পথের পাঁচালী

সর্বজয়া বাড়ি ছিল না, পাড়া হইতে আসিয়া দেখিল–ছেলেমেয়ে বাড়ির ভিতর দিকে দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। কাছে। যাইতে দুৰ্গা চুপিচুপি বলিল–মা, একটা জিনিস কুড়িয়ে পেয়েচি আমরা। গড়ের পুকুরে পানফল তুলতে গিাইছিলাম মা। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে এটি পোঁতা ছিল।

অপু বলিল–আমি দেখে দিদিকে বল্লাম, মা।

নসটা খুলিয়া মায়ের হাতে দিয়া বলিল–দ্যাখো দিকি কী এটা

দুৰ্গা আঁচল হইতে জিনিসটা খুলিয়া মায়ের হাতে দিয়া বলিল—দ্যাখো দিকি কী এটা মা?

সর্বজয়া উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিতে লাগিল। দুৰ্গা চুপিচুপি বলিল–মা, এটা ঠিক হীরে–নয়?

সর্বজয়ারও হীরক সম্বন্ধে ধারণা তাহাদের অপেক্ষা বেশি স্পষ্ট নহে। সে সন্দিগ্ধ সুরে জিজ্ঞাসা করিল–তুই কি করে জানালি হীরে?

দুৰ্গা বলিল–মজুমদারেরা বড়লোক ছিল তো মা? ওদের ভিটের জঙ্গলে কারা নাকি মোহর কুড়িয়ে পেয়েছিল––পিসি গল্প করতো। এটা একেবারে পুকুরের ধারে বনের মধ্যে পোঁতা ছিল, রোদুর লেগে চকচক কচ্ছিল, এ ঠিক মা হীরে।

সর্বজয়া বলিল-আগে উনি আসুন, ওঁকে দেখাই।

দুৰ্গা বাহিরে উঠানে আসিয়া আহ্বাদের সহিত ভাইকে বলিল–হীরে যদি হয় তবে দেখিস আমরা বড়মানুষ হয়ে যাবো।

অপু না বুঝিয়া বোকার মতো হি হি করিয়া হাসিল।

ছেলেমেয়ে চলিয়া গেলে জিনিসটা বাহির করিয়া সর্বজয়া ভালো করিয়া দেখিতে লাগিল। গোলমতো, ধারকাটা ও পালতোলা, এক মুখ ছুচোলো-যেন সিন্দূর কৌটার ঢাকনির উপরটা। বেশ চকচকে। সর্বজয়ার মনে হইল যেন অনেক রকম রং সে ইহার মধ্যে দেখিতে পাইতেছে। তবে কাচ যে নয়–ইহা ঠিক। এ রকম ধরনের কাচ সে কখনও দেখিয়াছে বলিয়া তো মনে হয় না। হঠাৎ তাহার সমস্ত গা দিয়া যেন কিসের স্রোত বহিয়া গেল, তাহার মনের এক কোণে নানা সন্দেহের বাধা ঠেলিয়া একটা গাঢ় দুরাশা ভয়ে ভয়ে একটু উকি মারিল–সত্যিই যদি হীরে হয়, তা হলে?

হীরক সম্বন্ধে তাহার ধারণাটা পরশপাথর কিংবা সাপের মাথার মণি জাতীয় ছিল। কাহিনীর কথা মাত্র, বাস্তব জগতে বড় একটা দেখা যায় না। আর যদি বা দেখা যায়, তবে দুনিয়ার ঐশ্বর্য বোধ হয় এক টুকরা হীরার বদলে পাওয়া যাইতে পারে।

খানিকটা পরে একটা পুটুলি হাতে হরিহর বাড়ি ঢুকিল।

সর্বজয়া বলিল–ওগো, শোনো, এদিকে এসো তো! দ্যাখো তো এটা কি!

হরিহর হাতে লইয়া বলিল–কোথায় পেলে?

–দুগগা গড়ের পুকুরে পানফল তুলতে গিয়েছিল, কুড়িয়ে পেয়েচে। কি বলো দিকি?

হরিহর খানিকক্ষণ উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিয়া বলিল–কাচ, না-হয় পাথর-টাথর হবে-একটুকু জিনিস, ঠিক বুঝতে পারচি নে।

সর্বজয়ার মনে একটুখানি ক্ষীণ আশার রেখা দেখা দিল–কাচ হইলে তাহার স্বামী কি চিনিতে পারিত না? পরে সে চুপিচুপি, যেন পাছে স্বামী বিরুদ্ধযুক্তি দেখায় এই ভয়ে বলিল–হীরে নয় তো? দুগগা বলছিল মজুমদার বাড়ির গড়ে তো কত লোক কত কি কুড়িয়ে পেয়েচে! যদি হীরে হয়?

–হ্যাঁ, হীরে যদি পথেঘাটে পাওয়া যেত। তবে আর ভাবনা কি ছিল? তুমিও যেমন!… তাহার মনে মনে ধারণা হইল ইহা কাচ। পরীক্ষণেই কিন্তু মনে হইল হয়তো হইতেও পারে। বলা যায় কি! মজুমদারেরা বড়লোক ছিল। বিচিত্র কি যে হয়তো তাদেরই গহনায়-টহনায় কোনো কালে বসানো ছিল, কি করিয়া মাটির মধ্যে পুঁতিয়া গিয়াছে। কথায় বলে, কপালে না থাকিলে গুপ্তধন হাতে পড়িলে চেনা য্যা না—শেষে কি দরিদ্র ব্রাহ্মণের গল্পের মত ঘটিবে? সে বলিল—আচ্ছা দাঁড়াও, একবার বরং গাঙ্গুলী-বাড়ি দেখিয়ে আসি।

রাঁধিতে রাঁধিতে সর্ব্বজয়া বার বার মনে মনে বলিতে লাগিল—দোহাই ঠাকুর, কত লোক তো কত কি কুড়িয়ে পায়! এই কষ্ট যাচ্ছে সংসারের—বাছাদের দিকে মুখ তুলে তাকিও—দোহাই ঠাকুর!

তাহার বুকের মধ্যে টিপ্‌ টিপ্‌ করিতেছিল।

খানিকটা পরে দুর্গা বাড়ী আসিয়া আগ্রহের সুরে বলিল—বাবা এখনও বাড়ী ফেরে নি, হ্যাঁ মা?

সঙ্গে সঙ্গে হরিহর বাড়ীর ভিতরে ঢুকিয়া বলিল—হুঁঃ, তখনই আমি বললাম এ কিছুই নয়। গাঙ্গুলী মশায়ের জামাই সত্যবাবু কলকাতা থেকে এসেছেন—তিনি দেখে বল্লেন, এ একরকম বেলোয়ারী কাচ—ঝাড়-লণ্ঠনে ঝুলানো থাকে। রাস্তাঘাটে যদি হীরে-জহরৎ পাওয়া যেত তা হলে…তুমিও যেমন।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

বৈশাখ মাসের দিন। প্রায় দুপুর বেলা।

সর্বজয়া বাটনা বাটিতে বাটিতে ডান হাতের কাছে রক্ষিত একটা ফুলের সাজিতে (অনেকদিন হইতে ফুলের সহিত ইহার কোনো সম্পর্ক নাই, মশলা রাখিবার পাত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়) মশলা খুঁজতে গিয়া বলিল–আবার জিরে-মরিচের পুঁটুলটা কোথায় নিয়ে পালালি? বড্ড জ্বালাতন কচ্চিস অপু-রাঁধতে দিবিনে? তারপর একটু পরেই বোলো এখন–মা ক্ষিদে পেয়েছে।

অপুর দেখা নাই।

–দিয়ে যা বাপ আমার, লক্ষ্মী আমার-কেন জ্বালাতন কচ্চিস বল দিকি? দেখচিস বেলা হয়ে যাচ্ছে।

অপু রান্নাঘরের ভিতর হইতে দুয়ারের পাশ দিয়া ঈষৎ উঁকি মারিল, মায়ের চোখ সেদিকে পড়িতেই তাহার দুষ্টুমির হাসি-ভরা টুকটুকে মুখখানা শামুকের খোলার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবার মতো তৎক্ষণাৎ আবার দুয়ারের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল। সর্বজয়া বলিল—দ্যাখ্‌ দিকি কাণ্ড–কেন বাপু দিক্‌ করিস। দুপুরবেলা? দিয়ে যা–

অপু পুনরায় হাসিমুখে ঈষৎ উঁকি মারিল।

—ওই আমি দেখতে পেয়েছি–আর লুকুতে হবে না, দিয়ে যা—

—হি-হি-হি–আমোদের হাসি হাসিয়া সে আবার দুয়ারের আড়ালে মুখ লুকাইল।

সর্বজয়া ছেলেকে ভালোরূপেই চিনিত। যখন অপু ছোট্ট খোকা দেড়বছরেরটি, তখন দেখিতে সে এখনকার চেয়েও টুকটুকে ফরসা ছিল। সর্বজয়ার মনে আছে, সে তাহার ডাগর চোখ দুটিতে বেশ করিয়া কাজল পরাইয়া কপালের মাঝখানে একটি টিপ পরাইয়া দিত ও তাহার মাথায় একটা নীল রং-এর কম দামের ঘন্টিওয়ালা পশমের টুপি পরাইয়া, কোলে করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে বাহিরের রকে দাঁড়াইয়া ঘুম পাড়াইবার উদ্দেশ্যে সুর টানিয়া টানিয়া বলিত–

আয় রে পাখি-ই-ই লেজঝোলা,

আমার খোকনকে নিয়ে-এ-এ-গাছে তোলা…

খোকা ট্যাঁপা-ট্যাঁপা ফুলো-ফুলো গালে মায়ের মুখের দিকে হ্যাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিত, পরে হঠাৎ কি মনে করিয়া সম্পূর্ণ দন্তহীন মাড়ি বাহির করিয়া আহ্বাদে আটখানা হইয়া মলা-পরা অসম্ভবরদীপ ছোট্ট পায়ে মাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া মায়ের পিঠের দিকে মুখ লুকাইত। সর্বজয়া হাসিমুখে বলিত-ওমা, খোকা আবার কোথায় লুকুলো? তাই তো, দেখতে তো পাচ্ছিনে! ও খোকা!… পরে সে ঘাড়ের দিকে মুখ ফিরাইতেই শিশু আবার হাসিয়া মুখ সামনের দিকে ফিরাইত এবং নির্বোধের মতো হাসিয়া মায়ের কঁধে মুখ লুকাইত। যতই সর্বজয়া বলিত-ওম, কই আমার খোকা কই-আবার কোথায় গেলা-কই দেখি, ততই শিশুর খেলা চলিত। বার বার সামনে পিছনে ফিরিয়া সর্বজয়ার ঘাড়ে ব্যথা হইলেও শিশুর খেলার বিরাম হইত না। সে তখন একেবারে আনকোরা টাট্‌কা, নতুন সংসারে আসিয়াছে।। জগতের অফুরন্ত আনন্দভাণ্ডারের এক অণুর সন্ধান পাইয়া তাহার অবোধ মন তখন সেইটাকে লইয়াই লোভীর মতো বার বার আস্বাদ করিয়াও সাধ মিটাইতে পারিতেছে না।–তখন তাহকে থামায় এমন সাধ্য তাহার মায়ের কোথায়? খানিকক্ষণ এরূপ করিতে করিতে তাহার ক্ষুদ্র শরীরে শক্তির ভাণ্ডার ফুরাইয়া আসিত- সে হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হইয়া হই তুলিতে থাকিস্ত-সর্বজয়া ছোট্ট হ্যাঁ-টির সামনে তুড়ি দিয়া বলিত-ষাট ষাটএই দ্যাখো দেয়ালা করে করে। এইবার বাছার আমার ঘুম আসচে। পরে সে মুগ্ধ নয়নে শিশুপুত্রের টিপ-কাজলপরী, কচি মুখের দিকে চাহিয়া বলিত-কত রঙ্গই জানে সনকু আমার-তবুও তো এই যোটের দেড় বছরের! হঠাৎ সে আকুল চুম্বনে খোকার রাঙা গাল দুটি ভরাইয়া ফেলিত। কিন্তু মায়ের এই গাঢ় আদরের প্রতি সম্পূৰ্ণ ঔদাসীন্য প্রদর্শন করিয়াই শিশুর নিদ্রাতুর আঁখিপাতা ঢুলিয়া আসিত, সর্বজয়া খোকার মাথাটা আস্তে আস্তে নিজের কঁধে রাখিয়া বলিত-ওমা, সন্দেবোলা দ্যাখে ঘুমিয়ে পড়লো! এই ভাবছি সন্দেটা উৎবুলে দুধ খাইয়ে তবে ঘুম পাড়াবো-দ্যাখো কাণ্ড!

সর্বজয়া জানিত-ছেলে আট বছরের হইলে কি হইবে, সেই ছেলেবেলাকার মতো মাযের সহিত লুকোচুরি খেলিবার সাধ তাহার এখনও মিটে নাই।

এমন সব স্থানে সে লুকায় যেখান হইতে অন্ধও তাহাকে বাহির করিতে পারে; কিন্তু সর্বজয়া দেখিয়াও দেখে না-এক জায়গায় বসিয়াই এদিকে ওদিকে চায়, বলে-তাই তো! কোথায় গেল? দেখতে তো পাচ্ছিনে!..অপু ভাবে-মাকে কেমন ঠকাইতে পারা যায়! মায়ের সহিত এ খেলা করিয়া মজা আছে। সর্বজয়া জানে যে, খেলায় যোগ দিবার ভান করিলে এইরূপ সারাদিন চলিতে পারে, কাজেই সে ধমক দিয়া কহিল-তা হলে কিন্তু থাকলো পড়ে রান্নাবান্না। অপু, তুমি ওই রকম করো, খেতে চাইলে তখন দেখবে মজাটা–

175 Shares