লোকালয় থেকে বহুদূরে এই জনহীন গহন অরণ্যে, ক্লান্ত আলভারেজের রত্নানুসন্ধান শেষ হল। তার মতো লোকেরা রত্নের কাঙাল নয়, বিপদের নেশায় পথে পথে ঘুরে বেড়ানোই তাদের জীবনের পরম আনন্দ, কুবেরের ভান্ডারও তাকে এক জায়গায় চিরকাল আটকে রাখতে পারতো না।
দুঃসাহসিক ভবঘুরের উপযুক্ত সমাধি বটে। অরণ্যের বনস্পতিদল ছায়া দেবে সমাধির উপর। সিংহ, গরিলা, হায়েনা সজাগ রাত্রি যাপন করবে, আর সবার উপরে, সবাইকে ছাপিয়ে বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্বতমালা অদূরে দাঁড়িয়ে মেঘলোকে মাথা তুলে খাড়া পাহারা রাখবে চিরযুগ।
দশম পরিচ্ছেদ
সে দিন সে রাত্রিও কেটে গেল। শঙ্কর এখন দুঃসাহসে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদি তাকে প্রাণ নিয়ে এ ভীষণ অরণ্য থেকে উদ্ধার পেতে হয়, তবে তাকে ভয় পেলে চলবে না। দু’দিন সে কোথাও না গিয়ে, তাঁবুতে বসে মন স্থির করে ভাববার চেষ্টা করলে, সে এখন কী করবে। হঠাৎ তার মনে হল আলভারেজের সেই কথাটা— সলস্বেরি… এখান থেকে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে আন্দাজ ছশো মাইল…
সলস্বেরি! দক্ষিণ রোডেসিয়ার রাজধানী সলস্বেরি… যে করে হোক, পৌঁছুতেই হবে তাকে সলস্বেরিতে। সে এখনো অনেকদিন বাঁচবে, তার জন্মকোষ্ঠিতে লেখা আছে যে! এ জায়গায় বেঘোরে সে মরবে না।
শঙ্কর ম্যাপগুলো খুব ভালো করে দেখলে। পর্তুগিজ গভর্ণমেন্টের ফরেস্ট সার্ভের ম্যাপ, ১৮৭৩ সালের রয়েল মেরিন সার্ভের তৈরি উপকূলের ম্যাপ, ভ্রমণকারী স্যার ফিলিপো ডি ফিলিপির ম্যাপ, এ বাদে আলভারেজের হাতে আঁকা ও জিম কার্টারের সইযুক্ত একখানা জীর্ণ, বিবর্ণ খসড়া নক্সা। আলভারেজ বেঁচে থাকতে সে এই সব ম্যাপ ভালো করে বুঝতে একবারও চেষ্টা করেনি, এখন এই ম্যাপ বোঝার উপর তার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। সলস্বেরির সোজা রাস্তা বার করতে হবে। এ স্থান থেকে তার অবস্থিতি বিন্দুর দিক নির্ণয় করতে হবে, রিখটারসভেল্ড অরণ্যের এ গোলকধাঁধা থেকে তাকে উদ্ধার পেতে হবে— সবই এই ম্যাপগুলির সাহায্যে।
অনেক দেখবার পর শঙ্কর বুঝতে পারলে এই অরণ্য ও পর্বতমালা সম্বন্ধে কোনো ম্যাপেই বিশেষ কিছুই দেওয়া নেই— এক আলভারেজ ও জিম কার্টারের খসড়া ম্যাপখানা ছাড়া। তাও সেগুলি এত সংক্ষিপ্ত এবং তাতে এত সাঙ্কেতিক ও গুপ্তচিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে যে শঙ্করের পক্ষে তা প্রায় দুর্বোধ্য। কারণ এদের সব সময়েই ভয় ছিল যে ম্যাপ অপরের হাতে পড়লে, পাছে আর কেউ এসে ওদের ধনে ভাগ বসায়।
চতুর্থ দিন শঙ্কর সে স্থান ত্যাগ করে আন্দাজমত পুব দিকে রওনা হল। যাবার আগে কিছু বনফুলের মালা গেঁথে আলভারেজের সমাধির ওপর অর্পণ করলে।
‘বুশ ক্র্যাফ্ট’ বলে একটা জিনিস আছে। সুবিস্তীর্ণ, বিজন, গহন অরণ্যানীর মধ্যে ভ্রমণ করবার সময় এ বিদ্যা জানা না থাকলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আলভারেজের সঙ্গে এতদিন ঘোরাঘুরি করবার ফলে, শঙ্কর কিছু কিছু ‘বুশ ক্র্যাফ্ট’ শিখে নিয়েছিল, তবুও তার মনে সন্দেহ হল যে, এই বন একা পাড়ি দেবার যোগ্যতা সে কি অর্জন করেছে? শুধু ভাগ্যের উপর নির্ভর করে তাকে চলতে হবে, ভাগ্য ভালো থাকলে বন পার হতে পারবে, ভাগ্য প্রসন্ন না হয়— মৃত্যু!
দুটো-তিনটে ছোট পাহাড় সে পার হয়ে চলল। বন কখনো গভীর, কখনো পাতলা। কিন্তু প্রকান্ড প্রকান্ড বনস্পতির আর শেষ নেই। শঙ্করের জানা ছিল যে, দীর্ঘ এলিফ্যান্ট ঘাসের জঙ্গল এলে বুঝতে হবে যে বনের প্রান্তসীমায় পৌঁছনো গিয়েছে। কারণ গভীর জঙ্গলে কখনো এলিফ্যান্ট বা টুসক ঘাস জন্মায় না। কিন্তু এলিফ্যান্ট ঘাসের চিহ্ন নেই কোনোদিকে— শুধু বনস্পতি আর নিচু বনঝোপ।
প্রথম দিন শেষ হল এক নিবিড়তর অরণ্যের মধ্যে। শঙ্কর জিনিসপত্র প্রায় সবই ফেলে দিয়ে এসেছিল, কেবল আলভারেজের ম্যানলিকার রাইফেলটা, অনেকগুলো টোটা, জলের বোতল, টর্চ, ম্যাপগুলো, কম্পাস, ঘড়ি, একখানা কম্বল ও সামান্য কিছু ঔষধ সঙ্গে নিয়েছিল— আর নিয়েছিল একটা দড়ির দোলনা। তাঁবুটা যদিও খুব হাল্কা ছিল, বয়ে আনা অসম্ভব বিবেচনায় ফেলেই এসেছে।
দুটো গাছের ডালে মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে সে দড়ির দোলনা টাঙাল এবং হিংস্র জন্তুর ভয়ে গাছতলায় আগুন জ্বাললে। দোলনায় শুয়ে বন্দুক হাতে জেগে রইল, কারণ ঘুম অসম্ভব। একে ভয়ানক মশা, তার উপর সন্ধ্যার পর থেকে গাছতলার কিছুদূর দিয়ে একটা চিতাবাঘ যাতায়াত শুরু করলে। গভীর অন্ধকারে তার চোখ জ্বলে যেন দুটো আগুনের ভাঁটা, শঙ্কর টর্চের আলো ফেললে পালিয়ে যায়, আবার আধঘন্টা পরে ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে। শঙ্করের ভয় হল, ঘুমিয়ে পড়লে হয়তোবা লাফ দিয়ে দোলনায় উঠে আক্রমণ করবে। চিতাবাঘ অতি ধূর্ত জানোয়ার। কাজেই সারারাত্রি শঙ্কর চোখের পাতা বোজাতে পারলে না। তার উপর চারধারে নানা বন্য জন্তুর রব। একবার একটু তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ কাছেই কোথাও একদল বালক-বালিকার খিলখিল হাসির শব্দে তন্দ্রা ছুটে গিয়ে ও চমকে জেগে উঠল। ছেলে-মেয়েরা হাসে কোথায়? এই জনমানবহীন অরণ্যে বালক-বালিকাদের যাতায়াত করা বা এত রাত্রে হাস্য তো উচিত নয়। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল একজাতীয় বেবুনের ডাক ঠিক ছেলেপুলের হাসির মতো শোনায়, আলভারেজ একবার গল্প করেছিল। ভোরবেলা সে গাছ থেকে নেমে রওনা হল। বৈমানিকরা যাকে বলেন ‘ফ্লাইং ব্লাইন্ড’— সে সেইভাবে বনের মধ্যে দিয়ে চলেছে, সম্পূর্ণ ভাগ্যের উপর নির্ভর করে, দু’চোখ বুজে। এই দু’দিন চলেই সে সম্পূর্ণভাবে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছে— আর তার উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম জ্ঞান নেই। সে বুঝলে কোনো মহারণ্যে দিক ঠিক রেখে চলা কি ভীষণ কঠিন ব্যাপার। তোমার চারপাশে সব সময়েই গাছের গুঁড়ি, অগণিত, অজস্র, তার লেখাজোখা নেই। তোমার মাথার উপর সব সময় ডালপালা লতাপাতার চন্দ্রাতপ। নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য দৃষ্টিগোচর হয় না। সূর্যের আলোও কম, সব সময়েই যেন গোধূলি। ক্রোশের পর ক্রোশ যাও, ঐ একই ব্যাপার। কম্পাস এদিকে অকেজো, কি করেই বা দিক ঠিক রাখা যায়?
পঞ্চম দিনে একটা পাহাড়ের তলায় এসে সে বিশ্রামের জন্যে থামল। কাছেই একটা প্রকান্ড গুহার মুখ, একটা ক্ষীণ জলস্রোত গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এঁকে বেঁকে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে।
অত বড় গুহা আগে কখনো না দেখবার দরুন কৌতূহলের বশবর্তী হয়েই সে জিনিসপত্র বাইরে রেখে গুহার মধ্যে ঢুকল। গুহার মুখে খানিকটা আলো— ভেতরে বড় অন্ধকার, টর্চ জ্বেলে সন্তর্পণে অগ্রসর হয়ে, সে ক্রমশঃ এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছুলো, যেখানে ডাইনে বাঁয়ে আরো দুটো মুখ। উপরের দিকে টর্চ উঠিয়ে দেখলে, ছাদটা অনেকটা উঁচু। সাদা শক্ত নুনের মতো ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের সরু মোটা ঝুরি ছাদ থেকে ঝাড় লন্ঠনের মতো ঝুলছে।
গুহার দেওয়ালগুলো ভিজে, গা বেয়ে অনেক জায়গায় জল খুব ক্ষীণধারায় ঝরে পড়ছে। শঙ্কর ডাইনের গুহায় ঢুকল, সেটা ঢুকবার সময় সরু কিন্তু ক্রমশঃ প্রশস্ত হয়ে গিয়েছে। পায়ে পাথর নয়, ভিজে মাটি। টর্চের আলোয় ওর মনে হল, গুহাটা ত্রিভূজাকৃতি। ত্রিভৃজের ভূমির এক কোণে আর একটা গুহামুখ। সেটা দিয়ে ঢুকে শঙ্কর দেখলে সে যেন দু’ধারে পাথরের উঁচু দেওয়ালওয়ালা একটা সংকীর্ণ গলির মধ্যে এসেছে। গলিটা আঁকাবাঁকা, একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলেছে, শঙ্কর অনেক দূর চলে গেল গলিটা ধরে।
ঘন্টা দুই এতে কাটল। তারপর সে ভাবলে, এবার ফেরা যাক। কিন্তু ফিরতে গিয়ে সে আর কিছুতেই সেই ত্রিভূজাকৃতি গুহাটা খুঁজে পেলে না। কেন, এই তো সেই গুহা থেকেই ওই সরু গুহাটা বেরিয়েছে, সরু গুহা তো শেষ হয়েই গেল— তবে সেই ত্রিভূজ গুহা কই?
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে শঙ্করের হঠাৎ কেমন আতঙ্ক উপস্থিত হল। সে গুহার মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেনি তো? সর্বনাশ!
সে বসে আতঙ্ক দূর করবার চেষ্টা করলে, ভাবলে— না, ভয় পেলে তার চলবে না। স্থিরবুদ্ধি ভিন্ন এ বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায় নেই। মনে পড়ল, আলভারেজ তাকে বলে দিয়েছিল, অপরিচিত স্থানে বেশিদূর অগ্রসর হবার সময়ে পথের পাশে সে যেন কোনো চিহ্ন রেখে যায়, যাতে আবার সেই চিহ্ন ধরে ফিরতে পারে। কিন্তু এ উপদেশ সে ভুলে গিয়েছিল। এখন উপায়?