চাঁদের পাহাড়

হুড়মুড় করে একটা শব্দ হল— গাছপালা ভেঙে একটা ভারী জানোয়ার হঠাৎ ছুটে পালাল যেন। তাঁবুর সকলে সজাগ হয়ে উঠেছে, এখন আর অতর্কিতে শিকারের সুবিধে হবে না— বাইরের জানোয়ারটা যেন তা বুঝতে পেরেছে।

জানোয়ারটা যাই হোক না কেন, তার যেন বুদ্ধি আছে। বিচারের ক্ষমতা আছে, মস্তিষ্ক আছে।

আলভারেজ রাইফেল হাতে টর্চ জ্বেলে বাইরে গেল। শঙ্করও গেল ওর পেছনে পেছনে। টর্চের আলোয় দেখা গেল, তাঁবুর উত্তর-পূর্ব কোণের জঙ্গলের চারা গাছপালার উপর দিয়ে যেন একটা ভারী স্টীম রোলার চলে গিয়েছে। আলভারেজ সেইদিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে বার দুই আওয়াজ করলে।

কোনোদিকে কোনো শব্দ পাওয়া গেল না।

ফিরবার সময় তাঁবুর ঠিক দরজার মুখে আগুনের কুন্ডের অতি নিকটেই একটা পায়ের দাগ দু’জনেরই চোখে পড়ল। তিনটে মাত্র আঙুলের দাগ ভিজে মাটির ওপর সুস্পষ্ট!

এতে প্রমাণ হয়, জানোয়ারটা আগুনকে ডরায় না। শঙ্করের মনে হল, যদি ওদের ঘুম না ভাঙত, তবে সেই অজ্ঞাত বিভীষিকাটি তাঁবুর মধ্যে ঢুকতে একটুও দ্বিধা করতো না— এবং তারপরে কি ঘটতো তা কল্পনা করে কোনো লাভ নেই। আলভারেজ বললে— শঙ্কর, তুমি তোমার ঘুম শেষ কর, আমি জেগে আছি।

শঙ্কর বললে— না, তুমি ঘুমোও আলভারেজ।

আলভারেজ ক্ষীণ হাসি হেসে বললে— পাগল, তুমি জেগে কিচ্ছু করতে পারবে না, শঙ্কর। ঘুমিয়ে পড়, ঐ দেখ দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আবার ঝড়বৃষ্টি আসবে, রাত শেষ হয়ে আসছে, ঘুমোও। আমি বরং একটু কফি খাই।

রাত ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে এল মুষলধারে বৃষ্টি, সঙ্গে সঙ্গে যেমনি বিদ্যুৎ , তেমনি মেঘগর্জন। সে বৃষ্টি চলল সমানে সারাদিন, তার বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। শঙ্করের মনে হল পৃথিবীতে আজ প্রলয়ের বর্ষণ শুরু হয়েছে, প্রলয়ের দেবতা সৃষ্টি ভাসিয়ে দেবার সূচনা করেছেন বুঝি। বৃষ্টির বহর দেখে আলভারেজ পর্যন্ত দমে গিয়ে তাঁবু উঠাবার নাম মুখে আনতে ভুলে গেল।

বৃষ্টি থামল যখন, তখন বিকেল পাঁচটা। বোধহয় বৃষ্টি না থামলেই ভালো ছিল, কারণ অমনি আলভারেজ চলা শুরু করবার হুকুম দিলে। বাঙালী ছেলের স্বভাবতঃই মনে হয়— এখন অবেলায় যাওয়া কেন? এত কি সময় বয়ে যাচ্ছে? কিন্তু আলভারেজের কাছে দিন, রাত, বর্ষা, রৌদ্র, জ্যোৎস্না, অন্ধকার সব সমান। সে রাত্রে বর্ষাস্নাত বনভূমির মধ্যে দিয়ে মেঘভাঙা জ্যোৎস্নার আলোয় দু’জনে উঠছে, উঠছে— এমন সময় আলভারেজ পেছন থেকে বলে উঠল— শঙ্কর দাঁড়াও, ঐ দেখ—

আলভারেজ ফিল্ড গ্লাস দিয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্নালোকে বাঁ পাশের পর্বতশিখরের দিকে চেয়ে দেখছে। শঙ্কর ওর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। হ্যাঁ, সমতল খাঁজটা পাওয়া গিয়েছে! বেশি দূরেও নয়, মাইল দুইয়ের মধ্যে, বাঁ দিক ঘেঁষে!

আলভারেজ হাসিমুখে বললে— দেখেছ স্যাডলটা? থামবার দরকার নেই, চল আজ রাত্রেই স্যাডলের উপর পৌঁছে তাঁবু ফেলব। শঙ্কর আর সত্যিই পারছে না। এই দুর্ধর্ষ পর্তুগিজটার সঙ্গে হীরের সন্ধানে এসে সে কি ঝকমারি-ই না করেছে! শঙ্কর জানে অভিযানের নিয়মানুযায়ী দলপতির হুকুমের উপর কোনো কথা বলতে নেই। এখানে আলভারেজই দলপতি, তার আদেশ অমান্য করা চলবে না। কোথাও আইনে লিপিবদ্ধ না থাকলেও পৃথিবীর ইতিহাসের বড় বড় অভিযানে সবাই এই নিয়ম মেনে চলে। সেও মানবে।

অবিশ্রান্ত হাঁটবার পরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ওরা এসে স্যাডলে যখন উঠল— শঙ্করের তখন আর এক পা-ও চলবার শক্তি নেই।

স্যাডলটার বিস্তৃতি তিন মাইলের কম নয়, কখনোবা দুশো ফুট খাড়া উঠেছে, কখনোবা চার-পাঁচশো ফুট নেমে গিয়েছে এক মাইলের মধ্যে, সুতরাং বেশ দুরারোহ— যতটুকু সমতল, ততটুকু শুধুই বড় বড় বনস্পতির জঙ্গল, ইরিথ্রিনা, পেনসিয়ানা, রিঠাগাছ, বাঁশ বা বন্য আদা। বিচিত্র বর্ণের অর্কিডের ফুল ডালে ডালে। বেবুন ও কলোবাস বাঁদর সর্বত্র।

আরও দু’দিন ক্রমাগত নামতে নামতে ওরা রিখটারসভেল্ড পর্বতের আসল রেঞ্জের ওপারের উপত্যকায় গিয়ে পদার্পণ করল। শঙ্করের মনে হল, এদিকে জঙ্গল যেন আরও বেশি দুর্ভেদ্য ও বিচিত্র। আটলান্টিক মহাসাগরের দিক থেকে সমুদ্রবাষ্প উঠে কতক ধাক্কা খায় পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুণ পর্বতে, বাকিটা আটকায় বিশাল রিখটারসভেল্ডের দক্ষিণ সানুতে— সুতরাং বৃষ্টি এখানে হয় অজস্র, গাছপালার তেজও তেমনি।

দিন পনেরো ধরে সেই বিরাট অরণ্যাকীর্ণ উপত্যকার সর্বত্র দু’জনে মিলে খুঁজেও আলভারেজ বর্ণিত পাহাড়ী নদীর কোনো ঠিকানা বার করতে পারল না। ছোটখাটো ঝরনা দু-একটা উপত্যকার ওপর দিয়ে বইছে বটে— কিন্তু আলভারেজ কেবলই ঘাড় নাড়ে আর বলে— এসব নয়।

শঙ্কর বলে— তোমার ম্যাপ দেখ না ভালো করে?

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, আলভারেজের ম্যাপের কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আলভারেজ বলে— ম্যাপে কি হবে? আমার মনেই গভীর ভাবে আঁকা আছে সে নদী ও সে উপত্যকার ছবি— সে একবার দেখতে পেলেই তখুনি চিনে নেব। এ সে জায়গাই নয়, এ উপত্যকা সে উপত্যকাই নয়।

নিরুপায়! খোঁজ তবে…

এক মাস কেটে গেল। পশ্চিম আফ্রিকার বর্ষা নামল মার্চ মাসের প্রথমে। সে কি ভয়ানক বর্ষা! শঙ্কর তার কিছু নমুনা পেয়ে এসেছে রিখটারসভেল্ড পার হবার সময়ে। উপত্যকা ভেসে গেল পাহাড় থেকে নামা বড় বড় পার্বত্য ঝরনার জলধারায়। তাঁবু ফেলবার স্থান নেই। একরাত্রে হঠাৎ অতিবর্ষণের ফলে ওদের তাঁবুর সামনে একটা নিরীহ ক্ষীণকায় ঝরনাধারা ভীমমূর্তি ধারণ করে তাঁবুসুদ্ধ ওদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবার যোগাড় করেছিল— আলভারেজের সজাগ ঘুমের জন্যে সে যাত্রা বিপদ কেটে গেল।

কিন্তু দিন যায় তো ক্ষণ যায় না। শঙ্কর একদিন ঘোর বিপদে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। সে বিপদটাও বড় অদ্ভুত ধরনের!

সেদিন আলভারেজ তাঁবুতে তার নিজের রাইফেল পরিষ্কার করছিল, সেটা শেষ করে রান্না করবে কথা ছিল। শঙ্কর রাইফেল হাতে বনের মধ্যে শিকারের সন্ধানে বার হয়েছে।

আলভারেজ বলে দিয়েছে তাকে এ বনে খুব সতর্ক হয়ে সাবধানে চলাফেরা করতে— আর বন্দুকের ম্যাগাজিনে সব সময় যেন কার্ট্রিজ ভরা থাকে। আর একটা মূল্যবান উপদেশ দিয়েছে, সেটা এই— বনের মধ্যে বেড়াবার সময় হাতের কব্জিতে কম্পাস সর্বদা বেঁধে নিয়ে বেড়াবে এবং যে পথ দিয়ে যাবে, সে পথের ধারে গাছপালায় কোনো চিহ্ন রেখে যাবে, যাতে ফেরবার সময় সেই সব চিহ্ন ধরে আবার ঠিক ফিরতে পারো। নতুবা বিপদ অবশ্যম্ভাবী।

সেদিন শঙ্কর স্প্রিংবক হরিণের সন্ধানে গভীর বনে চলে গিয়েছে। সকালে বেরিয়েছিল, ঘুরে ঘুরে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে এক জায়গায় একটা বড় গাছের তলায় সে একটু বিশ্রামের জন্যে বসল।

সেখানটাতে চারধারেই বৃহৎ বৃহৎ বনস্পতির মেলা, আর সব গাছেই গুঁড়ি ও ডালপালা বেয়ে এক প্রকারের বড় বড় লতা উঠে তাদের ছোট ছোট পাতা দিয়ে এমন নিবিড় ভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে গাছগুলো জড়িয়েছে যে গুঁড়ির আসল রং দেখা যাচ্ছে না। কাছেই একটা ছোট্ট জলার ধারে ঝাড়ে ঝাড়ে মারিপোসা লিলি ফুটে রয়েছে।

খানিকটা সেখানে বসবার পরে শঙ্করের মনে হল তার কি একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কী ধরনের অস্বস্তি তা সে কিছু বুঝতে পারলে না— অথচ জায়গাটা ছেড়ে উঠে যাবারও ইচ্ছে তার হল না— সে ক্লান্তও বটে, আর জায়গাটা বেশ আরামেরও বটে!

কিন্তু এ তার কী হল? তার সমস্ত শরীরে এত অবসাদ এল কোথা থেকে? ম্যালেরিয়া জ্বরে ধরল নাকি?

অবসাদটা কাটাবার জন্যে সে পকেট হাতড়ে একটা চুরুট বার করে ধরালে। কিসের একটা মিষ্টি মিষ্টি সুগন্ধ বাতাসে— শঙ্করের বেশ লাগছে গন্ধটা। একটু পরে দেশলাইটা মাটি থেকে কুড়িয়ে পকেটে রাখতে গিয়ে মনে হল, হাতটা যেন তার নিজের নয়— যেন আর কারো হাত, তার মনের ইচ্ছেয় সে হাত নড়ে না।

ক্রমেই তার সর্বশরীর যেন বেশ একটা আরামদায়ক অবসাদে অবশ হয়ে পড়তে চাইল। কি হবে আর বৃথা ভ্রমণে, আলেয়ার পিছু পিছু বৃথা ছুটে, এই রকম বনের ঘন ছায়ায় নিভৃত লতাবিতানে, অলস স্বপ্নে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার চেয়ে সুখ আর কি আছে?

একবার তার মনে হল, এই বেলা উঠে তাঁবুতে যাওয়া যাক, নতুবা তার কোনো একটা বিপদ ঘটবে যেন। একবার সে উঠবার চেষ্টাও করতে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই তার দেহমনব্যাপী অবসাদের জয় হল। অবসাদ নয়, যেন একটা মৃদুমধুর নেশার আনন্দ। সমস্ত জগত্‍ তার কাছে তুচ্ছ। সে নেশাটাই তার সারাদেহ অবশ করে আনছে ক্রমশঃ।

0 Shares