পথের পাঁচালী

তাহার বাবা বলিয়াছিল-ও সোনাডাঙা মাঠের রাস্তা, মাধবপুর দশঘরা হয়ে সেই ধলািচতের খেয়াঘাটে গিয়ে মিশেচে।

ধলচিতের খেয়াঘাটে নয়, সে জানিত, ও পথটা আরও অনেক দূরে গিয়াছে। রামায়ণমহাভারতের দেশে।

সেই অশথ গাছের সকলের চেয়ে উঁচু। ডালটার দিকে চাহিয়া থাকিলে যাহার কথা মনে উঠে-সেই বহুদূরের দেশটা। с

শ্রুতিলিখন শুনিতে শুনিতে সেই দুই-বছর-আগে-দেখা পথটার কথাই তাহার মনে হইয়া গেল।

ওই পথের ওধারে অনেক দূরে কোথায় সেই জনস্থান-মধ্যবতী প্রস্রবণ-পর্বত! বনঝোপের স্নিগ্ধ গন্ধে, না-জানার ছায়া নামিয়া আসা ঝিকিমিকি সন্ধ্যায়, সেই স্বপ্নলোকের ছবি তাহাকে অবাক করিয়া দিল। কতদূরে সে প্রস্রবণ-গিরির উন্নত শিখর, আকাশপথে সতত-সঞ্চরমাণ মেঘমালায় যাহার প্রশান্ত, নীল সৌন্দর্য সর্বদা আবৃত থাকে?

সে বড় হইলে যাইয়া দেখিবে।

কিন্তু সে বেতসীকণ্টকিত তাঁট, বিচিত্রপুলিনা গোদাবরী, সে শ্যামল জনস্থান, নীল মেঘমালায় ঘেরা সে অপূর্ব শৈলপ্রস্থ, রামায়ণে বর্ণিত কোনো দেশে ছিল না। বাশ্মীকি বা ভবভূতিও তাঁহাদের সৃষ্টিকর্তা নহেন। কেবল অতীত দিনের কোনো পাখিডাকা গ্ৰাম্য সন্ধ্যায় এক মুগ্ধমতি গ্ৰাম্য বালকের অপরিণত শিশু-কল্পনার দেশে তাহারা ছিল বাস্তব, একেবারে খাঁটি, অতি সুপরিচিত। পৃথিবীপৃষ্ঠে যাহাদের ভৌগোলিক অস্তিত্ব কোনোকালে সম্ভব ছিল না, শুধু এক অনভিজ্ঞ শৈশবমনেই সে কল্পজগতের প্রস্রবণ-পর্বত তাহার সতত-সঞ্চারমাণ মেঘজালে ঢাকা নীল শিখরমালার স্বপ্ন লইয়া অক্ষয় আসন পাতিয়া বসিল।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

দুৰ্গা ভাইকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল। পাড়ার নানাস্থানে খুঁজিয়া কোথাও পাইল না। অন্নদা রায় মহাশয়ের বাড়িতে কাছে আসিয়া ভাবিল—একবার এখানে দেখা যাই, খুড়িমার সঙ্গেও দেখাটা হবে এখন–

অন্নদা রায়ের বাড়ি ঢুকিতেই একটা হৈ হৈ চিৎকার ও কান্নাকাটির কলরব তাহার কানে গেল। বাড়ির মধ্যে না ঢুকিয়া সে দরজার কাছে দাঁড়াইল। রোয়াকের একপাশে দাঁড়াইয়া অন্নদা রায়ের বিধবা ভগ্নী সখী ঠাকরুন চিৎকার করিয়া বাড়ি ফাটাইতেছেন :

—তাই কি মনে একটু ভয় আছে নাকি? ঢের ঢ়ের জাহাবাজ মেয়েমানুষ দেখিচি, এমন আর কক্ষনো দেখিনি রে বাপু, পায়ে গড় করি।-বলে ওই যমের মতো সোয়ামী, রাগলে হাড়ে মাসে এক রাখে না।–তাই না হয় বাপু, একটু সমঝে চলি? সত্যিই তো, আজ তিন দিন ধরে বলচে ধানগুলো একটু রোদে দাও, ওগো ধানগুলো একটু রোদে দাও-কথা কি গেরাহিত্যু হয় নাকি? না কানো যায়? কগর কথা কে শোনে! গোরস্ত ঘরের বৌ ধান ভানবে, কাজ করবে। এই জানি-ত না, রাদিন পটের বিবি সেজে বসে আছে!-‘পটের বিবি’ জিনিসটি পরিস্ফুট করিবার জন্য উত্তমরূপে সাজিয়া যেরূপ ভাবে বসিয়া থাকা উচিত বলিয়া সখী ঠাকরুনের ধারণা তিনি এখানে তাহার অভিনয় করিলেনএ তো বাপু কখনও কোথাও বাপের জন্মে দেখিনি, শুনিওনি–

দালানের মধ্য হইতে অন্নদা রায়ের পুত্ৰবধূ নাকীসুরে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল-পটের বিবি হয়ে সেজে বসে থাকি নাকি! কাল যে দশ সেরা মুগের ডাল ভাজলাম সারা বিকেল ধরে? দুপুর বেলা খেয়েই আরম্ভ করিচি, আর যখন পাঁচটার গাড়ি যাওয়ার শব্দ পেলাম তখনও খোলার তাতেই বসে আছি, দু-ধামা ডাল ভাজা রে, ভাঙা রে-করে অন্ধকার হয়ে গিয়েচে তখন উঠিচি-সে। কি অমনি হয়? গা-গতর ব্যথা হয়ে গেচে, রাত্তিরে বলি বুঝি জ্বর হল, এমনি গায়ে-হাতে ব্যথা-তা কি কেউ দ্যাখে? তার ওপর সকাল বেলা বিনি দোষে এই মার-কেন সংসারে কি বসে বসে খাই?

এমন সময় অন্নদা রায়ের ছেলে গোকুল এক হাতে একখানা কঁচা বাঁশের পাতাসুদ্ধ ডগা ও আর এক হাতে দা লইয়া বাড়ি ঢুকিল। স্ত্রীর কান্নার শেষ অংশ শুনিতে পাইয়া গর্জন করিয়া কহিল–এখনও তোমার হয়নি-এখন তোমার আদেষ্টে বেস্তর দুকথু আছে দেখচি-আমার রাগ বাড়িও না মেলা সঙ্কাল বেলা! আজ তিনদিন ধরে ধানগুলো রোদুরে দেওয়ার জন্যে বলে বলে হয়রান-এই মেঘলা মেঘলা যাচ্চে, এর পর ধানগুলো যদি কলিয়ে যায়, তবে তোমার কোন বাবা এসে সামলাবে?…সারা বছরের পিণ্ডি জুটবে কোথেকে?

গোকুলের বউ হঠাৎ কান্না বন্ধ করিয়া তেজের সহিত জোর গলায় বলিয়া উঠিল–তুমি আমার বাবা তুলে গালাগালি কোরো না বলে দিচ্চি-আমার বাবা কি করেচে। তোমার, কেন তুমি বাবার নামে যখন তখন যা তা বলবে?

তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে গোকুল হাতের বাঁশ নামাইয়া রাখিয়া দা হাতে এক লাফে রোয়াকের সিঁড়ি বাহিয়া উঠিয়া কহিল—তবে রে! আজি তোমার একদিন কি আমার একদিন– তোমার বাপের বাড়ির আবদার না ঘুচিয়ে আমি আজ–

একটা খুনোখুনি ব্যাপার বুঝি বা হয় দেখিয়া বাড়ির কৃষাণ উঠান হইতে ডাকিয়া কহিল-কি করেন। দ-ঠাকুর-কি করেন, থামুন, থামুন-পরে সে ছুটিয়া রোয়াকে উঠিল-দুর্গাঁও ছুটিয়া আসিল—সখী ঠাকুবুনও রোয়াক হইতে দালানের মধ্যে ঢুকিলেন- খুব একটা হৈ-চৈ হইল। দালানের মধ্যে গোকুলের স্ত্রী স্বামীর উদাত আক্রমণের সম্মুখে পিছাইয়া গিয়া মার ঠেকাইবার জন্য দুই হাত তুলিয়া দেওয়ালের গায়ে প্রাণপণে ঠেস দিয়া জড়োসড়ো হইয়া দাঁড়াইয়াছে, চোখে তার ভয়ের দৃষ্টি-কৃষাণ গিয়াই গোকুলের হাত হইতে দা-খানা কড়িয়া লইল; পরে তাহাকে ধরিয়া দালানের বাহিরে আনিতে আনিতে বলিতে লাগিল—কি করেন। দ-ঠাকুর, থামুন-আঃ—আসুন–

গোকুলের বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের কম নয়, কিন্তু দেহ তেমন সবল নহে, বলিষ্ঠ কৃষাণের সহিত ম্যালেরিয়া-দুর্বল দেহ লইয়া হাত ছাড়াছাড়ির চেষ্টা করিতে গেলে দুর্বলতাটাই অধিকতর প্রকাশ হইয়া পড়িবে বুঝিয়া বলিতে বলিতে নামিল-দ্যাখো না-একটা ডোল ধান, বীজ ধান, জল পেয়ে যদি কলিয়ে যায়, ও কি আর রোয়া হবে? আজ তিনদিন ধরে বলচি-আবার তেজডা দেখলে তো?–তোমার তেজ আমি–

দুর্গা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল, কিন্তু এ সময়ে খুড়িমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় কথাবার্তার সময় নাই বুঝিয়া সে একপ্রকার নিঃশব্দেই অন্নদা রায়ের বাড়ির বাহির হইয়া পড়িল।

পাঁচু বাঁড়ুজ্যের বাড়ির কাছে জামতলায় একজন লোক ঘটিবাটি সারাইতে বসিয়াছে। কাঠের কয়লার হাপরে গানগনে আগুন, পাড়ার লোকের অনেক ভাঙা ঘটিবাটি জড়ো করা। বেঁটে ধরনের লোকটা, পাকসিটে গড়নের চেহারা, বয়স কত বুঝিবার উপায় নেই, ত্ৰিশও হইতে পারে, পঞ্চাশও হইতে পারে, গলায় ত্রিকাঠি তুলসীর মালা, মুখের ডান দিকে একটা কাটার দাগ-হাতের কজিতে দড়ির মতো শিরা বাহির হইয়া আছে, পরনে আধময়লা ধুতি। পাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে তাহাকে ঘিরিয়া ঘটিবাটি সারানো দেখিতেছে। দুৰ্গাঁও গেল। লোকটা বলিল-কি চাই খুকি?

সে বলিল-কিছু না, দেখবো।

বাড়ি ফিরিয়া মা’র কাছে বলিল-আজ মা গোকুল কাকা খুড়িমাকে যা মেরেছে সে কি বলবো-পরে সে আনুপূর্বিক বর্ণনা করিল।

সর্বজয়া বলিল-গোঁয়ার গোবিন্দ চাযা একটা বই তো নয়!—আহা, ভালোমানুষ বৌটা এমন হাতে আর এমন বাড়িতে পড়েচে-ঠেঙা খেতে খেতেই জীবনটা গেল।

-আমাকে তো বড় ভালোবাসে-যখন যা বাড়িতে হবে, আমার জন্যে তুলে রেখে দেবে। খুড়িমার কান্না দেখে এমন কষ্ট হল মা! সখী ঠাকুমা আবার এখন উলটে খুড়িমাকেই বকে—

সে তিন-চার দিন জামতলায় ঘটিবাটি সারানো দেখিতে গেল। লোকটি তাহার বাড়ি, বাপের নাম সব খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করে। বলিল–তোমাদের বাড়ির জিনিসপত্তর সারাবে না? নিয়ে এসো না খুঁকি?

দুর্গা বাড়ি আসিয়া মাকে বলিল-আমাদের ভাঙা ঘটি-গাড়গুলো দেবে মা, একজন বেশ ভালোমানুষ লোক এসেচে-ওপাড়ার পথে জামতলায় বসে সারাচ্ছে–

লোকটা তার নাম বলে পিতম-জাতে নাকি কাসারি। হাপর জ্বালাইতে জ্বালাইতে একএকবার সোজা হইয়া বসিয়া বলে–জয় রাধে!–রাধে গোবিন্দ!

সকাল বেলা তাহার কাছে পাড়ার অনেকে আসিয়া জোটে। সে চিমটা দিয়া হাপর হইতে আগুন উঠাইয়া অনবরত তামাক সাজিয়া ভদ্রলোকদের হাতে দিতেছে–দিবার সময় মুখখানা বিনয়ে কঁচুমাচু করিয়া ঘাড় একধারে কাত করিয়া বলে-হেঁ হেঁ, তামাক ইচ্ছে করুন, বাবাঠাকুর!– রাধারানী-পদ ভরসা!..নারকেলের কথা আর বলবেন না বাবাঠাকুর, আর বছর জষ্টিমাসে বলি দিই গোটাকতক চারা বসিয়ে!–আন্ধকাঠ-খানেক জমিতে ছগণ্ডা চারা কিনে লাগিয়ে দিলাম–তা ব্যাঙের উপদ্রুতে—একেবারে মূলশেকড়-টুল শেকড় সবসুদ্দ…কটা টাকাই মাটি।

মুখুজ্যে মশায় সকাল হইতে ঠায় বসিয়া আছেন, কোনো রকমে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিয়া একটা পিতলের ঘাড়া বিনামূল্যে সারাইয়া লইবেন। তামাক খাইতে খাইতে পূর্ব কথার খেই ধরিয়া বলিলেন—এই তো গেল কাণ্ড বাপু -তো-এবারও তো ভেবেছিলাম কুড়িখানেক চারা বাড়ির পেছনে-তা এমন ম্যালেরিয়া ধরল–তোমাদের ওদিকে কি রকম হে কারিগর? (তিনি সকাল হইতেই তাহাকে কারিগর বলিয়া ডাকিতেছেন)।

175 Shares