চাঁদের পাহাড়

সেদিন কাটল। দিন কেটে রাত্রি হবার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের দুর্ভোগ শুরু হল। আবার গত রাত্রির পুনরাবৃত্তি। সেই কোয়োটের দল আবার এল। আগুনের চারধারে তারা আবার তাকে ঘিরে বসল। নেকড়ে বাঘটা সন্ধ্যা না হতেই দূর থেকে একবার দেখে গেল। গভীর রাত্রে আর একবার এল।

কিসে এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। আওয়াজ করতে ভরসা হয় না— টোটা মাত্র দুটি বাকি। টোটা ফুরিয়ে গেলে তাকে অনাহারে মরতে হবে। মরতে তো হবেই, তার দু’দিন আগে আর পরে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

কিন্তু আওয়াজ তাকে করতেই হল। গভীর রাত্রে হায়েনাগুলো এসে কোয়োটদের সাহস বাড়িয়ে দিল। পোড়া কাঠ ছুঁড়ে মারলে আর ভয় পায় না।

একবার একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল— বসে বসেই ঢুলে পড়েছিল। পরমুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠে দেখলে, নেকড়ে বাঘটা অন্ধকার থেকে পা টিপে টিপে তার অত্যন্ত কাছে এসে পড়েছে। ওর ভয় হল, হয়তো ওটা ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভয়ের চোটে একবার গুলি ছুঁড়লে।

আরেকবার শেষ রাতের দিকে ঠিক এ রকমই হল। কোয়োটগুলোর ধৈর্য অসীম, সেগুলো চুপ করে বসে থাকে মাত্র, কিছু বলে না! কিন্তু নেকড়ে বাঘটা ফাঁক খুঁজছে।

রাত ফরসা হবার সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্নের মতো অন্তর্হিত হয়ে গেল কোয়োট, হায়েনা ও নেকড়ের দল। সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করও আগুনের ধারে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।

একটা কিসের শব্দে শঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল।

খানিকটা আগে খুব বড় একটা আওয়াজ হয়েছে কোনো কিছুর। শঙ্করের কানে তার রেশ এখনো লেগে আছে।

কেউ কি বন্দুকের আওয়াজ করেছে? কিন্তু তা অসম্ভব, এই দুর্গম পর্বতের পথে কোন মানুষ আসবে?

একটি মাত্র টোটা অবশিষ্ট আছে। শঙ্কর ভাগ্যের উপর নির্ভর করে, সেটা খরচ করে একটা আওয়াজ করলে। যা থাকে কপালে, মরেছেই তো। উত্তরে দু’বার বন্দুকের আওয়াজ হল।

আনন্দে ও উত্তেজনায় শঙ্কর ভুলে গেল যে তার পা খোঁড়া, ভুলে গেল যে একটানা বেশিদূর সে যেতে পারে না। তার আর টোটা নেই, সে আর বন্দুকের আওয়াজ করতে পারলে না কিন্তু প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল। গাছের ডাল ভেঙে নাড়তে লাগল, আগুন জ্বালবার কাঠকুটোর সন্ধানে চারিদিকে আকুল দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে লাগল।ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক জরিপ করবার দল, কিম্বার্লি থেকে কেপটাউন যাবার পথে, চিমানিমানি পর্বতের নিচে কালাহারি মরুভূমির উত্তর-পূর্ব কোণে তাঁবু ফেলেছিল। সঙ্গে সাতখানা ডবল টায়ার ক্যাটারপিলার চাকা বসানো মোটর গাড়ি, এদের দলে নিগ্রো কুলি ও চাকর-বাকর বাদে ন’জন ইউরোপীয়। জন চারেক হরিণ শিকার করতে উঠেছিল চিমানিমানি পর্বতের প্রথম ও নিম্নতম থাকটাতে।

হঠাৎ এ জনহীন অরণ্যপ্রদেশে সভ্য রাইফেলের আওয়াজ শুনে ওরা বিস্মিত হয়ে উঠল। কিন্তু পুনরায় ওদের আওয়াজের প্রত্যুত্তর না পেয়ে ইতস্ততঃ খুঁজতে বেরিয়ে দেখতে পেলে, সামনে একটা অপেক্ষাকৃত উচ্চতর চূড়া থেকে, এক জীর্ণ ও কঙ্কালসার কোটরগতচক্ষু প্রেতমূর্তি উন্মাদের মতো হাত-পা নেড়ে তাদের কি বোঝাবার চেষ্টা করছে। তার পরনে ছিন্নভিন্ন অতি মলিন ইউরোপীয় পরিচ্ছদ।

ওরা ছুটে গেল। শঙ্কর আবোল-তাবোল কি বকল, ওরা ভালো বুঝতে পারলে না। যত্ন করে নামিয়ে পাহাড়ের নিচে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল। ওর জিনিসপত্র নামিয়ে আনা হয়েছিল। ওকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল।

কিন্তু এই ধাক্কায় শঙ্করকে বেশ ভুগতে হল। ক্রমাগত অনাহারে, কষ্টে, উদ্বেগে, অখাদ্য-কুখাদ্য গ্রহণের ফলে, তার শরীর খুব যখম হয়েছিল, সেই রাত্রেই তার বেজায় জ্বর এল।

জ্বরে সে অঘোর অচৈতন্য হয়ে পড়ল, কখন যে মোটর গাড়ি ওখান থেকে ছাড়ল, কখন যে তারা সলস্‌বেরিতে পৌঁছল, শঙ্করের কিছুই খেয়াল নেই। সেই অবস্থায় পনেরো দিন সে সলস্‌বেরির হাসপাতালে কাটিয়ে দিল। তারপর ক্রমশঃ সুস্থ হয়ে, মাসখানেক পরে একদিন সকালে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরের রাজপথে এসে দাঁড়াল।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

সলস্‌বেরি! কত দিনের স্বপ্ন!

আজ সে সত্যিই বড় একটা ইউরোপীয় ধরনের শহরের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। বড় বড় বাড়ি, ব্যাঙ্ক, হোটেল, দোকান, পিচঢালা চওড়া রাস্তা, একপাশ দিয়ে ইলেকট্রিক ট্রাম চলছে, জুলু রিকশাওয়ালা রিক্সা টানছে, কাগজওয়ালা কাগজ বিক্রি করছে। সবই যেন নতুন, যেন এসব দৃশ্য জীবনে কখনো সে দেখেনি।

লোকালয়ে তো এসেছে, কিন্তু একেবারে কপর্দকশূন্য। এক পেয়ালা চা খাবার পয়সাও তার নেই। কাছে একটা ভারতীয় দোকান দেখে তার বড় আনন্দ হল। কতদিন যেন দেখেনি স্বদেশবাসীর মুখ। দোকানদার মুসলমান, সাবান ও গন্ধদ্রব্যের পাইকারী বিক্রেতা। খুব বড় দোকান। শঙ্করকে দেখেই সে বুঝলে এ দুঃস্থ ও বিপদগ্রস্ত। নিজে দু’টাকা সাহায্য করলে ও একজন বড় ভারতীয় সওদাগরের সঙ্গে দেখা করতে বলে দিলে।

টাকা দুটি পকেটে নিয়ে শঙ্কর আবার পথে এসে দাঁড়াল। আসবার সময় বলে এল— অসীম ধন্যবাদ টাকা দুটির জন্যে। এ আমি আপনার কাছে ধার নিলাম, আমার হাতে পয়সা এলে আপনাকে কিন্তু এ টাকা নিতে হবে। সামনেই একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁ। সে ভালো কিছু খাবার লোভ সম্বরণ করতে পারলে না, কতদিন সভ্যখাদ্য মুখে দেয়নি! সেখানে ঢুকে এক টাকার পুরি, কচুরি, হালুয়া, মাংসের চপ, কেক পেট ভরে খেল। সেই সঙ্গে দু-তিন পেয়ালা কফি।

চায়ের টেবিলে একখানা পুরনো কাগজের দিকে তার নজর পড়ল। তাতে এক জায়গায় হেড লাইনে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে—National Park Survey Party’s Singular Experience

A lonely Indian found in the desert

Dying of thirst and exhaustion

His strange storyশঙ্কর দেখলে, তার একটা ফটোও ছাপা হয়েছে কাগজে। তার মুখে সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটা গল্পও দেওয়া হয়েছে। এ রকম গল্প সে কারো কাছে করেনি।

খবরের কাগজখানার নাম ‘সলস্‌বেরি ডেলি ক্রনিকল’। সে খবরের কাগজের অফিসে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে। তার চারপাশে ভিড় জমে গেল। ওকে খুঁজে বার করবার জন্যে রিপোর্টারের দল অনেক চেষ্টা করেছিল জানা গেল। সেখানে চিমানিমানি পর্বতে পা-ভেঙে পড়ে থাকার গল্প বলে ও ফটো তুলতে দিয়ে শঙ্কর পঞ্চাশ টাকা পেলে। তা থেকে সে আগে সেই সহৃদয় মুসলমান দোকানদারের টাকা দুটি দিয়ে এল।

আগ্নেয়গিরিটার সম্বন্ধে সে কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখলে। তাতে আগ্নেয়গিরিটার নামকরণ করলে— ‘মাউন্ট আলভারেজ’। তবে মধ্য-আফ্রিকার অরণ্যে লুকানো এত বড় একটা আস্ত জীবন্ত আগ্নেয়গিরির এই গল্প— কেউ বিশ্বাস করলে, কেউ করলে না। অবিশ্যি রত্নের গুহার বাষ্পও সে কাউকে জানতে দেয়নি। দিলে দলে দলে লোক ছুটবে ওর সন্ধানে।

তারপরে একটা বইয়ের দোকানে গিয়ে এক রাশ ইংরেজী বই ও মাসিক পত্রিকা কিনলে। বই পড়েনি কতকাল! সন্ধ্যায় একটা সিনেমায় ছবি দেখলে। কতকাল পরে, রাত্রে হোটেলের ভালো বিছানায় ইলেকট্রিক আলোর তলায় শুয়ে বই পড়তে পড়তে সে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে নিচের প্রিন্স আলবার্ট ভিক্টর স্ট্রীটের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। ট্রাম যাচ্ছে নিচ দিয়ে, রিকশা যাচ্ছে, ভারতীয় কফিখানায় ঠুনঠুন করে ঘন্টা বাজছে, মাঝে মাঝে দু-চারখানা মোটরও যাচ্ছে। এর সঙ্গে মনে হল আরেকটা ছবি— সামনে আগুনের কুন্ড, কিছুদূরে বৃত্তাকারে ঘিরে বসে আছে কোয়োট ও হায়েনার দল। ওদের পিছনে নেকড়েটার দুটো গোল গোল চোখ আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে অন্ধকারের মধ্যে।

কোনটা স্বপ্ন? চিমানিমানি পর্বতে যাপিত সেই ভয়ঙ্কর রাত্রি, না আজকের এই রাত্রি?

ইতিমধ্যে সলস্‌বেরিতে শঙ্কর একজন বিখ্যাত লোক হয়ে উঠেছে।

রিপোর্টারের ভিড়ে তার হোটেলের হল সব সময় ভর্তি। খবরের কাগজের লোক আসে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ছাপবার কন্ট্রাক্ট করতে, কেউ আসে ফটো নিতে।

আত্তিলিও গাত্তির কথা সে ইটালিয়ান কনসাল জেনারেলকে জানালে। তাঁর অফিসের পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গেল আত্তিলিও গাত্তি নামে একজন সম্ভ্রান্ত ইটালিয়ান যুবক ১৮৭৯ সালের আগস্ট মাসে পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে জাহাজডুবি হবার পর নামে। তারপর যুবকটির আর কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি। তার আত্মীয়-স্বজন ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোক। ১৮৯০-৯৫ সাল পর্যন্ত তারা তাদের নিরুদ্দিষ্ট আত্মীয়ের সন্ধানের জন্যে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকার কনসুলেট অফিসকে জ্বালিয়ে খেয়েছিল, পুরষ্কার ঘোষণা করাও হয়েছিল তার সন্ধানের জন্যে। ১৮৯৫ সাল থেকে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছিল।

0 Shares