চাঁদের পাহাড়

যেখানেই নদী বা খাল দেখি— কিংবা পাহাড় দেখি— সকলের আগে সোনার স্তরের সন্ধান করি। লোকে কত কি পেয়ে বড়মানুষ হয়ে গিয়েছে দক্ষিণ-আফ্রিকায়, এ সম্বন্ধে বাল্যকাল থেকে কত কাহিনীই শুনে এসেছিলুম— সেই সব গল্পের মোহই আমায় আফ্রিকায় নিয়ে এসে ফেলেছিল। কিন্তু বৃথাই দু’বৎসর নানাস্থানে ঘুরে বেড়ালুম। কত অসহ্য কষ্ট সহ্য করলুম এই দু’বছরে। একবার তো সন্ধান পেয়েও হারালুম।সেদিন একটা হরিণ শিকার করেছি সকালের দিকে। তাঁবু খাটিয়ে মাংস রান্না করে শুয়ে পড়লুম দুপুরবেলা— কারণ দুপুরের রোদে পথ চলা সেসব জায়গায় একরকম অসম্ভব— ১১৫ ডিগ্রী থেকে ১৩০ ডিগ্রী পর্যন্ত উত্তাপ হয় গ্রীষ্মকালে। বিশ্রামের পরে বন্দুক পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি বন্দুকের নলের মাছিটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। মাছি না থাকলে রাইফেলের তাগ ঠিক হয় না। এদিক ওদিক কত খুঁজেও মাছিটা পাওয়া গেল না। কাছেই একটা পাথরের ঢিবি, তার গায়ে সাদা সাদা কি একটা কঠিন পদার্থ চোখে পড়ল। ঢিবিটার গায়ে সেই জিনিসটা নানা স্থানে আছে। বেছে বেছে তারই একটি দানা সংগ্রহ করে ঘষে মেজে নিয়ে আপাততঃ সেটাকেই মাছি করে রাইফেলের নলের আগায় বসিয়ে নিলাম। তারপর বিকেলে সেখান থেকে আবার উত্তর মুখে রওনা হয়েছি, কোথায় তাঁবু ফেলেছিলাম, সে কথা ক্রমেই ভুলে গিয়েছি।দিন পনেরো পরে একজন ইংরেজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল, সেও আমার মতো সোনা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার সঙ্গে দু’জন মাটাবেল কুলি ছিল। পরস্পরকে পেয়ে আমরা খুশি হলাম, তার নাম জিম কার্টার, আমারই মতো ভবঘুরে, তবে তার বয়েস আমার চেয়ে বেশি। জিম একদিন আমার বন্দুকটা নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে হঠাৎ কি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। আমায় বললে— বন্দুকের মাছি তোমার এরকম কেন? তারপর আমার গল্প শুনে সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। বললে— তুমি বুঝতে পারোনি এ জিনিসটা খাঁটি রুপো, খনিজ রুপো! এ যেখানে পাওয়া যায় সাধারণতঃ সেখানে রুপোর খনি থাকে। আমার আন্দাজ হচ্ছে এক টন পাথর থেকে সেখানে অন্ততঃ ন’হাজার আউন্স রুপো পাওয়া যাবে। সে জায়গাতে এক্ষুনি চলো আমরা যাই। এবার আমরা লক্ষপতি হয়ে যাব।সংক্ষেপে বলি। তারপর কার্টারকে সঙ্গে নিয়ে আমি যে পথে এসেছিলাম, সেই পথে আবার এলাম। কিন্তু চার মাস ধরে কত চেষ্টা করে, কত অসহ্য কষ্ট পেয়ে, কতবার বিরাট দিকদিশাহীন মরুভূমিবত্‍ ভেল্ডের মধ্যে পথ হারিয়ে মৃত্যুর দ্বার পর্যন্ত পৌঁছেও কিছুতেই আমি সে স্থান নির্ণয় করতে পারলাম না। যখন সেখান থেকে সেবার তাঁবু উঠিয়ে দিয়েছিলাম, অত লক্ষ্য করিনি জায়গাটা। আফ্রিকার ভেল্ডে কোনো চিহ্ন বড় একটা থাকে না, যার সাহায্যে পুরনো জায়গা খুঁজে বার করা যায়— সবই যেন একরকম। অনেকবার হয়রান হয়ে শেষে আমরা রুপোর খনির আশা ত্যাগ করে গুয়াই নদীর দিকে চললাম। জিম কার্টার আমাকে আর ছাড়লে না। তার মৃত্যু পর্যন্ত আমার সঙ্গেই ছিল। তার সে শোচনীয় মৃত্যুর কথা ভাবলে এখনো আমার কষ্ট হয়।

তৃষ্ণার কষ্টই এই ভ্রমণের সময় সব চেয়ে বেশি বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে। তাই এখন থেকে আমরা নদীপথ ধরে চলব, এই স্থির করা গেল। বনে জন্তু শিকার করে খাই আর মাঝে মাঝে কাফির বস্তি যদি পাই, সেখান থেকে মিষ্টি আলু, মুরগি প্রভৃতি সংগ্রহ করি।

একবার অরেঞ্জ নদী পার হয়ে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী একটা কাফির বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছি, সেইদিন দুপুরের পরে কাফির বস্তির মোড়লের মেয়ে হঠাৎ ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমরা দেখতে গেলাম— পাঁচ-ছ’বছরের একটা ছোট্ট উলঙ্গ মেয়ে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে— তার পেটে নাকি ভয়ানক ব্যাথা। সবাই কাঁদছে ও দাপাদাপি করছে। মেয়েটার ঘাড়ে নিশ্চয়ই দানো চেপেছে— ওকে মেরে না ফেলে ছাড়বে না। তাকে ও তার বাপ-মাকে জিজ্ঞেস করে এইটুকু জানা গেল, সে বনের ধারে গিয়েছিল— তারপর থেকে তাকে ভূতে পেয়েছে।

আমি ওর অবস্থা দেখে বুঝলাম কোনো বনের ফল বেশি পরিমাণে খেয়ে ওর পেট কামড়াচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, কোনো বনের ফল সে খেয়েছিল কিনা? সে বললে— হ্যাঁ, খেয়েছিল। কাঁচা ফল? মেয়েটা বললে— ফল নয়, ফলের বীজ। সে ফলের বীজই খাদ্য।

এক ডোজ হোমিওপ্যাথিক ওষুধে তার ভূত ছেড়ে গেল। আমাদের সঙ্গে ওষুধের বাক্স ছিল। গ্রামে আমাদের খাতির হয়ে গেল খুব। পনেরো দিন আমরা সে গ্রামের সর্দারের অতিথি হয়ে রইলাম। ইলান্ড হরিণ শিকার করি আর রাত্রে কাফিরদের মাংস খেতে নিমন্ত্রণ করি। বিদায় নেবার সময় কাফির সর্দার বললে— তোমরা সাদা পাথর খুব ভালোবাসো— না? বেশ খেলবার জিনিস। নেবে সাদা পাথর? দাঁড়াও দেখাচ্ছি। একটু পরে সে একটা ডুমুর ফলের মতো বড় সাদা পাথর আমাদের হাতে এনে দিলে। জিম ও আমি বিস্ময়ে চমকে উঠলাম— জিনিসটা হীরে! খনি বা খনির ওপরকার পাথুরে মৃত্তিকাস্তর থেকে পাওয়া পালিশ-না-করা হীরের টুকরো!

কাফির সর্দার বললে— এটা তোমরা নিয়ে যাও। ঐ যে দূরের বড় পাহাড় দেখছো, ধোঁয়া ধোঁয়া— এখান থেকে হেঁটে গেলে একটা চাঁদের মধ্যে ওখানে পৌঁছে যাবে। ঐ পাহাড়ের মধ্যে এ রকম সাদা পাথর অনেক আছে বলে শুনেছি। আমরা কখনো যাই নি, জায়গা ভালো নয়, ওখানে বুনিপ বলে উপদেবতা থাকে। অনেক চাঁদ আগেকার কথা, আমাদের গ্রামের তিনজন সাহসী লোক কারো বারণ না শুনে ঐ পাহাড়ে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। আর একবার একজন তোমাদের মতো সাদা মানুষ এসেছিল, সেও অনেক, অনেক চাঁদ আগে। আমরা দেখিনি, আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদাদের আমলের কথা। সে গিয়েও আর ফেরেনি।

কাফির গ্রাম থেকে বার হয়েই পথে আমরা ম্যাপ মিলিয়ে দেখলাম— দূরের ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্ট ব্যাপারটা হচ্ছে রিখটারসভেল্ড পর্বতশ্রেণী, দক্ষিণ-আফ্রিকার সর্বাপেক্ষা বন্য, অজ্ঞাত, বিশাল ও বিপদসঙ্কুল অঞ্চল। দু-একজন দুর্ধর্ষ দেশ-আবিষ্কারক বা ভৌগোলিক বিশেষজ্ঞ ছাড়া, কোনো সভ্য মানুষ সে অঞ্চলে পদার্পণ করেনি। ঐ বিস্তীর্ণ বনপর্বতের অধিকাংশ স্থানই সম্পূর্ণ অজানা, তার ম্যাপ নেই, তার কোথায় কি আছে কেউ বলতে পারে না।

জিম কার্টার ও আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল— আমরা দু’জনেই তখুনি স্থির করলাম ওই অরণ্য ও পর্বতমালা আমাদেরই আগমন প্রতীক্ষায় তার বিপুল রত্নভান্ডার লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন করে রেখেছে, ওখানে আমরা যাবোই।

কাফির গ্রাম থেকে রওনা হবার প্রায় সতের দিন পরে আমরা পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে নিবিড় বনে প্রবেশ করলাম।

আগেই বলেছি দক্ষিণ-আফ্রিকার অত্যন্ত দুর্গম প্রদেশে এই পর্বতশ্রেণী অবস্থিত। জঙ্গলের কাছাকাছি কোনো কাফির বস্তি পর্যন্ত আমাদের চোখে পড়ল না। জঙ্গল দেখে মনে হল কাঠুরিয়ার কুঠার আজ পর্যন্ত এখানে প্রবেশ করেনি।

সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা জঙ্গলের ধারে এসে পৌঁছেছিলাম। জিম কার্টারের পরামর্শ মতো সেইখানেই আমরা রাত্রে বিশ্রামের জন্য তাঁবু খাটালাম। জিম জঙ্গলের কাঠ কুড়িয়ে আগুন জ্বাললে, আমি লাগলাম রান্নার কাজে। সকালের দিকে একজোড়া পাখি মেরেছিলাম, সেই পাখি ছাড়িয়ে তার রোস্ট করবো এই ছিল মতলব। পাখি ছাড়ানোর কাজে একটু ব্যস্ত আছি, এমন সময় জিম বললে— পাখি রাখো। দু’পেয়ালা কফি করো তো আগে।

আগুন জ্বালাই ছিল। জল গরম করতে দিয়ে আবার পাখি ছাড়াতে বসেছি এমন সময় সিংহের গর্জন একেবারে অতি নিকটে শোনা গেল। জিম বন্দুক নিয়ে বেরুল, আমি বললাম— অন্ধকার হয়ে আসছে, বেশি দূর যেও না। তারপরে আমি পাখি ছাড়াচ্ছি— কিছুদূরে জঙ্গলের বাইরেই দু’বার বন্দুকের আওয়াজ শুনলুম। একটুখানি থেমে আবার আর একটা আওয়াজ। তারপরেই সব চুপ। মিনিট দশ কেটে গেল, জিম আসে না দেখে আমি নিজের রাইফেলটা নিয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ এসেছিল, সেদিকে একটু যেতেই দেখি জিম আসছে— পেছনে কি একটা ভারী মতো টেনে আনছে। আমায় দেখে বললে— ভারি চমৎকার ছালখানা। জঙ্গলের ধারে ফেলে রাখলে হায়েনাতে সাবাড় করে দেবে। তাঁবুর কাছে টেনে নিয়ে যাই চল।

দু’জনে টেনে সিংহের প্রকান্ড দেহটা তাঁবুর আগুনের কাছে নিয়ে এসে ফেললাম। তারপর ক্রমে রাত হল। খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা শুয়ে পড়লুম।

0 Shares