চাঁদের পাহাড়

চারদিনের দিন সন্ধ্যাবেলা অবসন্ন দেহে সে একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিলে। খাদ্য নেই গতকাল থেকে। রাইফেল সঙ্গে আছে, কিন্তু একটা বন্য জন্তুর দেখা নেই। দুপুরে একটা হরিণকে চরতে দেখে ভরসা হয়েছিল, কিন্তু রাইফেলটা তখন ছিল পঞ্চাশ গজ তফাতে একটা গাছে ঠেস দেওয়া, আনতে গিয়ে হরিণটা পালিয়ে গেল। জল খুব সামান্যই আছে চামড়ার বোতলে। এ অবস্থায় নেমে সে ঝরনা থেকে জল আনবেই বা কি করে? হাঁটুটা আরও ফুলেছে। বেদনা এত বেশি যে একটু চলাফেরা করলেই মাথার শিরা পর্যন্ত ছিঁড়ে পড়ে যন্ত্রণায়।

পরিষ্কার আকাশতলে জলকণাশূন্য বায়ুমন্ডলের গুণে অনেকদূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দিকচক্রবালে মেঘলা করে ঘিরেছে নীল পর্বতমালা দূরে দূরে। দক্ষিণ-পশ্চিমে দিগন্তবিস্তীর্ণ কালাহারি। দক্ষিণে ওয়াহকুক পর্বত, তারও অনেক পিছনে মেঘের মতো দেখা যায় পল ক্রুগার পর্বতমালা। সলস্‌বেরির দিকে কিছু দেখা যায় না, চিমানিমানি পর্বতের এক উচ্চতর শৃঙ্গ সেদিকে দৃষ্টি আটকেছে।

আজ দুপুর থেকে ওর মাথার উপর শকুনির দল উড়ছে। এতদিন এত বিপদেও শঙ্করের যা হয়নি, আজ শকুনির দল মাথার উপর উড়তে দেখে সত্যিই ওর ভয় হয়েছে। ওরা তাহলে কি বুঝেছে যে শিকার জুটবার বেশি দেরি নেই?

সন্ধ্যার কিছু পরে কি একটা শব্দ শুনে চেয়ে দেখলে, পাশেই এক শিলাখন্ডের আড়ালে একটা ধূসর রঙের নেকড়ে বাঘ— নেকড়ের লম্বা ছুঁচালো কান দুটো খাড়া হয়ে আছে, সাদা সাদা দাঁতের উপর দিয়ে রাঙা জিভটা অনেকখানি বার হয়ে লকলক করছে। চোখে চোখ পড়তেই সেটা চট করে পাথরের আড়াল থেকে সরে দূরে পালাল।

নেকড়ে বাঘটাও তাহলে কি বুঝেছে? পশুরা নাকি আগে থেকে অনেক কথা জানতে পারে।

হাড়ভাঙা শীত পড়ল রাত্রে। ও কিছু কাঠকুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বাললে। অগ্নিকুন্ডের আলো যতটুকু পড়েছে তার বাইরে ঘন অন্ধকার।

কি একটা জন্তু এসে অগ্নিকুন্ড থেকে কিছুদূরে অন্ধকারে দেহ মিশিয়ে চুপ করে বসল। কোয়োট, বন্যকুকুর জাতীয় জন্তু। ক্রমে আর একটা, আর দুটো, আর তিনটে। রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে দশ-পনেরোটা এসে জমা হল। অন্ধকারে তার চারধার ঘিরে নিঃশব্দে অসীম ধৈর্য্যের সাথে যেন কিসের প্রতীক্ষা করছে।

কি সব অমঙ্গলজনক দৃশ্য!

ভয়ে ওর গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। সত্যিই কি এতদিনে তারও মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে? সে-ও পারলে না রিখটারসভেল্ড থেকে হীরে নিয়ে পালিয়ে যেতে।

উঃ, আজ কত টাকার মালিক সে। হীরের খনি বাদ যাক, তার সঙ্গে যে ছ’খানা হীরে রয়েছে, তার দাম অন্ততঃ দু-তিন লক্ষ টাকা নিশ্চয়ই হবে। তার গরিব গ্রামে, গরিব বাপ মায়ের বাড়ি যদি সে এই টাকা নিয়ে গিয়ে উঠতে পারতো… কত গরিবের চোখের জল মুছিয়ে দিতে পারতো, গ্রামের কত দরিদ্র কুমারীকে বিবাহের যৌতুক দিয়ে ভালো পাত্রে বিবাহ দিতো, কত সহায়হীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার শেষ ক’টা দিন নিশ্চিন্ত করে তুলতে পারতো…

কিন্তু যা হবার নয়, কি হবে সে সব ভেবে? তার চেয়ে এই অপূর্ব রাত্রির নক্ষত্রালোকিত আকাশের শোভা, এই বিশাল পর্বত ও মরুভূমির নিস্তব্ধ গম্ভীর রূপ, মৃত্যুর আগে সেও চোখ ভরে দেখতে চায়, সেই ইটালিয়ান যুবক গাত্তির মতো। ওরা যে অদৃষ্টের এক অদৃশ্য তারে গাঁথা সবাই— আত্তিলিও গাত্তি ও তার সঙ্গীরা, জিম কার্টার, আলভারেজ, শঙ্কর।

রাত গভীর হয়েছে। কি ভীষণ শীত! একবার সে চেয়ে দেখলে, কোয়োটগুলো এরি মধ্যে কখন আরও কাছে সরে এসেছে। অন্ধকারের মধ্যে আলো পড়ে তাদের চোখগুলো জ্বলছে। শঙ্কর একখানা জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারতেই ওরা সব দূরে সরে গেল, কিন্তু কি নিঃশব্দ ওদের গতিবিধি আর কি অসীম তাদের ধৈর্য। শঙ্করের মনে হল, এরা জানে শিকার ওদের হাতের মুঠোয়, হাতছাড়া হবার কোনো উপায় নেই।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যাবেলার সেই ধূসর নেকড়ে বাঘটাও দু-দুবার এসে অন্ধকারে কোয়োটদের পিছনে বসে দেখে গিয়েছে।

একটুও ঘুমুতে ভরসা হল না ওর। কি জানি, কোয়োট আর নেকড়ের দল হয়তো তাহলে জীবন্তই তাকে ছিঁড়ে খাবে মৃত মনে করে। অবসন্ন, ক্লান্ত দেহে জেগেই বসে থাকতে হবে তাকে। ঘুমে চোখ ঢুলে আসলেও উপায় নেই। মাঝে মাঝে কোয়োটগুলো এগিয়ে এসে বসে, ও জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে মারতেই সরে যায়। দু-একটা হায়েনাও এসে ওদের দলে যোগ দিয়েছে, হায়েনাদের চোখগুলো অন্ধকারে কি ভীষণ জ্বলে!

কি ভয়ানক অবস্থাতে পড়েছে সে! জনবিরল বর্বর দেশের জনশূন্য পর্বতের সাড়ে তিন হাজার ফুট ওপরে সে চলৎশক্তিহীন অবস্থায় বসে… গভীর রাত, ঘোর অন্ধকার… সামান্য আগুন জ্বলছে। মাথার উপর জলকণাশূন্য স্তব্ধ বায়ুমন্ডলের গুণে আকাশের অগণ্য তারা জ্বলজ্বল করছে যেন ইলেকট্রিক আলোর মতো… নিচে তার চারধার ঘিরে অন্ধকারে মাংসলোলুপ নীরব নেকড়ে, কোয়োট, হায়েনার দল।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার এটাও মনে হল, বাঙলার পাড়াগাঁয়ে ম্যালেরিয়ায় ধুঁকে সে মরছে না। এ মৃত্যু বীরের মৃত্যু! পদব্রজে কালাহারি মরুভূমি পার হয়েছে সে— একা। মরে গিয়ে চিমানিমানি পর্বতের শিলায় নাম খুদে রেখে যাবে। সে একজন বিশিষ্ট ভ্রমণকারী ও আবিষ্কারক। অত বড় হীরের খনি সেই তো খুঁজে বার করেছে! আলভারেজ মারা যাওয়ার পরে সেই বিশাল অরণ্য ও পার্বত্য অঞ্চলের গোলকধাঁধা থেকে সে তো একাই বার হতে পেরে এতদূর এসেছে! এখন সে নিরুপায়, অসুস্থ, চলত্‍শক্তি রহিত। তবুও সে যুঝছে, ভয় তো পায়নি, সাহস তো হারায়নি। কাপুরুষ, ভীতু নয় সে। জীবন-মৃত্যু তো অদৃষ্টের খেলা। না বাঁচলে তার দোষ কি?

দীর্ঘ রাত্রি কেটে গিয়ে পুবদিক ফরসা হল। সঙ্গে সঙ্গে বন্য জন্তুর দল কোথায় পালাল। বেলা বাড়ছে, আবার নির্মম সূর্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে শুরু করেছে দিকবিদিক। সঙ্গে সঙ্গে শকুনির দল কোথা থেকে এসে হাজির। কেউ মাথার উপর ঘুরছে, কেউ বা দূরে গাছের ডাল কি পাথরের ওপরে বসে খুব ধীরভাবে প্রতীক্ষা করছে। ওরা যেন বলছে— কোথায় যাবে বাছাধন? যে কদিন লাফালাফি করবে, করে নাও। আমরা বসি, এমন কিছু তাড়াতাড়ি নেই আমাদের।

শঙ্করের খিদে নেই। খাবার ইচ্ছেও নেই। তবুও সে গুলি করে একটা শকুনি মারলে। রোদ ভীষণ চড়েছে, আগুন-তাতা পাথরের গায়ে পা রাখা যায় না। এ পর্বতও মরুভূমির সামিল, খাদ্য এখানে মেলে না, জলও না। সে মরা শকুনিটা নিয়ে এসে আগুন জ্বেলে ঝলসাতে বসল। এর আগে মরুভূমির মধ্যেও সে শকুনির মাংস খেয়েছে। এরাই এখন প্রাণ ধারণের একমাত্র উপায়, আজ ও খাচ্ছে ওদের, কাল ওরা খাবে ওকে। শকুনিগুলো এসে আবার মাথার উপর জুটেছে।

তার নিজের ছায়া পড়েছে পাথরের গায়ে, সে নির্জন স্থানে শঙ্করের উদ্ভ্রান্ত মনে ছায়াটা যেন একজন সঙ্গী মনে হল। বোধহয়, ওর মাথা খারাপ হয়ে আসছে। কারণ বেঘোর অবস্থায়, ও কতবার নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলতে লাগল, কতবার পরক্ষণের সচেতন মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝে নিজেকে সামলে নিল।

সে পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? জ্বর হয়নি তো? তার মাথার মধ্যে ক্রমশঃ গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সব। আলভারেজ… হীরের খনি… পাহাড়, পাহাড়, বালির সমুদ্র… আত্তিলিও গাত্তি। কাল রাত্রে ঘুম হয়নি … আবার রাত আসছে, সে একটু ঘুমিয়ে নেবে।

কিসের শব্দে ওর তন্দ্রা ছুটে গেল। একটা অদ্ভুত ধরনের শব্দ আসছে কোনদিক থেকে। কোনো পরিচিত শব্দের মতো নয়। কিসের শব্দ? কোনদিক থেকে শব্দটা আসছে তাও বোঝা যায় না। কিন্তু ক্রমশঃ কাছে আসছে সেটা।

হঠাৎ আকাশের দিকে শঙ্করের চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তার মাথার উপর দিয়ে বিকট শব্দ করে কী একটা জিনিস যাচ্ছে। ওই কি এরোপ্লেন? সে বইয়ে ছবি দেখেছে বটে।

এরোপ্লেন যখন ঠিক মাথার উপর এল, শঙ্কর চিৎকার করলে, কাপড় ওড়ালে, গাছের ডাল ভেঙে নাড়লে, কিন্তু কিছুতেই পাইলটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে না। দেখতে দেখতে এরোপ্লেনখানা সুদূর ভায়োলেট রঙের পল ক্রুগার পর্বতমালার মাথার উপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

হয়তো আরও এরোপ্লেন যাবে এ পথ দিয়ে। কী আশ্চর্য দেখতে এই এরোপ্লেন জিনিসটা। ভারতবর্ষে থাকতে সে একখানাও দেখেনি।

শঙ্কর ভাবলে আগুন জ্বালিয়ে কাঁচা ডাল পাতা দিয়ে সে যথেষ্ট ধোঁয়া করবে। যদি আবার এ পথে যায়, পাইলটের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে ধোঁয়া দেখে। একটা সুবিধে হয়েছে, এরোপ্লেনের ঐ বিকট আওয়াজে শকুনির দল কোনদিকে ভেগেছে যেন।

0 Shares