পথের পাঁচালী

দুৰ্গা বাড়ি ঢুকিল। কোথা হইতে ঘুরিয়া আসিতেছে। এক পা ধুলা, কপালের সামনে একগোছা চুল সোজা হইয়া প্রায় চার আঙুল উঁচু হইয়া আছে। সে সব সময় আপন মনে ঘুরিতেছে–পাড়ার সমবয়সি ছেলেমেয়ের সঙ্গে তাহার বড় একটা খেলা-ধুলা নাই– কোথায় কোন ঝোপে। বৈঁচি পাকিল, কাদের বাগানে কোন গাছটায় আমের গুটি বাঁধিয়াছে, কোন বাঁশতলায় শেয়াকুল খাইতে মিষ্ট-এ সব তাহার নখদর্পণে। পথে চলিতে চলিতে সে সর্বদা পথের দুই পাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে চলিয়াছে—কোথাও কাঁচপোকা বসিয়া আছে কি না। যদি কোথাও কণ্টিকারী গাছের পাকা ফল দেখিতে পাইল, তৎক্ষণাৎ খেলাঘরের বেগুন করিবার জন্য তাহা তুলিতে বসিয়া যাইবে। হয়তো পথে কোথাও বসিয়া সে নানারকমের খাপরা লইয়া ছড়িয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছে, গঙ্গা-যমুনা খেলায় কোনখানায় ভালো তাক হয়–পরীক্ষায় যেখানা ভালো বলিয়া প্রমাণিত হইবে, সেখানা সে সযত্নে আঁচলে বাঁধিয়া লইবে। সর্বদাই সে পুতুলের বাক্স ও খেলাঘরের সরঞ্জাম লইয়া মহাব্যস্ত।

সে ঢুকিয়া অপরাধীর দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাহিল। সর্বজয়া বলিল—এলে! এসো, ভাত তৈরি। খেয়ে আমায় উদ্ধার করো।–তারপর আবার কোন দিকে বেরুতে হবে বেরোও। বোশেখ মাসের দিন-সকলের মেয়ে দ্যাখো গে যাও সেঁজুতি করচে, শিবপুজো করচে–আর অত বড় ধাড়ি মেয়ে–দিনরাত কেবল টো টো। সেই সকাল হতে না হতে বেরিয়েচে, আর এখন এই বেলা দুপুর ঘুরে গিয়েচে, এখন এলো বাড়ি-মাথাটার ছিরি দ্যাখো না! না একটু তেল দেওয়া, না একটু চিরুনি ছোঁয়ানো-কে বলবে বামুনের মেয়ে, ঠিক যেন দুলে কি বাগদিদের কেউ–বিয়েও হবে ওই দুলে-বাগদিদের বাড়িতেই–আচলে ওগুলো কী ধনদৌলত বাঁধা-খোল–

দুৰ্গা ভয়ে ভয়ে আঁচলের খুঁট খুলিতে খুলিতে কহিল–ওই রােয়ককাদের বাড়ির সামনে কালকাসুন্দে গাছে–পরে ঢোঁক গিলিয়া কহিল–এই অনেক বেনেবৌ তাই–

বেনেবৌয়ের কথায় হৃদয় গলে না। এমন পাষাণ জীবও জগতে অনেক আছে। সর্বজয়া তেলেবেগুনে জ্বলিয়া কহিল–তোর বেনেবৌয়ের না নিকুচি করেচে, যত ছাই আর ভাসসো রাতদিন বেঁধে নিয়ে ঘুরচেন–আজি টান মেরে তোমার পুতুলের বাক্স ওই বাঁশতলার ডোবায় যদি না ফেলি। তবে–

সর্বজয়ার কথা শেষ হইবার পূর্বেই এক ব্যাপার ঘটিল। আগে আগে ভুবন মুখুজ্যের বাড়ির সেজ-ঠাকরুন, পিছনে পিছনে তাঁহার মেয়ে টুনু ও দেওরের ছেলে সন্তু, তাহাদের পিছনে আর চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে সম্মুখ দরজা দিয়া বাড়ি ঢুকিল। সেজ-ঠাকরুন কোনো দিকে না চাহিয়া বাড়ির কাহারও সহিত কোনো আলাপ না করিয়া সোজা হন হন। করিয়া ভিতরের দিকের রোয়াকে উঠিলেন। নিজের ছেলের দিকে ফিরিয়া বলিলেন–কই নিয়ে আয়–বের কর পুতুলের বাক্স, দেখি–

এ বাড়ির কেহ কোনো কথা বলিবার পূর্বেই টুনু ও সন্তু, দুজনে মিলিয়া দুর্গার টিনের পুতুলের বাক্সটা ঘর হইতে বাহির করিয়া আনিয়া রোয়াকে নামাইল এবং টুনু বাক্স খুলিয়া খানিকটা খুঁজিবার পর একছড়া পুতির মালা বাহির করিয়া বলিল–এই দ্যাখো মা, আমার সেই মালাটা—সেদিন যে সেই খেলতে গিয়েছিল, সেদিন চুরি করে এনেচে।

সতু বাক্সের এক কোণ সন্ধান করিয়া গোটাকতক আমের গুটি বাহির করিয়া বলিল–এই দ্যাখো জেঠিমা, আমাদের সোনামুখী গাছের আম পেড়ে এনেচে।

ব্যাপারটা এত হঠাৎ হইয়া গেল বা ইহাদের গতিবিধি এ বাড়ির সকলের কাছেই এত রহস্যময় মনে হইল যে এতক্ষণ কাহারও মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হয় নাই। এতক্ষণ পরে সর্বজয়া কথা খুজিয়া পাইয়া বলিল–কি, কি খুড়িমা? কি হয়েচে? পরে সে রান্নাঘরের দাওয়া হইতে ব্যগ্রভাবে উঠিয়া আসিল।

–এই দ্যাখো না কি হয়েচে, কীর্তিখানা দ্যাখো না একবার–তোমার মেয়ে সেদিন খেলতে গিয়ে টুনুর পুতুলের বাক্স থেকে এই পুতির মালা চুরি করে নিয়ে এসেচে-মেয়ে ক’দিন থেকে খুঁজে খুজে হয়রান। তারপর সন্তু গিয়ে বললে যে, তোর পুতির মালা দুগগাদিদির বাক্সের মধ্যে দেখে এলাম–দ্যাখো একবার কাণ্ড–তোমার ও মেয়ে কম নাকি? চোর-চোরের বেহদা চোর-—আর ওই দ্যাখো না-বাগানের আমগুলো গুটি পড়তে দেরি সয় না–চুরি করে নিয়ে এসে বাক্সে লুকিয়ে রেখেচে।

যুগপৎ দুই চুরির অতর্কিততায় আড়ষ্ট হইয়া দুৰ্গা পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ঘামিতেছিল। সর্বজয়া জিজ্ঞাসা করিল–এনিচিস এই মালা ওদের বাড়ি থেকে?

দুৰ্গা কথার উত্তর দিতে না দিতে সেজ-বৌ বলিলেন,–না আনলে কি আর মিথ্যে করে বলচি নাকি! বলি এই আম কটা দ্যাখো না? সোনামুখীর আমি চেনো, না কি? এও কি মিথ্যে কথা?

সর্বজয়া অপ্ৰতিভ হইয়া বলিল–না। সেজখুড়ি, আপনার মিথ্যে কথা তা তো বলিনি! আমি ওকে জিজ্ঞেস করচি।

সেজ-ঠাকরুন হাত নাড়িয়া ঝাঁজের সহিত বলিলেন–জিজ্ঞেস করো আর যা করো বাপু, ও মেয়ে সোজা মেয়ে হবে না। আমি বলে দিচ্চি–এই বয়েসে যখন চুরি বিদ্যে ধরেচে, তখন এর পর যা হবে সে টেরই পাবে! চল রে সতু-—নে আমের গুটিগুলো বেঁধে নে-বাগানের আমগুলো লক্ষ্মীছাড়া ছড়ির জ্বালায় যদি চোখে দেখবার জো আছে! টুনু, মালা নিইচিস তো?

সর্বজয়ার কি জানি কেমন একটু রাগ হইল–ঝগড়াতে সে কিছু পিছু হটবার পাত্র নয়, বলিল–পুতির মালার কথা জানিনে সেজ-খুড়ি, কিন্তু আমের গুটিগুলো, সেগুলো পেড়েছে কি তলা থেকে কুড়িয়ে এনেচে, তার গায়ে তো নাম লেখা নেই। সেজখুড়ি—আর ছেলেমানুষ যদি ধরো এনেই থাকে–

সেজ-ঠাকরুন অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন–বলি কথাগুলি তো বেশ কেটে কেটে বলচো? বলি আমের গুটিতে নাম লেখা না-হয় নেই-ই, তোমাদের কোন বাগান থেকে এগুলো এসেচে। তা বলতে পারো? বলি টাকাগুলোতেও তো নাম লেখা ছিল না।–তা তো হাত পেতে নিতে পেরেছিলে? আজ এক বিচ্ছরের ওপর হয়ে গ্যালো, আজ দেবো কাল দেবো।–আসবো এখন ওবেলা, টাকা দিয়ে দিয়ো–ও আমি আর রাখতে পারবো না– টাকার জোগাড় করে রেখো বলে দিচ্চি।

দলবলসহ সেজ-ঠাকরুন দরজার বাহির হইয়া গেলেন। সর্বজয়া শুনিতে পাইল, পথে কাহার কথার উত্তরে তিনি বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলিতেছেন-ওই এ-বাড়ির ছুড়িটা, টুনুর বাক্স থেকে এই পুতির মালাছড়াটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে করেচে। কি নিজের বাক্সে লুকিয়ে রেখেচে–আর দ্যাখো না। এই আমগুলো–পাশেই বাগান, যত ইচ্ছে পাড়লেই হল–তাই বলতে গেলাম, তা মা আবার কেটে কেটে বলচে (এখানে সেজ-বৌ সর্বজয়ার কথা বলিবার ভঙ্গি নকল করিলেন)–তা–এনেচে ছেলেমানুষ– ও রকম এনেই থাকে-ওতে কি তোমাদের নাম লেখা আছে নাকি? (সুর নিচু করিয়া) মা-ই কি কম চোর নাকি, মেয়ের শিক্ষে কি আর অমনি হয়েচে? বাড়িসুদ্দ সব চোর–

অপমানে দুঃখে সর্বজয়ার চোখে জল আসিল। সে ফিরিয়া দুর্গার রুক্ষ চুলের গোছা টানিয়া ধরিয়া ডাল ভাত মাখা হাতেই দুড়দাড় করিয়া তাহার পিঠে কিলের উপর কিল ও চড়ের উপর চড় মারিতে মারিতে বলিতে লাগিল–আপদবালাই একটা কোথেকে এসে জুটেছে–ম’লে ও আপদ চুকে যায়–মরেও না যে বাঁচি-হাড় জুড়োয়।–বেরো বাড়ি থেকে, দূর হয়ে যা—যা, এখখুনি বেরো–

দুৰ্গা মারা খাইতে খাইতে ভয়ে খিড়কি-দোর দিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। তাহার ছেঁড়া রুক্ষ চুলের গোছা দু-এক গাছা সর্বজয়ার হাতে থাকিয়া গেল।

অপু খাইতে খাইতে অবাক হইয়া সমস্ত ব্যাপার দেখিতেছিল। দিদি পুতির মালা চুরি করিয়া আনিয়াছিল। কিনা তাহা সে জানে না-পুতির মালাটা সে ইহার আগে কোনও দিন দেখে নাই—কিন্তু আমের গুটি যে চুরির জিনিস নয় তাহা সে নিজে জানে। কাল বৈকালে দিদি তাহাকে সঙ্গে করিয়া টুলুদের বাগানে আম কুড়াইতে গিয়াছিল এবং সোণামুখীর তলায় আম কটা পড়িয়া ছিল, দিদি কুড়াইয়া লইল, সে জানে কাল হইতে অনেকবার দিদি বলিয়াছে–ও অপু, এবার সেই আমের গুটিগুলো জারাবো, কেমন তো? কিন্তু মা অসুবিধাজনকভাবে বাড়ি উপস্থিত থাকার দরুন উক্ত প্রস্তাব আর কার্যে পরিণত করা সম্ভব হয় নাই। দিদির অত্যন্ত আশার জিনিস আমগুলো এভাবে লইয়া গেল, তাহার উপর আবার দিদি এরূপ ভাবে মারও খাইল। দিদির চুল ছিড়িয়া দেওয়ায় মায়ের উপর তাহার অত্যন্ত রাগ হইল। যখন তাহার দিদির মাথার সামনে রুক্ষ চুলের এক গোছা খাড়া হইয়া বাতাসে উড়ে তখনই কি জানি কেন, দিদির উপর অত্যন্ত মমতা হয়–কেমন যেন মনে হয় দিদির কেহ কোথাও নাই–সে যেন একা কোথা হইতে আসিয়াছে–উহার সাখী কেহ এখানে নাই। কেবলই মনে হয়, কেমন করিয়া সে দিদির সকল দুঃখ ঘুচাইয়া দিবে–সকল অভাব পূরণ করিয়া তুলিবে! তাহার দিদিকে সে এতটুকু কষ্টে পড়িতে দিবে না।

খাওয়ার পরে অপু মায়ের ভয়ে ঘরের মধ্যে বসিয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু তাহার মন থাকিয়া থাকিয়া কেবলই বাহিরে ছুটিয়া যাইতেছিল। বেলা একটু পড়িলে সে টুনুদের বাড়ি, পাটলিদের বাড়ি, নেড়াদের বাড়ি–একে একে সকল বাড়ি খুজিল–দিদি কোথাও নাই। রাজকৃষ্ট পালিতের স্ত্রী ঘাট হইতে জল লইয়া আসিতেছিলেন—তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল–জেঠিমা, আমার দিদিকে দেখেচো? সে আজ ভাত খায়নি, কিছু খায়নি।–মা তাকে আজ বড্ড মেরেচে-—মার খেয়ে কোথায় পালিয়েচে–দেখেচো জেঠিমা?

175 Shares