পথের পাঁচালী

অপু হাসিতে হাসিতে গুপ্তস্থান হইতে বাহির হইয়া মশলার পুঁটুলি মায়ের সামনে রাখিয়া দিল।

তাহার মা বলিল, যা একটু খেলা করগে যা বাইরে। দেখগে যা দিকি তোর দিদি কোথায আছে! গাছতলায় দাঁড়িয়ে একটু হ্যাঁক দিয়ে দাখ দিকি। তার আজ নাইবার দিন-হতচ্ছাড়া মেয়ের নাগাল পাওয়ার জো আছে? যা তো লক্ষ্মী ছেলে–

কিন্তু এখানে মাতৃ-আদেশ পালন করিয়া সুপুত্ৰ হইবার কোনো চেষ্টা তাহাব দেখা গেল না। সে বাটনা-বাটা-রত মায়ের পিছনে গিয়া কি করিতে লাগিল।

–হু-উ-উ-উ-উ-উম্‌–

সর্বজয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল অপু বড়ি দেওয়ার জন্য চালের বাতায় রক্ষিত একটা পুরানো চট আনিয়া মুড়ি দিয়া মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়া বসিয়া আছে।

–দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কাণ্ড দ্যাখো একবার। ও লক্ষ্মীছাড়া, ওতে যে সাত-রাজ্যির ধুলো। ফ্যাল ফ্যাল-সাপ-মাকড় আছে না কি আছে। ওর মধ্যে-আজি কদিন থেকে তোলা রয়েছে–

–হু-উ-উ-উম—(পূর্বাপেক্ষা গম্ভীর সুরে)

–নাঃ, বল্লে যদি কথা শোনে-বাবা আমার, সোনা আমার, ওখানা ফ্যাল-আমার বাটনার ঠাত—দুষ্টুমি কোরো না ছিঃ!

থলে-মোড়া মূর্তিটা হামাগুড়ি দিয়া এবার দুই কদম আগাঁইয়া আসিল। সর্বজয়া বলিল-ছুঁবি ছুঁবি-ছুঁও না মানিক আমার–ওঃ, ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গিাইচি-ভারি ভয় হয়েছে মামার!

অপু হি-হি করিয়া হাসিয়া থলেখানা খুলিয়া এক পাশে রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মাথার চুল, মুখ, চোখের ভুবু, কান ধুলায় ভরিয়া গিয়াছে। মুখ কঁচুমাচু করিয়া সে সামনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাঁত কিছু কিচু করিতেছে।

-ওমা আমার কি হবে! হ্যাঁরে হতভাগা, ধুলো মেখে যে একেবারে ভূত সেজেছিস? উঃ–ওই পুরানো থলেটার ধুলো! একেবারে পাগল!

ধূলিধূসরিত অবোধ পুত্রের প্রতি করুণা ও মমতায় সর্বজয়ার বুক ভরিয়া আসিল; কিন্তু অপুর পরনে বাসি কাপড়-নাহিয়া-ধুইয়া ছোঁয়া চলে না বলিয়া বলিল-গামছাখানা নে, ওই দিয়ে ধুলোগুলো আগে ঝেড়ে ফ্যাল। ছেলে যেন কি একটা।

খানিকটা পরে ছেলেকে রান্নাঘরে পাহারার জন্য বসাইয়া সে জল আনিতে বাহির হইয়া যাইতেছে, দেখে দরাজ দিয়া দুর্গা বাড়ি ঢুকিতেছে। মুখ রৌদ্রে রাঙা, মাথার চুল উসকোথুসকো, অথচ ধুলোমাখা পায়ে আলতা পরা। একেবারে মায়ের সামনে পড়াতে আঁচলে বাঁধা আম দেখাইয়া টোক গিলিয়া কহিল—এই পুণ্যপুকুরের জন্যে ছোলার গাছ আনতে গেলাম রাজীদের বাড়ি, আম পেড়ে এনেছে ভাগ হচ্ছে, তাই রাজীর পিসিমা দিলে।

–আহা, মেয়ের দশা দ্যাখো, গায়ে খড়ি উড়াচে, মাথার চুল দেখলে গায়ে জ্বর আসে–পুণ্যিপুকুরের জন্য ভেবে তো তোমার রাত্তিরে ঘুম নেই!-পরে মেয়ের পায়ের দিকে চাহিয়া কহিল-ফের বুঝি লক্ষ্মীর চুবড়ি থেকে আলতা বের করে পরা হয়েচে?

দুৰ্গা আঁচল দিয়া মুখ মুছিয়া উসকোথুসকো চুল কপাল হইতে সরাইয়া বলিল-লক্ষ্মীর চুবড়ির আলতা বইকি! আমি সেদিন হাটে বাবাকে দিয়ে আলতা আনালোম এক পয়সার, তার দরুন দু’পাতা আলতা আমার পুতুলের বাক্সে ছিল না বুঝি?

হরিহর কলকে হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় আগুন লাইতে আসিল।

সর্বজয়া বলিল-ঘণ্টায় ঘণ্টায় তামাকে আগুন দি কোথা থেকে? সুদৱীকাঠের বন্দোবস্ত করে রেখেচোঁ। কিনা একেবারে! বাঁশের চেলার আগুন কতক্ষণ থাকে যে আবার ঘড়ি-ঘড়ি তামাক খাওয়ার আগুন জোগাবো? পরে আগুন তুলিবার জন্য রক্ষিত একটা ভাঙা পিতলের হাতাতে খানিকটা আগুন উঠাইয়া বিরক্তমুখে সামনে ধরিল। পরে সুর নরম করিয়া বলিল-কি হল?

—এক রকম ছিল তো সবই ঠিক, বাড়িসুদ্ধ সবাই মন্তর নেবার কথাই হয়েছিল, কিন্তু একটু মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। মহেশ বিশ্বেসের শ্বশুরবাড়ির বিষয়-আশয় নিয়ে কি গোলমাল বেধেছে, বিশ্বেস মশায় গিয়েচে সেখানে চলে-সে-ই আসল মালিক কিনা। তাই আবার একটু পিছিয়ে গেল; আবার এদিকেও তো অকাল পড়চে আষাঢ় মাস থেকে।

–আর সেই যে বাসের জায়গা দেবে, বাস করাবে বলছিল, তার কি হল?

—এই নিয়ে একটু মুশকিল বেধে গেল। কিনা! ধরে যদি মন্তর নেওয়া পিছিয়ে যায়, তবে ওকথা আর কি করে ওঠাই?

সর্বজয়া খুব আশায় আশায় ছিল, সংবাদ শুনিয়া আশাভঙ্গ হইয়া পড়িল। বলিল, তা ওখানে না হয়, অন্য কোন জায়গায় দ্যাখো না? বিদেশে মান আছে, এখানে কেউ পোছে? এই দ্যাখে আমকাঁঠালের সময়ে একটা আম-কাঁঠাল ঘরে নেই-মেয়েটা কাদের বাড়ি থেকে আজ দুটো আধাপচা আমি নিয়ে এল।—পরে সে উদ্দেশে বাড়ির পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল-এই ঘরের দোর থেকে ঝুড়ি-ঝুড়ি আমি পেড়ে নিয়ে যায়-বাছারা আমার চেয়ে চেয়ে দ্যাখে,-এ কি কম কষ্ট!

বাগানের কথার উল্লেখে হরিহর বলিল-উঃ, ও কি কম ধড়িবাজ নাকি! বছরে পচিশ টাকা খাজনা ফেলে-বোলে হোত, তাই কিনা লিখে নিলে পাঁচ টাকায়! আমি গিয়ে এত করে বললাম, কাক, আমার ছেলেটা মেয়েটা আছে, ওই বাগানে আম-জোম কুড়িয়ে মানুষ হচ্ছে। আমার তো আর কোথাও কিছু নেই। আর ধরুন, আমাদের জ্ঞাতির বাগান-আপনার তো ঈশ্বর ইচ্ছেয় কোনো অভাব নেই, দুটো অত বড় বাগান রয়েছে, আম জাম নারকেল সুপারি-আপনার অভাব কি? বাগানখানা গিয়ে ছেড়ে দিন গে যান! তা বল্পে কি জানো? বল্পে, নীলমণি দাদা বেঁচে থাকতে ওর কাছে নাকি তিনশো টাকা ধার করেছিল, তাই আমনি করে শোধ করে নিল। শোন কথা। নীলমণি দাদার বড় অভাব ছিল কিনা, তাই তিনশো টাকার জন্যে গিয়েছে ভুবন মুখুজ্যের কাছে হাত পাততে। বৌদিকে ভালোমানুষ পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিলে আর কি!

–ভালোমানুষ তো কত! সেও নাকি বলেছে, যে জ্ঞাতিশত্তুর-পর-হাতে বাগান থাকলে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না, ফল-পাকুড় এমনিই খাবে, তার চেয়ে কিছু কম জমাতেও যদি বন্দোবস্ত হয়, খাজনাটা তো পাওয়া যাবে।

হরিহর বলিল-খাজনা কি আর আমি দিতাম না? বাগান জমা দেবে, তাই কি আমায় জানতে দিলে? বৌদিকে-লুচি-মোহনভোগ খাইয়ে হাত করে চুপি চুপি লিখিয়ে নিলে।…

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

বৈকালের দিকটা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল। অনেকক্ষণ হইতে মেঘ মেঘ করিতেছিল, তবুও ঝড়টা যেন খুব শীঘ্ৰ আসিয়া পড়িল। অপুদের বাড়ির সামনে বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলো পাচিলের উপর হইতে ঝড়ের বেগে হটিয়া ওধারে পড়াতে বাড়িটা যেন ফাকা ফাকা দেখাইতে লাগিল-ধূলা, বাঁশপাতা, কাঁঠালপাতা, খড় চারিধার হইতে উড়িয়া তাহাদের উঠান ভরাইয়া ফেলিল। দুৰ্গা বাটীর বাহির হইয়া আম কুড়াইবার জন্য দৌড়িল-অপুও দিদিব পিছু পিছু ছুটিল। দুর্গা ছুটিতে ছুটিতে বলিল-শিগগির ছোট্‌, তুই বরং সিঁদুরকৌটাতলায় থাক, আমি যাই সোনামুখী-তলায়-দৌড়ো-দৌড়ো। ধুলায় চারিদিক ভরিয়া গিয়াছে—বড় বড় গাছের ডাল ঝড়ে বাঁকিয়া গাছ ন্যাড়া-ন্যাড়া দেখাইতেছে। গাছে গাছে সোঁ সোঁ, বোঁ বোঁ শব্দে বাতাস বাধিতেছে–বাগানে শুকনা ডাল, কুটা, বাঁশের খোলা উড়িয়া পড়িতেছে-শুকনা বাঁশপাতা ছুঁচালো আগাটা উঁচুদিকে তুলিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে আকাশে উঠিতেছে—কুক্‌শিমা গাছের শুঁয়ার মতো পালকওয়ালা সাদা সাদা ফুল ঝড়ের মুখে কোথা হইতে অজস্র উড়িয়া আসিতেছে-বাতাসের শব্দে কান পাতা যায় না।

সোনামুখী-তলায় পৌঁছিয়াই অপু মহা-উৎসাহে চিৎকার করিতে করিতে লাফাইযা এদিক ওদিক ছুটিতে লাগিল-এই যে দিদি, ওই একটা পড়লো রে দিদি-ওই আর একটা রে দিদি! চিৎকার যতটা করিতে লাগিল তাহার অনুপাতে সে আম কুড়াইতে পারিল না। ঝড় ঘোর রবে: বাড়িয়া চলিয়াছে। ঝড়ের শব্দে আম পড়ার শব্দ শুনিতে পাওয়া যায় না, যদিবা শোনা যায় ঠিক কোন জায়গা বরাবর শব্দটা হইল-তোহা ধরিতে পারা যায় না। দুৰ্গা আট-নয়টা আম কুড়াইয়া ফেলিল, অপু এতক্ষণের ছুটাছুটিতে মোটে পাইল দুইটা। তাঁহাই সে খুশির সহিত দেখাইয়া বলিতে লাগিল—এই দাখ দিদি, কত বড় দ্যাখ-ওই একটা পড়লো-ওই ওদিকে—

এমন সময় হই-হাই শব্দে ভুবন মুখুজ্জের বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সব আমি কুড়াইতে আসিতেছে শোনা গেল। সতু চেঁচাইয়া বলিল-ও ভাই, দুগগাদি আর অপু আম কুড়ুচ্ছে–

দল আসিয়া সোনামুখী-তলায় পৌঁছিল। সতু বলিল-আমাদের বাগানে কেন এয়েচ আম কুড়ুতে? সেদিন মা বারণ করে দিয়েচে না? দেখি কতগুলো আম কুড়িয়েচো?

পরে দলের দিকে চাহিয়া বলিল-সোনামুখীর কতগুলো আম কুড়িয়েচে দেখেছিস টুনু?– যাও আমাদের বাগান থেকে দুগ্ৰগদি-মাকে গিয়ে নইলে বলে দেবো।

রানু বলিল-কেন তাড়িয়ে দিচ্ছিস সাতু? ওরাও কুড়ুক-আমরাও কুড়ুই।

-কুড়োবে বই কি! ও এখানে থাকলে সব আমি ওই নেবে। আমাদের বাগানে কেন আসবে ও?–না, যাও দুগগাদি-আমাদের তলায় থাকতে দেবো না।

অন্য সময় হইলে দুৰ্গা হয়তো এত সহজে পরাজয় স্বীকার করিত না-কিন্তু সেদিনইহাদেরই কৃত অভিযোগে মায়ের নিকট মারা খাইয়া তাহার পুনরায় বিবাদ বাধাইবার সাহস ছিল না। তাই খুব সহজেই পরাজয় স্বীকার করিয়া লইয়া সে একটু মনমরা ভাবে বলিল-অপু, আয় রে চল। পরে হঠাৎ মুখে কৃত্রিম উল্লাসের ভাব আনিয়া বলিল-আমরা সেই জায়গায় যাই চলা অপু, এখানে থাকতে না দিলে বয়ে গেল-বুঝলি তো?-এখানকার চেয়েও বড় বড় আম-তুই আমি মজা করে কুড়োবো এখন-চলে আয়-এবং এখানে এতক্ষণ ছিল বলিয়া একটা বৃহত্তর লাভ হইতে বঞ্চিত ছিল, চলিয়া যাওয়ায় প্রকৃতপক্ষে শাপে বর হইল, সকলের সম্মুখে এইরূপ ভাব দেখাইয়া যেন অধিকতর উৎসাহের সহিত অপুকে পিছনে লইয়া রাংচিতার বেড়ার ফাক গলিয়া বাগানের বাহির হইয়া গেল।

175 Shares