পথের পাঁচালী

-পরিপুন্নু-আজ্ঞে পরিপুন্নু-ম্যালেরিয়ার কথা বলবেন না বাবাঠাকুর-হাড় জ্বালিয়ে খেয়েচে–এই নিন। আপনার ঘাড়াটা, ছটা পয়সা দেবেন—

মুখুজ্যে মশায় ঘড়াটা হাতে লইয়া উঠিয়া পড়িয়া বলেন-হ্যাঁ! এর জন্যে আবার পয়সা।– দিলে একটা জিনিস ব্রাহ্মণকে সারিয়ে আমনি কীর্তিক মাসের দিনটা-তার আবার

পিতম তাড়াতাড়ি মুখুজ্যে মশায়ের হাতের ঘড়াটা ধরিয়া অত্যন্ত অমায়িক ভাবে হাসিয়া বলে-আজ্ঞে না, মাপ করবেন বাবাঠাকুর, এমনি সারিয়ে দিতে পারবো না-এখনও সক্কাল বেলা বউনি হয়নি। আজ্ঞে না।–তা পারবো না।–ঘড়াটা রেখে যান-বাড়ি গিয়ে পাহা কটা পাঠিয়ে দেবেন—

দুৰ্গার মা বলে-দেখিস দিকি-ভাঙা বাসন-কোসন বদলে নতুন বাসন-কোসন অনেক সময় ওরা দেয়-জিজ্ঞেস করিস তো।

পিতম খুব রাজি। দুর্গা বাড়ি হইতে বহিয়া বহিয়া এক রািশ পুরানো গাড় ঘটিবাটি ঘড়া তাহার কাছে লইয়া গিয়া হাজির করে। অর্ধেক দিনটা সে জামতলাতেই কাটায়-হাপর জ্বালানো, রং ঝাল করা বসিয়া বসিয়া দেখে। পিতম বলিয়াছে তাহাকে একটা পিতলের আংটি গড়াইয়া দিবে-ইহাও বলিয়াছে যে, সারাইবার পয়সা তাহাদের লাগিবে না। সর্বজয়া শুনিয়া বলে-আহা বড় ভালো লোকটা তো! আসচে বুধবার অপুর জন্মবারটা, বলিস তাকে আসতে—আমাদের এখানে দুটো ডালভাত পেরসাদ পেয়ে যাবে এখন–

বুধবার সকালে উঠিয়া দুৰ্গা জামতলায় গিয়া দেখিল লোকটা নাই। জিজ্ঞাসা করিয়া শুনিল পূর্বদিন সন্ধ্যার পর কোন সময়ে সে দোকান উঠাইয়া চলিয়া গিয়াছে—হাপরের গর্ত ও পোড়া কয়লার রাশি ছাড়া অন্য কোন চিহ্ন নাই। দুৰ্গা এখানে ওখানে খোঁজ করিল-একে ওকে জিজ্ঞাসা করিল, কেহ জানে না। সে কোথায় গিয়াছে। ভয়ে দুর্গার মুখ শুকাইয়া গেল-মা শুনিলে কি বলিবে! সংসারের অর্ধেক বাসন তাহার কাছে যে! সে দুর্গাকে বলিয়াছিল, ঝিকরহাটির বাজারে তাহার কাঁসারির দোকান আছে, সেখানে সে খবর পাঠাইয়াছে।–তাহার ভাই একদিনের মধ্যে নতুন বাসন লইয়া আসিয়া পড়িল বলিয়া-আসিলেই ভাঙাচোরা বাসনগুলা সব বদলাইয়া দিবে। কোথায়ই বা সে-আর কোথায়ই বা তাহার ভাই! কোথায় সে যে গেল তাহা দুৰ্গা অনেক খুঁজিয়াও পাইল না। কেবলমাত্র তাহদেরই জিনিস গিয়াছো-অন্য খুঁশিয়ার লোকের এক টুকরা পিতলও খোয়া যায় নাই।

সারাদিনের পরে সন্ধ্যার সময় দুৰ্গা কঁদো কঁদো মুখে মাকে সব বলিল। হরিহর বিদেশেকেই বা খোজ করে, কেই বা দেখে। সর্বজয়া অবাক হইয়া যায়! বলে–একবার তোর রায় জেঠামশায়কে গিয়ে বল তো! ওমা এমন কথা তো কখনও শুনিনি!…

হরিহর বাড়ি আসিলে ঝিকরহাটির বাজারে খোজ করা হইয়াছিল-পিতাম নামক কোন লোকের সেখানে কাসারির দোকান নাই বা উক্ত চেহারার কোনো লোকও সেখানে নাই।

কয়েক মাস কাটিয়া গিয়াছে। ভাদ্র মাস।

অপু বৈকাল বেলা বেড়াইতে যাইবার সংকল্প করিতেছে, এমন সময় তাহার মা পিছনে ডাকিয়া বলিল-কোথায় বেবুছিস রে অপু?-চাল ভাজা আর ছোলা ভাজা ভাজচি-বেরিয়ো না যেন। …এক্ষুনি খাবি–

অপু শুনিয়াও শুনিল না-যদিও সে চাল-ছোলা ভাজা খাইতে ভালোবাসে বলিয়াই মা তাহার জন্য ভাজিতে বসিয়াছে ইহা সে জানে-তবুও সে কি করিতে পারে?—এতক্ষণ কি খেলাটাই চলিতেছে নীলুদের বাড়িতে? সে যখন বাহির দরজায় পা দিয়াছে, মার ডাক আবার কানে গেলবেবুলি বুঝি -ও অপু, বা রে, দ্যাখো মজা ছেলের! গরম গরম খাবি—-আমি তাড়াতাড়ি ঘাট থেকে এসে ভাজতে লাগলাম-ও অপু-উ-উ-

অপু এক ছুট দিয়া নীলুদের বাড়ি গিয়া পৌঁছিল। অনেক ছেলে জুটিয়াছিল, অপু আসিবার আগেই খেলা সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে। নীলু বলিল-চল অপু, দক্ষিণ মাঠে পাখির ছানা দেখতে যাবি? অপু রাজি হইলে দুজনে দক্ষিণ মাঠে গেল। ধান ক্ষেতের ওপারেই নবাবগঞ্জের বাঁধা সড়কটি পূর্ব পশ্চিমে লম্বা হইয়া যেন মাঠের মাঝখান চিরিয়া চলিয়া গিয়াছে। গ্রাম হইতে এক মাইলেব উপব হইবে। অপু এতদূর কখনও বেড়াইতে আসে নাই।–তাহার মনে হইল যেন সমস্ত পরিচিত জিনিসের গণ্ডি ছাড়াইয়া কোথায় কতদূরে নীলুদা তাহাকে টানিয়া আনিল। একটুখানি পরেই সে বলিল, বাড়ি চল নীলুদা, আমায় মা বকবে, সন্দে হয়ে যাবে, আমি এক গাবতলার পথ দিয়ে যেতে পারবো না। তুমি বাড়ি চল——

ফিরিতে যাইয়া নীলু পথ হারাইয়া ফেলিল। ঘুরিয়া ফিরিয়া কাহাদের একটা বড় আমবাগানের ধারা দিয়া একটা পথ মিলিল। সন্ধ্যা হইবার তখনও কিছু বিলম্ব আছে, আকাশে আবার মেঘ ঘনাইয়া আসিতেছে—এমন সময় চলিতে চলিতে নীলু হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া অপুর কনুই-এ টান দিয়া সম্মুখ দিকে চাহিয়া ভয়ের সুরে বলিল-ও ভাই আপু!

অপু সঙ্গীর ভয়ের কারণ বুঝিতে না পারিয়া বলিল-কি রে নীলুদা? পরে সে চাহিয়া দেখিল, যে সুড়িপথটা দিয়া তাহারা চলিতেছিল, তাহা কাহাদের উঠানে গিয়া শেষ হইয়াছে-উঠানে একখানা ছোট্ট চালাঘর ও একটা বিলাতী আমড়ার গাছ। তাহার কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার পূর্বেই নীলু। ভয়ের সুরে বলিয়া উঠিল-আতুরী ডাইনির বাড়ি!

অপুর মুখ শুকাইয়া গেল.আতুরী ডাইনির বাড়ি: .সন্ধেবেলা কোথায় আসিয়া ব্ৰাহারা পড়িয়াছে! কে না জানে যে ওই উঠানের গাছে চুরি করিয়া বিলাতি আমড়া পাড়িবার অঙ্গরাধে ডাইনিটা জেলেপাড়ার কোন এক ছেলের প্রাণ কড়িয়া লইয়া কচুর পাতায় বাঁধিয়া জলে ড়ুবাইয়া রাখিয়াছিল, পরে মাছে তাহা খাইয়া ফেলিবার সঙ্গে সঙ্গে বেচারির আমড়া খাইবার সাধ এ জন্মের মতো মিটিয়া যায়! কে না জানে সে ইচ্ছা করিলে চোখের চাহনিতে ছোট ছেলেদের রক্ত চুষিয়া খাইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিতে পারে, যাহার রক্ত খাওয়া হইল, সে কিছুই জানিতে পরিবে না, কিন্তু বাড়ি গিয়া খাইয়া-দাইয়া সেই যে বিছানায় শুইবে আর পরদিন উঠিবে না! কতদিন শীতের রাত্রে লেপের তলায় শূইয়া দিদির মুখে আতুরী ডাইনির গল্প শুনিতে শুনিতে সে বলিয়াছে।–রাত্রিতে তুই ওসব গল্প বলিসনে দিদি, আমার ভয় করে,-তুই সেই কুচবরণ রাজকন্যের গল্পটা বল দিকি?

ঝাপসা দৃষ্টিতে সে সম্মুখে চাহিয়া দেখিতে গেল বাড়িতে কেহ আছে কিনা এবং চাহিবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সমস্ত শরীরা যেন জমিয়া হিম হইয়া গেল. বেড়ার বাঁশের আগড়ের কাছে.অন্য কেহ। নয়, একেবারে স্বয়ং আতুরী ডাইনি তাহদের—এমন কি যেন শুধু তাঁহারই দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া!…

যাহার জন্য এত ভয়, তাহাকে একেবারে সম্মুখেই এভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া অপুর সামনে পিছনে কোনো দিকেই পা উঠিতে চাহিল না।

আতুরী বুড়ি ভুবু কুঁচকাইয়া তোবড়ানো গালটা আরও ঝুলাইয়া ভালো করিয়া লক্ষ করিবার ভঙ্গিতে মুখটা সামনের দিকে একটু বাড়াইয়া দিয়া পায়ে পায়ে তাহদের দিকে আগাইয়া আসিতে লাগিল। অপু দেখিল সে ধরা পড়িয়াছে, কোনো দিকেই আর পলাইবার পথ নাই।–যে কারণেই হউক ডাইনির রাগটা তাহার উপরেই—এখনই তাহার প্রাণটি সংগ্ৰহ করিয়া কচুর পাতায় পুরিবে! মুখের খাবার ফেলিয়া, মায়ের ডাকের উপর ডাক উপেক্ষা করিয়া সে যে আজ মায়ের মনে কষ্ট দিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে তাহার ফল। এই ফলিতে চলিল। সে অসহায়ভাবে চারিদিকে চাহিয়া বলিল-আমি কিছু জানিনে-ও বুড়ি পিসি-আমি আর কিছু করবো নাআমায় ছেড়ে দাও, আমি ইন্দিকে আর কখনও আসবো না-আজ ছেড়ে দাও ও বুড়ি পিসি–

নীলু। তো ভয়ে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল-কিন্তু অপুর ভয় এত হইয়াছিল যে, চোখে তাহার জল ছিল না।

বুড়ি বলিল-ভয় কি মোরে, ও বাবারা? মোরে ভয় কি?… পরে খুব ঠাট্টা করা হইতেছে ভাবিয়া হাসিয়া বলিল, মুই কি ধরে নেবো খোকারা? এসো মোর বাড়িতি এসো-আমচুর দেবানি এসো–

আমচুর!…ডাইনি বুড়ি ফাকি দিয়া ভুলইয়া বাড়িতে পুরিতে চাহিতেছে—গেলেই আর কি! ডাইনিরা রাক্ষসীরা যে এ-রকম ভুলইয়া ফাঁদে ফেলে-এ-রকম কত গল্প তো সে মা’র মুখে শুনিয়াছে।

এখন সে কি করে!…উপায়?

বুড়ি তাহার দিকে আরও খানিক আগাইয়া আসিতে আসিতে বলিল-ভয় কি ও মোরে বাবারা? মুই কিছু বলবো না, ভয় কি মোরে?

আর কি, সব শেষ! মায়ের কথা না শুনিবার ফল ফলিবার আর দেরি নাই, হাত বাড়াইয়া তাহার প্রাণটা সংগ্ৰহ করিয়া এখনই কচুর পাতায় পু-রিল! প্রতি মুহুর্তেই তাহার আশঙ্কা হইতেছিল যে এখনই এ বুড়ি হাসিমুখ বদলাইয়া ফেলিয়া বিকট মূর্তি ধরিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিবে।–রাক্ষসী রানীর গল্পের মতো! বনের অজগর সাপের দৃষ্টির কুহকে পড়িয়া হরিণশিশু নাকি অন্য দিকে চোখ ফিরাইতে পারে না, তাহারও চোখদুটির কুহক-মুগ্ধ দৃষ্টি সেরূপ বুড়ির মুখের উপর দৃঢ়নিবদ্ধ ছিলসে আড়ষ্ট কণ্ঠে দিশহারা ভাবে বলিয়া উঠিল, ও বুড়ি পিসি, আমার মা কঁদবে, আমায় আজ আর কিছু বোলো না-আমি তোমার গাছে কোনো দিন আমড়া নিতে আসিনি-আমার মা কঁদবেআতঙ্কে সে নীলবৰ্ণ হইয়া উঠিয়াছে।…বাড়ি, ঘরদোর, গাছপালা, নীলু, চারিধারা যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। কেহ কোনোদিকে নাই…কেবল একমাত্র সে আর আতুরী ডাইনির ক্রুর দৃষ্টি মাখানো একজোড়া চোখ..আর অনেক দূরে কোথায় যেন মা আর তাহার চাল-ভাজা খাওয়ার ডাক।!…

175 Shares