চাঁদের পাহাড়

টর্চের আলো জ্বালতে তার আর ভরসা হচ্ছে না। যদি ব্যাটারি ফুরিয়ে যায়, তবে নিরুপায়। গুহার মধ্যে অন্ধকার সূচীভেদ্য। সেই দূর্নিরিক্ষ অন্ধকারে এক পা অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। পথ খুঁজে বার করা তো দূরের কথা।

সারাদিন কেটে গেল— ঘড়িতে সন্ধ্যে সাতটা। এদিকে টর্চের আলো রাঙা হয়ে আসছে ক্রমশঃ। ভীষণ গুমোট গরম গুহার মধ্যে, তা ছাড়া পানীয় জল নেই। পাথরের দেওয়াল বেয়ে যে জল চুঁইয়ে পড়ছে, তার আস্বাদ— কষা, ক্ষার, ঈষৎ লোনা। তার পরিমাণও বেশি নয়। জিভ দিয়ে চেটে খেতে হয় দেওয়ালের গা থেকে।

বাইরে অন্ধকার হয়েছে নিশ্চয়ই, সাড়ে সাতটা বাজলো। আটটা, নটা, দশটা। তখনো শঙ্কর পথ হাতড়াচ্ছে। টর্চের পুরনো ব্যাটারি জ্বলছে সমানে বেলা তিনটে থেকে, এইবার তা এত ক্ষীণ হয়ে এসেছে যে, শঙ্কর ভয়ে আরও উন্মাদের মতো হয়ে উঠল। এই আলো যতক্ষণ, তার প্রাণের ভরসাও ততক্ষণ। নতুবা এই নরকের মতো মহা অন্ধকারে পথ খুঁজে পাবার কোনো আশা নেই— স্বয়ং আলভারেজও পারতো না।

টর্চ নিভিয়ে ও চুপ করে একখানা পাথরের উপর বসে রইল। এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারতো যদি আলো থাকতো, কিন্তু এই অন্ধকারে সে কি করে এখন? একবার ভাবলে, রাত্রিটা কাটুক না, দেখা যাবে তখন। পরক্ষণেই মনে হল— তাতে আর এমন কি সুবিধে হবে? এখানে তো দিনরাত্রি সমান।

অন্ধকারেই সে দেওয়াল ধরে ধরে চলতে লাগল। হায়, হায়, কেন গুহায় ঢুকবার সময়ে দুটো নতুন ব্যাটারী সঙ্গে নেয়নি। অন্ততঃ একটা দেশলাই।

ঘড়ি হিসেবে সকাল হল। গুহার চির অন্ধকারে কিন্তু আলো জ্বললো না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শঙ্করের শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। বোধ হয়, এই গুহার অন্ধকারে ওর সমাধি অদৃষ্টে লেখা আছে, দিনের আলো আর তাকে দেখতে হবে না।

আলভারেজের বলি গ্রহণ করে আফ্রিকার রক্ততৃষ্ণা মেটেনি, তাকেও চাই।

তিন দিন তিন রাত্রি কেটে গেল। শঙ্কর জুতোর সুকতলা চিবিয়ে খেয়েছে, একটা আরশোলা কি ইঁদুর, কি কাঁকড়াবিছে— গুহার মধ্যে কোনো জীব নেই যে সে ধরে খায়। মাথা ক্রমশঃ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে আসছে, তার জ্ঞান নেই সে কি করছে বা তার কি ঘটবে— কেবল এইটুকু মাত্র জ্ঞান রয়েছে যে তাকে গুহা থেকে যে করে হোক বেরুতেই হবে, দিনের আলোর মুখ দেখতেই হবে। তাই সে অবসন্ন নির্জীব দেহেও অন্ধকার হাতড়ে হাতড়েই বেড়াচ্ছে, হয়তো মরণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এইরকম ভাবে হাতড়াবে।

একবার সে অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কতক্ষণ পরে সে জেগে উঠল তা সে জানে না। দিন, রাত্রি, ঘন্টা, ঘড়ি, দন্ড, পল মুছে গিয়েছে এই ঘোর অন্ধকারে। হয়তোবা তার চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েছে, কে জানে?

ঘুমোবার পর সে যেন একটু বল পেল। আবার উঠল, আবার চলল, আলভারেজের শিষ্য সে, নিশ্চেষ্টভাবে হাত-পা কোলে করে বসে কখনোই মরবে না। সে পথ খুঁজবে, খুঁজবে যতক্ষণ বেঁচে আছে…

আশ্চর্য, সে নদীটাই বা গেল কোথায়? গুহার মধ্যে গোলকধাঁধায় ঘুরবার সময় জলধারাটাকে সে কোথায় হারিয়ে ফেলেছে। নদী দেখতে পেলে হয়তো উদ্ধার পাওয়াও যেতে পারে, কারণ তার এক মুখ যেদিকেই থাক, অন্য মুখ আছে গুহার বাইরে। কিন্তু নদী তো দূরের কথা একটা অতি ক্ষীণ জলধারার সঙ্গেও আজ তিন দিন পরিচয় নেই। জল অভাবে শঙ্কর মরতে বসেছে। কষা, লোনা, বিস্বাদ জল চেটে-চেটে তার জিভ ফুলে উঠেছে, তৃষ্ণা তাতে বেড়েছে ছাড়া কমেনি।

পাথরের দেওয়াল হাতড়ে শঙ্কর খুঁজতে লাগল, ভিজে দেওয়ালের গায়ে কোথাও শেওলা জন্মেছে কিনা— খেয়ে প্রাণ বাঁচাবে। না, তাও নেই! পাথরের দেওয়াল সর্বত্র অনাবৃত, মাঝে মাঝে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের পাতলা সর পড়েছে, একটা ব্যাঙের ছাতা কি শেওলা জাতীয় উদ্ভিদও নেই। সূর্যের আলোর অভাবে উদ্ভিদ এখানে বাঁচতে পারে না।

আরও একদিন কেটে রাত এল। এত ঘোরাঘুরি করেও কিছু সুবিধে হচ্ছে বলে তো বোধ হয় না। ওর মনে হতাশা ঘনিয়ে এসেছে। সে কি আরও চলবে, কতক্ষণ চলবে? এতে কোনো ফল নেই, এ চলার শেষ নেই। কোথায় সে চলেছে এই গাঢ় নিকষ কালো অন্ধকারে এই ভয়ানক নিস্তব্ধতার মধ্যে! উঃ, কি ভয়ানক অন্ধকার, আর কি ভয়ানক নিস্তব্ধতা! পৃথিবী যেন মরে গিয়েছে, সৃষ্টিশেষের প্রলয়ে সোমসূর্য নিভে গিয়েছে, সেই মৃত পৃথিবীর জনহীন, শব্দহীন, সময়হীন শ্মশানে সে-ই একমাত্র প্রাণী বেঁচে আছে।

আর বেশিক্ষণ এ-রকম থাকলে সে ঠিক পাগল হয়ে যাবে।

একাদশ পরিচ্ছেদ

শঙ্কর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধ হয়, কিংবা হয়তো অজ্ঞান হয়েই পড়ে থাকবে। মোটের উপর যখন আবার জ্ঞান ফিরে এল তখন ঘড়িতে বারোটা— সম্ভবতঃ রাত বারোটাই হবে। ও উঠে আবার চলতে শুরু করলে। এক জায়গায় তার সামনে একটা পাথরের দেওয়াল পড়ল— তার রাস্তা যেন আটকে রেখেছে। টর্চের রাঙা আলো একটিবার মাত্র জ্বালিয়ে সে দেখল যে দেওয়াল ধরে সে এতক্ষণ যাচ্ছিল, তারই সঙ্গে সমকোণ করে এ দেওয়ালটা আড়াআড়ি ভাবে তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ সে কান খাড়া করলে… অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন ক্ষীণ জলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না…?

হ্যাঁ, ঠিক জলের শব্দই বটে, …কুলু-কুলু, কুলু-কুলু… ঝরনা ধারার শব্দ— যেন পাথরের নুড়ির ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে বেধে জল বইছে কোথাও। ভালো করে শুনে ওর মনে হল, জলের শব্দটা হচ্ছে এই পাথরের দেওয়ালের ওপারে। দেওয়ালে কান পেতে শুনে ওর ধারণা আরও বদ্ধমূল হল। দেওয়াল ফুঁড়ে যাবার উপযুক্ত ফাঁক আছে কিনা, টর্চের রাঙা আলোয় অনুসন্ধান করতে করতে এক জায়গায় খুব নিচু ও সংকীর্ণ প্রাকৃতিক রন্ধ্র দেখতে পেলে। সেখান দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অনেকটা গিয়ে হাতে জল ঠেকল। সন্তর্পণে উপরের দিকে হাত দিয়ে বুঝল, সেখানটাতে দাঁড়ানো যেতে পারে। দাঁড়িয়ে উঠে ঘন অন্ধকারের মধ্যে কয়েক পা যেতেই, স্রোতযুক্ত বরফের মতো ঠান্ডা জলে পায়ের পাতা ডুবে গেল…

ঘন অন্ধকারের মধ্যেই নিচু হয়ে ও প্রাণ ভরে ঠান্ডা জল পান করে নিলে। তারপর টর্চের ক্ষীণ আলোয় জলের স্রোতের গতি লক্ষ্য করলে। এ ধরনের নির্ঝরের স্রোতের উজানের দিকে গুহার মুখ সাধারণতঃ হয় না। টর্চ নিভিয়ে সেই মহা নিবিড় অন্ধকারে পায়ে পায়ে জলের ধারা অনুভব করতে করতে অনেকক্ষণ ধরে চললো। নির্ঝর চলেছে এঁকে বেঁকে, কখনো ডাইনে কখনো বাঁয়ে। এক জায়গায় সেটা তিন-চারটে ছোট বড় ধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়ে এদিক ওদিক চলে গিয়েছে, ওর মনে হল।

এখানে এসে শঙ্কর দিশেহারা হয়ে পড়ল। টর্চ জ্বেলে দেখল স্রোত নানামুখী। আলভারেজের কথা মনে পড়ল, পথে চিহ্ন রেখে না গেলে, এখানে আবার গোল পাকিয়ে যাবার সম্ভাবনা।

নিচু হয়ে চিহ্ন রেখে যাওয়ার উপযোগী কিছু খুঁজতে গিয়ে দেখলে, স্বচ্ছ নির্মল জলাধারের এপারে ওপারে দু’পারেই এক ধরনের পাথরের নুড়ি বিস্তর পড়ে আছে। সেই ধরনের পাথরের নুড়ির ওপর দিয়েও প্রধান জলধারা বয়ে চলেছে।

অনেকগুলি নুড়ি পকেটে নিয়ে, সে প্রত্যেক শাখা শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা করবে ভেবে, দুটো নুড়ি ধারার পাশে রাখতে রাখতে গেল। একটা স্রোত থেকে খানিকদূর গিয়ে আবার অনেকগুলো ফেক্‌ড়ি বেরিয়েছে। প্রত্যেক সংযোগস্থলে ও নুড়ি সাজিয়ে একটা ‘S’ অক্ষর তৈরি করে রাখলে।

অনেকগুলো স্রোতশাখা আবার ঘুরে শঙ্কর যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই যেন ঘুরে গেল। পথে চিহ্ন রেখে গিয়েও শঙ্করের মাথা গোলমাল হয়ে যাবার যোগাড় হল।

একবার তার পায়ে খুব ঠান্ডা কি ঠেকতেই, আলো জ্বেলে দেখলে, জলের ধারে এক প্রকান্ডকায় অজগর পাইথন কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। পাইথন ওর স্পর্শে আলস্য পরিত্যাগ করে মাথাটা উঠিয়ে কড়ির দানার মতো চোখে চাইতেই টর্চের আলোয় দিশেহারা হয়ে গেল— নতুবা শঙ্করের প্রাণ সংশয় হয়ে উঠতো। শঙ্কর জানে অজগর সাপ অতি ভয়ানক জন্তু— বাঘ সিংহের মুখ থেকেও হয়তো পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে, অজগর সাপের নাগপাশ থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব। একটি বার লেজ ছুঁড়ে পা জড়িয়ে ধরলে আর দেখতে হত না।

এবার অন্ধকারে চলতে ওর ভয়ানক ভয় করছিল। কি জানি, কোথায় আবার কোন পাইথন সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে আছে! দুটো-তিনটে স্রোতশাখা পরীক্ষা করে দেখবার পরে ও তার নিজের চিহ্নের সাহায্যে পুনরায় সংযোগস্থলে ফিরে এল। প্রধান সংযোগস্থলে ও নুড়ি দিয়ে একটি ক্রুশচিহ্ন করে রেখে গিয়েছিল। এবার ওরই মধ্যে যেটাকে প্রধান বলে মনে হল, সেটা ধরে চলতে গিয়ে দেখলে, সেও সোজামুখে যায়নি। কিছুদূর গিয়েই তারও নানা ফেক্‌ড়ি বেরিয়েছে। এক-এক জায়গায় গুহার ছাদ এত নিচু হয়ে নেমে এসেছে যে কুঁজো হয়ে, কোথাওবা মাজা দুমড়ে, অশীতিপর বৃদ্ধের ভঙ্গিতে চলতে হয়।

0 Shares