চাঁদের পাহাড়

হঠাৎ এক জায়গায় টর্চ জ্বেলে সেই অতি ক্ষীণ আলোতেও শঙ্কর বুঝতে পারলে, গুহাটা সেখানে ত্রিভূজাকৃতি— সেই ত্রিভূজ গুহা, যাকে খুঁজে বার না করতে পেরে মৃত্যুর দ্বার পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। একটু পরেই দেখলে বহুদূরে যেন অন্ধকারের ফ্রেমে আঁটা কয়েকটি নক্ষত্র জ্বলছে। গুহার মুখ! এবার আর ভয় নেই। এ-যাত্রার মতো সে বেঁচে গেল।

শঙ্কর যখন বাইরে এসে দাঁড়াল, তখন রাত তিনটে। সেখানটায় গাছপালা কিছু কম, মাথার উপর নক্ষত্রভরা আকাশ দেখা যায়। গুহার সেই মহা অন্ধকার থেকে বার হয়ে এসে রাত্রির নক্ষত্রালোকিত স্বচ্ছ অন্ধকার তার কাছে দীপালোকখচিত নগরপথের মতো মনে হল। প্রাণভরে সে ভগবানকে ধন্যবাদ দিল, এ অপ্রত্যাশিত মুক্তির জন্যে।

ভোর হল। সূর্যের আলো গাছের ডালে ফুটলো। শঙ্কর ভাবলে এ অমঙ্গলজনক স্থানে আর একদন্ডও সে থাকবে না। পকেটে একখানা পাথরের নুড়ি তখনো ছিল, ফেলে না দিয়ে গুহার বিপদের স্মারক স্বরূপ সেখানা সে কাছে রেখে দিলে।

পরদিন এলিফ্যান্ট ঘাস দেখা গেল বনের মধ্যে, সেদিনই সন্ধ্যার আগে অরণ্য শেষ হয়ে খোলা জায়গা দেখা দিল। রাত্রে শঙ্কর অনেকক্ষণ বসে ম্যাপ দেখলে। সামনে যে মুক্ত প্রান্তরবৎ দেশ পড়ল, এখান থেকে এটা প্রায় তিনশো মাইল বিস্তৃত, একেবারে জাম্বেসি নদীর তীর পর্যন্ত। এই তিনশো মাইলের খানিকটা পড়েছে বিখ্যাত কালাহারি মরুভূমির মধ্যে, প্রায় ১৭৫ মাইল, অতি ভীষণ, জনমানবহীন, জলহীন, পথহীন মরুভূমি। আলভারেজ মিলিটারি ম্যাপ থেকে নোট করেছে যে, এই অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব কোণ লক্ষ্য করে একটি বিশেষ পথ ধরে না গেলে, মাঝামাঝি পার হতে যাওয়ার মানেই মৃত্যু। ম্যাপে এর নাম দিয়েছে ‘তৃষ্ণার দেশ’ (Thirstland Trek)! রোডেসিয়া পৌঁছুতে পারলে যাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে উঠবে, কারণ সে-সব স্থানে মানুষ আছে।

শঙ্কর এখানে অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিলে। পথের এই ভয়ানক অবস্থা জেনে-শুনেও সে দমে গেল না, হাত-পা হারা হয়ে পড়ল না। এই পথে আলভারেজ একা গিয়ে সলস্‌বেরি থেকে টোটা ও খাবার কিনে আনবে বলেছিল। বাষট্টি বছরের বৃদ্ধ যা পারবে বলে স্থির করেছিল, সে তা থেকে পিছিয়ে যাবে?

কিন্তু সাহস ও নির্ভীকতা এক জিনিস, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। ম্যাপ দেখে গন্তব্যস্থানের দিক নির্ণয় করার ক্ষমতা শঙ্করের ছিল না। সে দেখলে ম্যাপের সে কিছুই বোঝে না। মিলিটারি ম্যাপগুলোতে দুটো মরুমধ্যস্থ কূপের জায়গায় ল্যাটিচিউড লঙ্গিচিউড দেওয়া আছে, ‘ম্যাগনেটিক নর্থ’ আর ‘ট্রু নর্থ’ ঘটিত কি একটা গোলমেলে অঙ্ক কষে বার করতো আলভারেজ, শঙ্কর দেখেছে কিন্তু শিখে নেয়নি।

সুতরাং অদৃষ্টের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর উপায় কি? অদৃষ্টের উপর নির্ভর করেই শঙ্কর এই দুস্তর মরুভূমিতে পাড়ি দিতে প্রস্তুত হল। ফলে, দু’দিন যেতে না যেতেই শঙ্কর সম্পূর্ণ দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ল। ম্যাপ দেখে যেকোন অভিজ্ঞ লোক যে জলাশয় চোখ বুজে বার করতে পারতো— শঙ্কর তার তিন মাইল উত্তর দিয়ে চলে গেল, অথচ তখন তার জল ফুরিয়ে এসেছে, নতুন পানীয় জল সংগ্রহ করে না নিলে জীবন বিপন্ন হবে।

প্রথমতঃ শুধু প্রান্তর আর পাহাড়, ক্যাকটাস ও ইউফোর্বিয়ার বন, মাঝে মাঝে গ্রানাইটের স্তূপ। তার পর কী ভীষণ কষ্টের সে পথ-চলা! খাবার নেই, জল নেই, পথ ঠিক নেই, মানুষের মুখ দেখা নেই। দিনের পর দিন শুধু সুদূর, শূন্য দিগ্বলয় লক্ষ্য করে সে হতাশ পথ-যাত্রা। মাথার উপর আগুনের মতো সূর্য, পায়ের নিচে বালি পাথর যেন জ্বলন্ত অঙ্গার। সূর্য উঠছে— অস্ত যাচ্ছে, নক্ষত্র উঠছে, চাঁদ উঠছে— আবার অস্ত যাচ্ছে। মরুভূমির গিরগিটি একঘেয়ে সুরে ডাকছে, ঝিঁঝি ডাকছে— সন্ধ্যায়, গভীর রাত্রে।

মাইল-লেখা পাথর নেই, কত মাইল অতিক্রম করা হল তার হিসেব নেই। খাদ্য দু-একটা পাখি, কখনোবা মরুভূমির বাজার্ড শকুনি, যার মাংস জঠুর ও বিস্বাদ। এমন-কি একদিন একটা পাহাড়ী বিষাক্ত কাঁকড়াবিছে, যার দংশনে মৃত্যু— তাও যেন পরম সুখাদ্য, মিললে মহা সৌভাগ্য।

দু’দিন ঘোর তৃষ্ণায় কষ্ট পাবার পরে পাহাড়ের ফাটলে একটা জলাশয় পাওয়া গেল। কিন্তু জলের চেহারা লাল, কতকগুলো কি পোকা ভাসছে জলে, ডাঙায় কি একটা জন্তু মরে পচে ঢোল হয়ে আছে। সেই জলই আকন্ঠ পান করে শঙ্কর প্রাণ বাঁচালে।

দিনের পর দিন কাটছে, মাস গেল, কি সপ্তাহ গেল, কি বছর গেল হিসেব নেই। শঙ্কর শুকিয়ে রোগা হয়ে গিয়েছে, কোথায় চলেছে তার কিছুই ঠিক নেই— শুধু সামনের দিকে যেতে হবে এই সে জানে। সামনের দিকেই ভারতবর্ষ— বাঙলা দেশ।

তারপর পড়ল আসল মরু, কালাহারি মরুভূমির এক অংশ। দূর থেকে তার চেহারা দেখে শঙ্কর ভয়ে শিউরে উঠল। মানুষ কি করে পার হতে পারে এই অগ্নিদগ্ধ প্রান্তর! শুধুই বালির পাহাড়, আর তাম্রাভ কটা বালির সমুদ্র। ধূ-ধূ করে যেন জ্বলছে দুপুরের রোদে। মরুভূমির কিনারে প্রথম দিনেই ছায়ায় ১২৭ ডিগ্রী উত্তাপ উঠল থার্মোমিটারে।

ম্যাপে বার বার লিখে দিয়েছে, উত্তর-পূর্ব কোণ ঘেঁষে ছাড়া কেউ এই মরুভূমি মাঝামাঝি পার হতে যাবে না। গেলেই মৃত্যু, কারণ সেখানে জল একদম নেই। জল যে উত্তর-পূর্ব ধারে আছে তাও নয়, তবে ত্রিশ মাইল, সত্তর মাইল ও নব্বুই মাইল ব্যবধানে তিনটি স্বাভাবিক উনুই আছে— যাতে জল পাওয়া যায়। ঐ উনুইগুলি প্রায়ই পাহাড়ের ফাটলে, খুঁজে বার করা বড়ই কঠিন। এই জন্যেই মিলিটারি ম্যাপে ওদের জায়গার অক্ষ ও দ্রাঘিমা দেওয়া আছে।

শঙ্কর ভাবলে, ওসব বার করতে পারবো না। সেক্সট্যান্ট আছে, নক্ষত্রের চার্ট আছে, কিন্তু তাদের ব্যবহার সে জানে না। যা হয় হবে, ভগবান ভরসা। তবে যতদূর সম্ভব উত্তর-পূর্ব কোণ ঘেঁষে যাবার চেষ্টা সে করবে।

তৃতীয় দিনে নিতান্ত দৈববলে সে একটা উনুই দেখতে পেল। জল কাদাগোলা, আগুনের মতো গরম, কিন্তু তাই তখন অমৃতের মতো দুর্লভ। মরুভূমি ক্রমে ঘোরতর হয়ে উঠল। কোনো প্রকার জীবের বা উদ্ভিদের চিহ্ন ক্রমশঃ লুপ্ত হয়ে গেল। আগে রাত্রে আলো জ্বাললে দু-একটা কীটপতঙ্গ আকৃষ্ট হয়ে আসতো, ক্রমে তাও আর আসে না।

দিনে উত্তাপ যেমন ভীষণ, রাতে তেমনি শীত। শেষ রাত্রে শীতে হাত-পা জমে যায় এমন অবস্থা, অথচ ক্রমশঃ আগুন জ্বালবার উপায় শেষ হয়ে গেল, কারণ জ্বালানি কাঠ আর একেবারেই নেই। কয়েক দিনের মধ্যে সঞ্চিত জলও গেল ফুরিয়ে। সেই সুবিস্তীর্ণ বালুকাসমুদ্রে, একটি পরিচিত বালুকণা খুঁজে বার করা যতদূর অসম্ভব, তার চেয়েও অসম্ভব ক্ষুদ্র হাত-দুই পরিধির এক জলের উনুই বার করা।

সেদিন সন্ধ্যার সময় তৃষ্ণার কষ্টে শঙ্কর উন্মত্তপ্রায় হয়ে উঠল। এতক্ষণে শঙ্কর বুঝেছে, এ ভীষণ মরুভূমি একা পার হওয়ার চেষ্টা করা আত্মহত্যার শামিল। সে এমন জায়গায় এসে পড়েছে, যেখান থেকে ফেরবার উপায়ও নেই।

একটা উঁচু বালিয়াড়ির উপর উঠে সে দেখলে, চারধারে শুধুই কটা বালির পাহাড়, পূর্বদিকে ক্রমশঃ উঁচু হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমে সূর্য ডুবে গেলেও সারা আকাশ সূর্যাস্তের আভায় লাল। কিছুদূরে একটা ছোট ঢিবির মতো পাহাড় এবং দূর থেকে মনে হল একটা গুহাও আছে। এ ধরনের গ্রানাইটের ছোট ঢিবি এদেশে সর্বত্র, ট্রান্সভাল ও রোডেসিয়ায় এদের নাম ‘Kopje’ অর্থাত্‍ ক্ষুদ্র পাহাড়। রাত্রে শীতের হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে শঙ্কর সেই গুহায় আশ্রয় নিলে।

এইখানে এক ব্যাপার ঘটল।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

গুহার মধ্যে ঢুকে শঙ্কর টর্চ জ্বেলে দেখলে (নতুন ব্যাটারী তার কাছে তখনো ডজন দুই ছিল) গুহাটা ছোট, বেশ একটা ছোটখাটো ঘরের মতো, মেঝেটাতে অসংখ্য ছোট ছোট পাথর ছড়ানো। গুহার এক কোণে চোখ পড়তেই শঙ্কর অবাক হয়ে গেল। একটা ছোট্ট কাঠের পিঁপে! এখানে কি করে এল কাঠের পিঁপে?

দু-পা এগিয়েই সে চমকে উঠল।

গুহার দেয়ালের ধার ঘেঁষে শায়িত অবস্থায় একটা সাদা নরকঙ্কাল, তার মুন্ডুটা দেয়ালের দিকে ফেরানো। কঙ্কালের আশেপাশে কালো কালো থলে ছেঁড়ার মতো জিনিস, বোধহয় সেগুলো পশমের কোটের অংশ। দু’খানা বুট জুতো কঙ্কালের পায়ে তখনো লাগানো। একপাশে একটা মরচে পড়া বন্দুক।

0 Shares