাম্য পথ, ক্ষুদ্র নদী, পরিচিত পাখিদের কাকলি— সেসব যেন কতদূরের কোন অবাস্তব স্বপ্ন-রাজ্যের জিনিস, আফ্রিকার কোনো হীরকখনি সে সবের চেয়ে মূল্যবান নয়।

কিন্তু তার এ ভাব কেটে গেল অনেক রাত্রে, যখন নির্মেঘ আকাশে চাঁদ উঠল। সে অপার্থিব জ্যোৎস্নাময় রাত্রির বর্ণনা নেই। শঙ্কর আর পৃথিবীতে নেই, বাঙলা বলে কোনো দেশ নেই। সব স্বপ্ন হয়ে গিয়েছে— সে আর কোথাও ফিরতে চায় না, হীরে চায় না, অর্থ চায় না— পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বহু উর্ধ্বে এক কৌমুদীশুভ্র দেবলোকের এখন সে অধিবাসী, তার চারধারে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য, কোনো মানুষের চোখ এর আগে তা দেখেনি। সে গহন নিস্তব্ধতা, এর আগে কোনো মানুষ অনুভব করেনি। জনমানবহীন বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্বত ও অরণ্য, এই গভীর নিশীথে মেঘলোকে আসন পেতে আপনাতে আপনি আত্মস্থ, ধ্যানস্তিমিত— পৃথিবীর মানুষের সেখানে প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য ক্বচিৎ ঘটে।

সেই রাত্রে ঘুম থেকে ও ধড়মড়িয়ে উঠল আলভারেজের ডাকে। আলভারেজ ডাকছে— শঙ্কর, শঙ্কর, ওঠো বন্দুক বাগাও—

– কি, কি?

তারপর ও কান পেতে শুনলে— তাঁবুর চারপাশে কে যেন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ বেশ শোনা যাচ্ছে তাঁবুর মধ্যে থেকে। চাঁদ ঢলে পড়েছে, তাঁবুর বাইরে অন্ধকারই বেশি, জ্যোৎস্নাটুকু গাছের মগডালে উঠে গিয়েছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাঁবুর দরজার মুখে আগুন তখনো একটু একটু জ্বলছে— কিন্তু তার আলোর বৃত্ত যেমন ছোট, আলোর জ্যোতিও ততোধিক ক্ষীণ, তাতে দেখবার সাহায্য কিছুই হয় না।

0 Shares