চাঁদের পাহাড়

স্তুত হোন প্রভূ মোর, পবন সঞ্চার তরে, স্থির বায়ু তরে,

ভগিনী মেদিনী তরে, নীল মেঘ তরে, আকাশের তরে,

তারকা সমূহ তরে, সুদিন কুদিন তরে, দেহের মরণ তরে।

আর একটা কথা। আমার দুই পায়ে জুতোর মধ্যে পাঁচখানা বড় হীরে লুকানো আছে। তোমায় তা দিলাম, হে অজানা পথিক বন্ধু। আমার শেষ অনুরোধটি ভুলো না। জননী মেরী তোমার মঙ্গল করুন।কম্যান্ডার আত্তিলিও গাত্তি

১৮৮০ সাল। সম্ভবতঃ মার্চ মাস।”হতভাগ্য যুবক!

তার মৃত্যুর পরে সুদীর্ঘ তিরিশ বছর কেটে গিয়েছে, এই তিরিশ বছরের মধ্যে এ পথে হয়তো কেউ যায়নি, গেলেও গুহাটার মধ্যে ঢোকেনি। এতকাল পরে তার চিঠিখানা মানুষের হাতে পড়ল।

আশ্চর্য যে কাঠের পিঁপেটাতে তিরিশ বছর পরেও জল ছিল কি করে?

কিন্তু কাগজখানা পড়েই শঙ্করের মনে হল, এই লেখায় বর্ণিত ঐটেই সেই গুহা— সে নিজে যেখানে পথ হারিয়ে মারা যেতে বসেছিল! তারপর সে কৌতূহলের সঙ্গে কঙ্কালের পায়ের জুতো টান দিয়ে খসাতেই পাঁচখানা বড় বড় পাথর বেরিয়ে পড়ল। এ অবিকল সেই পাথরের নুড়ির মতো, যা এক পকেট কুড়িয়ে অন্ধকার গুহার মধ্যে সে পথ চিহ্ন করেছিল এবং যার একখানা তার কাছে রয়েছে। এ পাথরের নুড়ি তো সে রাশি রাশি দেখেছে গুহার মধ্যে সেই অন্ধকারময়ী নদীর জলস্রোতের নিচে, তার দুই তীরে! কে জানতো যে হীরের খনি খুঁজতে সে ও আলভারেজ সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসে ছ’মাস ধরে রিখটারসভেল্ড পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে হয়রান হয়ে গিয়েছে— এমন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে সে সেখানে গিয়ে পড়বে! হীরে যে এমন রাশি রাশি পড়ে থাকে পাথরের নুড়ির মতো— তাই বা কে ভেবেছিল! আগে এসব জানা থাকলে, পাথরের নুড়ি সে দু-পকেট ভরে কুড়িয়ে বাইরে নিয়ে আসতো!

কিন্তু তার চেয়েও খারাপ কাজ হয়ে গিয়েছে যে, সে রত্নখনির গুহা যে কোথায়, কোনদিকে, তার কোনো নক্সা সে করে আনেনি বা সেখানে কোনো চিহ্ন রেখে আসেনি, যাতে আবার সেটা খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। সেই সুবিস্তীর্ণ পর্বত ও আরণ্য অঞ্চলের কোন জায়গায় সেই গুহাটা দৈবাৎ সে দেখেছিল, তা কি তার ঠিক আছে, না ভবিষ্যতে সে আবার সে জায়গা বার করতে পারবে? এ যুবকও তো কোনো নক্সা করেনি, কিন্তু সাংঘাতিক আহত হয়েছিল রত্নখনি আবিষ্কার করার পরেই, এর ভুল হওয়া খুব স্বাভাবিক। হয়তো এ যা বার করতে পারতো নক্সা না দেখে— সে তা পারবে না।

হঠাৎ আলভারেজের মৃত্যুর পূর্বের কথা শঙ্করের মনে পড়ল। সে বলেছিল— চল যাই, শঙ্কর, গুহার মধ্যে রাজার ভান্ডার লুকোনো আছে! তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আমি দেখতে পাচ্ছি।

শঙ্কর গুহার মধ্যেই সেই নরকঙ্কালটা সমাধিস্থ করলে। পিঁপেটা ভেঙে ফেলে তারই দু’খানা কাঠে মরচে পড়া পেরেক ঠুকে ক্রুশ তৈরি করলে ও সমাধির ওপর সেই ক্রুশটা পুঁতলে। এ ছাড়া খৃস্টধর্মাচারীকে সমাধিস্থ করবার অন্য কোনো রীতি তার জানা নেই। তারপরে সে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলে, এই মৃত যুবকের আত্মার শান্তির জন্য।

এসব শেষ করতে সারাদিনটা কেটে গেল। রাত্রে বিশ্রাম করে পরদিন আবার সে রওনা হল। কঙ্কালের চিঠিখানা ও হীরেগুলি যত্ন করে সঙ্গে নিল।

তবে তার মনে হল, এই অভিশপ্ত হীরের খনির সন্ধানে যে গিয়েছে, সে আর ফেরেনি। আত্তিলিও গাত্তি ও তার সঙ্গীরা মরেছে, জিম কার্টার মরেছে, আলভারেজ মরেছে। এর আগেই বা কত লোক মরেছে তার ঠিক কি? এইবার তার পালা। এই মরুভূমিতেই তার শেষ, এই বীর ইটালিয়ান যুবকের মতো।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

দুপুরের রোদে যখন দিক-দিগন্তে আগুন জ্বলে উঠল, একটা ছোট্ট পাথরের ঢিবির আড়ালে শঙ্কর আশ্রয় নিলে। ১৩৫ ডিগ্রী উত্তাপ উঠেছে তাপমান যন্ত্রে, রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে এ উত্তাপে পথ হাঁটা চলে না। যদি যে কোনো রকমে এ ভয়ানক মরুভূমির হাত এড়াতে পারতো, তবে হয়তো জীবন্ত অবস্থায় মানুষের আবাসে পৌঁছুতেও পারতো। সে ভয় করে শুধু এই মরুভূমি, সে জানে কালাহারি মরু বড় বড় সিংহের বিচরণভূমি। তার হাতে রাইফেল আছে— রাতদুপুরেও একা যত বড় সিংহই হোক, সম্মুখীন হতে সে ভয় করে না— কিন্তু ভয় হয় তৃষ্ণা রাক্ষসীকে। তার হাত থেকে পরিত্রাণ নেই। দুপুরে সে দু’বার মরীচিকা দেখলে। এতদিন মরুপথে আসতেও এ আশ্চর্য নৈসর্গিক দৃশ্য সে দেখেনি, বইয়েই পড়েছিল মরীচিকার কথা। একবার উত্তর-পূর্ব কোণে, একবার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, দুই মরীচিকাই কিন্তু প্রায় এক রকম— অর্থাত্‍ একটা বড় গম্বুজওয়ালা মসজিদ বা গির্জা, চারপাশে খেজুরকুঞ্জ, সামনে বিস্তৃত জলাশয়। উত্তর-পূর্ব কোণের মরীচিকাটা বেশি স্পষ্ট।

সন্ধ্যার দিকে দূরদিগন্তে মেঘমালার মতো পর্বতমালা দেখা গেল। শঙ্কর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলে না। পূর্বদিকে একটাই মাত্র বড় পর্বত এখান থেকে দেখতে পাওয়া সম্ভব, দক্ষিণ রোডেসিয়ার প্রান্তবর্তী চিমানিমানি পর্বতমালা। তাহলে কি বুঝতে হবে যে, সে বিশাল কালাহারি পদব্রজে পার হয়ে প্রায় শেষ করতে চলেছে? না এ-ও মরীচিকা?

কিন্তু রাত দশটা পর্যন্ত পথ চলেও জ্যোত্‍স্নারাত্রে সে দূর পর্বতের সীমারেখা তেমনি স্পষ্ট দেখতে পেল। অসংখ্য ধন্যবাদ হে ভগবান, মরীচিকা নয় তবে। জ্যোত্‍স্নারাত্রে কেউ কখনো মরীচিকা দেখেনি।

তবে কি প্রাণের আশা আছে? আজ পৃথিবীর বৃহত্তম রত্নখনির মালিক সে। নিজের পরিশ্রমে ও দুঃসাহসের বলে সে তার স্বত্ব অর্জন করেছে। দরিদ্র বাঙলা মায়ের বুকে সে যদি আজ বেঁচে ফেরে!

দু’দিনের দিন বিকেলে সে এসে পর্বতের নিচে পৌঁছুলো।

তখন সে দেখলে, পর্বত পার হওয়া ছাড়া ওপারে যাওয়ার কোনো সহজ উপায় নেই। নইলে পঁচিশ মাইল মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পর্বতের দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে আসতে হবে। মরুভূমির মধ্যে সে আর কিছুতেই যেতে রাজি নয়। সে পাহাড় পার হয়েই যাবে।

এইখানে সে প্রকান্ড একটা ভুল করলে। সে ভুলে গেল যে সাড়ে বারো হাজার ফুট একটা পর্বতমালা ডিঙিয়ে ওপারে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। রিখটারসভেল্ড পার হওয়ার মতোই শক্ত। তার চেয়েও শক্ত, কারণ সেখানে আলভারেজ ছিল। এখানে সে একা।

শঙ্কর ব্যাপারের গুরুত্বটা তেমন বুঝতে পারলে না, ফলে চিমানিমানি পর্বত উত্তীর্ণ হতে গিয়ে প্রাণ হারাতে বসলো, ভীষণ প্রজ্বলন্ত কালাহারি পার হতে গিয়েও সে এমন ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন হয়নি।

চিমানিমানি পর্বতে জঙ্গল খুব বেশি ঘন নয়। শঙ্কর প্রথম দিন অনেকটা উঠল— তারপর একটা জায়গায় গিয়ে পড়ল, সেখান থেকে কোনো দিকে যাবার উপায় নেই। কোন পথটা দিয়ে উঠেছিল, সেটাও আর খুঁজে পেলে না— তার মনে হল, সে সমতলভূমির যে জায়গা দিয়ে উঠেছিল, তার তিরিশ ডিগ্রী দক্ষিণে চলে এসেছে। কেন যে এমন হল, এর কারণ কিছুতেই সে বার করতে পারলে না। কোথা দিয়ে কোথায় চলে গেল, কখনো উঠছে, কখনো নামছে, সূর্য দেখে দিক ঠিক করে নিচ্ছে, কিন্তু সাত আট মাইল পাহাড় উত্তীর্ণ হতে এতদিন লাগছে কেন?

তৃতীয় দিনে আর একটা নতুন বিপদ ঘটল। তার আগের দিন একখানা আলগা পাথর গড়িয়ে তার পায়ে চোট লেগেছিল। তখন তত কিছু হয়নি, পরদিন সকালে আর সে শয্যা ছেড়ে উঠতে পারে না। হাঁটু ফুলেছে, বেদনাও খুব। দুর্গম পথে নামা-ওঠা করা এ অবস্থায় অসম্ভব। পাহাড়ের একটা ঝরনা থেকে ওঠবার সময় জল সংগ্রহ করে এনেছিল, তাই একটু একটু করে খেয়ে চালাচ্ছে। পায়ের বেদনা কমে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। বেশি দূর যাওয়া চলবে না। সামান্য একটু-আধটু চলাফেরা করতেই হবে খাদ্য ও জলের চেষ্টায়, ভাগ্যে পাহাড়ের এই স্থানটা যেন খানিকটা সমতলভূমির মতো, তাই রক্ষে।

এইসব অবস্থায়, এই মনুষ্যবাসহীন পাহাড়ে বিপদ তো পদে পদেই। একা এ পাহাড় টপকাতে গেলে যে কোনো ইউরোপীয় পর্যটকেরও ঠিক এইরকম বিপদ ঘটতে পারতো।

শঙ্কর আর পারে না। ওর হৃত্‍‌পিন্ডে কি একটা রোগ হয়েছে, একটু হাঁটলেই ধড়াস ধড়াস করে হৃত্‍‌পিন্ডটা পাঁজরায় ধাক্কা মারে। অমানুষিক পথশ্রমে, দুর্ভাবনায়, অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে, কখনোবা অনাহারের কষ্টে, ওর শরীরে কিছু নেই।

0 Shares